ঢাকা: কম খরচেই দেশে এখন বিশ্বমানের নিউক্লিয়ার মেডিসিন চিকিৎসা সেবা পাওয়া যায়। নিউক্লিয়ার বা পারমাণবিক শব্দের সঙ্গে একটা ভয় বা আতঙ্ক জড়িত থাকলেও পরমাণুর অপার শক্তিকে মানুষের কল্যাণেও ব্যবহার করা যায়।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিশ্বে ৯০ শতাংশের বেশি ক্যানসার শনাক্ত হয় পরমাণু প্রযুক্তি পেট সিটি স্ক্যানের মাধ্যমে। পরমাণু কমিশনের ল্যাবে মাত্র ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায় পেট সিটি স্ক্যানের মাধ্যমে ক্যানসার নির্ণয় করা যাবে। এর আগে সরকারিভাবে ৩৫ হাজার ও বেসরকারিভাবে ৬০ হাজার টাকা খরচ হতো। এর ফলে বিদেশ নির্ভরতা কমবে এবং রোগীর অর্থনৈতিক সাশ্রয় হবে।
১৯৬২ সালে তৎকালীন পাকিস্তান আমলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এ দেশের পরমাণু চিকিৎসার যাত্রা শুরু। বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের অধীনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) একটি ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন অ্যান্ড অ্যালাইভ সায়েন্সসহ (নিনমাস) জেলা এবং বিভাগীয় পর্যায়ের মেডিকেল কলেজে ১৬টি পরমাণু চিকিৎসা ইন্সটিটিউট রয়েছে। নির্মাণাধীন আরও আটটির কাজ শেষের পথে।
নিউক্লিয়ার মেডিসিন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরমাণু চিকিৎসার ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয়ের জন্য রেডিও একটিভ সাবস্টেন্স ব্যবহার করা হয়। যেকোনো পরমাণুকে রেডিও একটিভ করলে রেডিয়েশন রিলিজ হয়। এই রেডিয়েশনকেই রোগ নির্ণয়ের জন্য ব্যবহার করা হয়। রোগ এবং রোগীভেদে এই আইসোটোপগুলির ধর্ম এবং তেজস্ক্রিয়তা আলাদা হয়। রোগীর শরীরে গিয়ে আইসোটোপগুলি নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার মাধ্যমে গামা রশ্মি বা গামা ফোটন তৈরি করে। রোগীর শরীর থেকে বের হওয়া গামা রশ্মিতে রোগীর শরীরের তথ্য থাকে। গামা ক্যামেরা এই গামা ফোটনগুলি সংগ্রহ করে সেখান থেকে রোগীর বিভিন্ন অর্গানের ছবি সংগ্রহ করে। ফলে রোগীর রোগ সম্বন্ধে তথ্য পাওয়া যায়। অর্থাৎ তেজস্ক্রিয়তা ব্যবহার করে রোগ নির্ণয় ও রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি হল নিউক্লিয়ার মেডিসিন।
নিনমাসে কি ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং চিকিৎসা দেওয়া হয়, জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক এবং পেট সিটি স্ক্যান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. শামিম মমতাজ ফেরদৌসি বেগম বলেন, নিউক্লিয়ার মেডিসিন ইন্সটিটিউটে তিন ধরনের কাজ করা হয়, প্রথমত এখানে যেসব রোগীদের রেফার্ড করা হয়, তাদের পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয়, দ্বিতীয়ত রোগের চিকিৎসা এবং শিক্ষা ও গবেষণার কাজ করা হয়।
তিনি আরও বলেন, নিউক্লিয়ার মেডিসিন ব্যবহার করে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের স্ক্যান করা হয়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, আমরা স্ক্যান করে বলে দিতে পারি, হৃৎপিণ্ডের রক্ত সঞ্চালন ঠিক আছে কি না। থাইরয়েড গ্লান্ড কোনো কারণে রোগাক্রান্ত হলে, আমরা সেটা নির্ণয় করতে পারি। পেট সিটি স্ক্যান করে করে আমরা বলে দিতে পারি শরীরের কোথায় ক্যানসার, কোন পর্যায়ে আছে। ক্যানসার চিকিৎসা দেওয়ার পর, চিকিৎসা কার্যকর হলো কিনা, সেটাও জানতে পারি। এটি ক্যানসার চিকিৎসায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। ব্রেইনের এলজেইমার ডিজিস বা কোনো অস্বাভাবিকতা থাকলে, সেটা আমরা নির্ণয় করতে পারি। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের রক্তের এবং হরমোনের পরীক্ষা করা হয়। প্রেগন্যান্সির সময় কালার ডপলার, বিভিন্ন জয়েন্টের আল্ট্রাসনোগ্রাম, বায়োলজিক্যাল প্রোফাইলসহ আরও বিভিন্ন ধরনের অ্যাডভান্স এবং স্পেশাল লেভেলের কিছু আলট্রাসনোগ্রাম করা হয় পরমাণু চিকিৎসা কেন্দ্রে।
তিনি বলেন, ১৯৮০ সালে বাংলাদেশে প্রথম যে আলট্রাসোনোগ্রাফি মেশিন এসেছিল, সেটা এই ইন্সটিটিউটেই আনা হয়েছিল। এখান থেকেই আলট্রাসোনোগ্রাফির যাত্রা শুরু। বর্তমানে দেশের সবখানেই আলট্রাসোনোগ্রাফির সুবিধা আছে।
চিকিৎসা প্রসঙ্গে নিনমাস পরিচালক বলেন, থাইরয়েডের প্রদাহ বা থাইরয়েড টক্সিকোসিস রোগ এবং হাইপোথাইরয়ডের চিকিৎসা আমরা করি। থাইরয়েডের ক্যান্সার হলে আমরা তারও চিকিৎসা করি। এক্ষেত্রে আমরা রেডিও অ্যাকটিভ আয়োডিন ১৩১ দিয়ে চিকিৎসা করি। এক্ষেত্রেও বাংলাদেশের নিউক্লিয়ার মেডিসিন পাইওনিয়ার।
১৯৮০ সাল থেকেই থাইরয়েড রোগের বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা দিয়ে আসছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, চোখের টেরিজিয়াম নামে একটি রোগ রয়েছে, এই রোগেও আমরা রেডিয়েশন দিয়ে চিকিৎসা করি। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে যদি আমাদের তুলনা করি তাহলে হয়তো আমরা নিউক্লিয়ার মেডিসিনে চিকিৎসার ক্ষেত্রে কিছুটা পিছিয়ে রয়েছি। তবে ভবিষ্যতে হয়তো আমরা উন্নত বিশ্বের মতই নিউক্লিয়ার মেডিসিনে উন্নত মানের সেবা দিতে পারব।
পরীক্ষা নিরীক্ষার খরচ এবং মান প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকারি বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসা সেবার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই আমাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে। খুব কম মূল্যেই আমরা এই সেবা দিয়ে থাকি। অন্যদিকে সেবার বিষয়ে আমরা সবসময়ই চেষ্টা করি সর্বোচ্চ এবং বিশ্বমানের সেবা দিতে। আমরা বিভিন্ন টেস্ট এবং রিপোর্টের ক্ষেত্রে ইন্টারন্যাশনাল প্রটোকল অনুসরণ করি। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি (আইএইএ) সব সময় আমাদের মনিটর করে।
দেশে নিউক্লিয়ার মেডিসিন বিষয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি জানতে চাইলে পেট সিটি স্ক্যানের বিভাগীয় প্রধান জানান, আমরা মোটামুটি সবকিছুতেই ইন্টারন্যাশনাল লেভেলে আছি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ক্যান্সারের চিকিৎসায় রেডিও নিউক্লিয়ার থেরাপি ব্যবহার করা হচ্ছে, চিকিৎসার শাস্ত্রে এটাকে নতুন দিগন্ত বলা চলে। রেডিও একটিভ সাবস্টেন্স ব্যবহার করে খুব প্রিসিসান থেরাপি দেওয়া যায়, ব্যক্তি এবং ধরন অনুযায়ী পার্সোনালাইজ চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। যার যে কয়টি থেরাপি লাগবে তাকে সেই কয়টি দেওয়া হয়, এটা ক্যান্সার রোগের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ওভার ট্রিটমেন্ট হলে সেটাও অনেক ক্ষতিকর। নিউক্লিয়ার মেডিসিনে এটা ইনসিওর করা যায়। ক্যান্সারের চিকিৎসায় যে রেডিও আইসোটোপ ব্যবহার করা হয়, আমাদের দেশে তা অ্যাভেলেবেল না হওয়ার কারণে প্রপারলি ব্যবহার করতে পারছি না। এই দিক দিয়ে আমরা একটু পিছিয়ে রয়েছি। হয়তো আমাদের দেশেও শিগগিরই রেডিও আইসোটোপগুলো অ্যাভেলেবেল হলে উন্নত বিশ্বের মত আমরাও নিউক্লিয়ার মেডিসিনের যাবতীয় চিকিৎসা দিতে পারব।
নিউক্লিয়ার মেডিসিন বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নন কমিউনিক্যাল ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগামের (অসংক্রামক রোগ) লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমীন বলেন, নিউক্লিয়ার মেডিসিন সেবার পরিধি বাড়ছে। যদি সব ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি এবং যন্ত্রপাতি সবখানে সঠিকভাবে স্থাপন এবং ব্যবহার করা করা তাহলে ভবিষ্যতে আরও ভালো হবে।
(এই প্রতিবেদনটি বিএনএনআরসির তত্ত্বাবধানে স্বাস্থ্য সাংবাদিকতায় মিডিয়া ফেলোশিপের আওতায় তৈরি)
বাংলাদেশ: ২০৫০ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩০, ২০২২
আরকেআর/এজে