ঢাকা: বিশ্বব্যাপী পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশুদের মৃত্যুর প্রধান সংক্রামক কারণ নিউমোনিয়া। প্রতি বছর প্রায় সাত লাখ শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায়।
বৃহস্পতিবার (৯ নভেম্বর) রাজধানীর মহাখালীর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) কনফারেন্স হলে শিশুদের নিউমোনিয়া নিয়ে এক আলোচনা সভায় এসব তথ্য জানানো হয়।
আসন্ন বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবসকে (১২ নভেম্বর) সামনে রেখে ‘শিশুদের নিউমোনিয়া: আমরা কি যথেষ্ট করছি?’ শীর্ষক আলোচনা সভাটি আয়োজন করা হয়।
বারডেম জেনারেল হাসপাতাল ও ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আবিদ হোসেন মোল্লা নিউমোনিয়াকে ফুসফুসের প্রদাহ হিসেবে বর্ণনা করে সভায় এর মূল চরিত্র তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, রোগের শুরুতে কাশি হয়, যা সাধারণত দুই-চার সপ্তাহের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। তবে কিছু ক্ষেত্রে এ থেকে শ্বাসকষ্ট এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে অল্পবয়সী, প্রবীণ এবং যাদের হৃৎপিণ্ড বা ফুসফুসের সমস্যা রয়েছে, তাদের গুরুতর নিউমোনিয়া হওয়ার ঝুঁকি বেশি। তাদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা নেয়ার প্রয়োজন হতে পারে।
আইসিডিডিআর,বির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ জোবায়ের চিশতী নিজের ও ড. নুর হক আলম, ড. কে জামান ও ড. আহমেদ এহসানুর রহমানের কয়েকটি গবেষণার ফল উপস্থাপন করেন। গবেষণাগুলো সফলভাবে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে পরীক্ষা করা হয়েছে এবং পরীক্ষামূলকভাবে এর ব্যবহারও করা হয়েছে।
তার উপস্থাপনায় উঠে আসে, নিউমোনিয়া এখনো বিশ্বব্যাপী পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশুদের মৃত্যুর প্রধান সংক্রামক কারণ। এই রোগের ফলে প্রতি বছর প্রায় সাত লাখ শিশুর মৃত্যু হয়, যা পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশুদের সব মৃত্যুর ১৪ শতাংশ।
বাংলাদেশে পরিস্থিতি কিছুটা খারাপ। প্রতি ঘণ্টায় আনুমানিক দুই-তিনজন শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায় এবং বছরে প্রায় ২৪ হাজার শিশু মৃত্যুবরণ করে। এটি পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে ২৪ শতাংশ মৃত্যুর জন্য দায়ী, যা বিশ্বব্যাপী গড় থেকে বেশি।
কয়েক দশক ধরে মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সত্ত্বেও গত পাঁচ বছরে প্রতি হাজার জীবিত শিশু জন্মের ক্ষেত্রে প্রায় ৭ দশমিক ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে নিউমোনিয়ায়। পাশাপাশি আনুমানিক ৪০ লাখ নতুন রোগীসহ প্রতি বছর আনুমানিক ৬ লাখ ৭৭ হাজার শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
ড. চিশতী বাংলাদেশের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া শিশুদের নিউমোনিয়ার পেছনে বিশেষ কারণ তুলে ধরেন। ২০১৯ ও ২০২১ সালে আইসিডিডিআর,বির গবেষণায় অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের বিষয়টি উঠে আসে। গবেষণা ফলে দেখা যায়, বিরল গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া শৈশবকালীন নিউমোনিয়ার নতুন কারণ হিসাবে আবির্ভূত হচ্ছে।
প্রতিরোধমূলক কৌশলগুলো তুলে ধরে ড. চিশতী আইসিডিডিআর,বির গবেষণায় প্রাপ্ত ফল থেকে দেখান, ঘরের মধ্যে বাতাসের গুণগতমান উন্নত করার মাধ্যমে নিউমোনিয়া মৃত্যুর ঝুঁকি অর্ধেক করা সম্ভব এবং হাত ধোয়া ২১ শতাংশ কেস কমাতে পারে।
আইসিডিডিআর,বির গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভবতী নারীদের আরএসভি ভ্যাকসিন দেওয়া হলে তা নবজাতক শিশুদের গুরুতর নিউমোনিয়া এবং হাইপোক্সেমিয়া (রক্তে অক্সিজেনের স্বল্পতা) প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
শিশুদের সুরক্ষার ক্ষেত্রে, শিশুর জন্মের প্রথম ছয় মাস শুধুমাত্র মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো একটি বড় ভূমিকা পালন করে। এর ফলে নিউমোনিয়া হওয়ার সম্ভাবনা ১৫ ভাগ কমে যায়।
শিশুদের নিউমোনিয়া নির্ণয় ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে আলোচনায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। প্রথমত, মাত্র ৬০ শতাংশ অভিভাবক সন্তানদের নিউমোনিয়ার উপসর্গ দেখা দিলে চিকিৎসা সেবা নেন। বাকিরাও যাতে এ সময়ে চিকিৎসা নিতে আসেন, এ জন্য আরও জনসচেতনতার প্রয়োজন।
আইসিডিডিআর,বির নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ তার স্বাগত বক্তব্যে বলেন, আগে ডায়রিয়া শিশুমৃত্যুর প্রধান ঘাতক হলেও, বর্তমানে নিউমোনিয়া শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ। নিউমোনিয়ায় প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী অনেক শিশু মারা যায়। আক্রান্ত হয় প্রাপ্তবয়স্করাও, তাদেরও মৃত্যু ঝুঁকি রয়েছে। আইসিডিডিআর,বিতে নিউমোনিয়া নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, যা সফলভাবে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে পরীক্ষা করা হয়েছে এবং পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহারও করা হয়েছে। এ ফল ও পদ্ধতি মানুষের কাছে আরও সহজে পৌঁছে দেওয়াই আমাদের প্রধান লক্ষ্য।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ৯, ২০২৩
আরকেআর/আরএইচ