ঢাকা, শুক্রবার, ৭ আষাঢ় ১৪৩২, ২০ জুন ২০২৫, ২৩ জিলহজ ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

দেশে চার কোটি ৫০ লাখ মানুষ ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০:৩৮, জুন ১৯, ২০২৫
দেশে চার কোটি ৫০ লাখ মানুষ ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত

ঢাকা:  বাংলাদেশে প্রায় চার কোটি ৫০ লাখ মানুষ ফ্যাটি লিভারে ভুগছেন বলে বলে জানিয়েছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং গবেষকরা।

বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপার-স্পেশালাইজড হাসপাতালে ৮ম গ্লোবাল ফ্যাটি লিভার ডে উদযাপন উপলক্ষে হেপাটোলজি সোসাইটি ‘কম খাই হাঁটি বেশি, ফ্যাটি লিভার দূরে রাখি’ শীর্ষক জনসচেতনতামূলক আলোচনা অনুষ্ঠানে এ কথা জানানো হয়।

চলতি বছরের প্রতিপাদ্য ‘অ্যাক্ট নাউ, স্ক্রিন টুডে’।

অনুষ্ঠানে বলা হয়, লিভার রোগজনিত মৃত্যু বিশ্বব্যাপী মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসাবে পরিগণিত। লিভার সিরোসিস ও ক্যানসারের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে লিভারে চর্বি জমাজনিত প্রদাহ। চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলে স্টিয়াটো-হেপাটাইটিস। অতিরিক্ত চর্বি জমা হওয়ার কারণে যকৃতে যে প্রদাহ সৃষ্টি হয় তাকেই স্টিয়াটো-হেপাটাইটিস বলা হয়। ফ্যাটি লিভারের বিপদজনক পরিণতি হচ্ছে ন্যাশ (এনএএসএইচ)। নির্ণয়হীন ও নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় ফ্যাটি লিভার বিপজ্জনকভাবে ন্যাশের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।

লিভারে প্রদাহ সৃস্টি করা ছাড়াও যকৃতে চর্বি জমার আরও বেশ কিছু খারাপ দিক রয়েছে। এ রোগটি হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং শরীরে ইনসুলিন হরমোনের কার্যকারিতা কমে যাওয়ার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। সারা বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশেও এ রোগের প্রাদুর্ভাব আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ও হেপাটোলজি সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলমের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা ও ফেলো বাংলাদেশ একাডেমি অব সাইন্স মেজর জেনারেল অধ্যাপক ডা.এ এস এম মতিউর রহমান (অব.) এবং প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বারডেম হাসপাতালের লিভার বিশেষজ্ঞ ডা. মো. গোলাম আযম।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত দেশবরেণ্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক-পুষ্টিবিদ-বিজ্ঞানীরা সবাইকে সতর্ক করেন যে, ফ্যাটি লিভার বিশ্বব্যাপী একটি উদ্বেগজনক জনস্বাস্থ্য সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এমনকি দীর্ঘমেয়াদি লিভার প্রদাহের কারণ হিসেবে ভাইরাসকে অতিক্রম করে ইদানীং ফ্যাটি লিভার প্রাধান্য বিস্তার করছে।

তারা জানান, বাংলাদেশে প্রতি তিনজনে একজনের ফ্যাটি লিভার আছে। প্রায় চার কোটি ৫০ লাখ মানুষ ফ্যাটি লিভারে ভুগছেন এবং এর মধ্যে প্রায় এক কোটি মানুষ সিরোসিস বা লিভার ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকিতে আছে, অথচ প্রায় ক্ষেত্রে শুধুমাত্র খাদ্যাভ্যাস, হাঁটার অভ্যাস ও জীবনযাত্রার ধরন পরিবর্তন এবং ওজন কমানোর মাধ্যমে ফ্যাটি লিভার ও ন্যাশ প্রতিরোধ করা যায়।

অনুষ্ঠানে বলা হয়, সাম্প্রতিক কালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা কার্বোহাইড্রেটসমৃদ্ধ খাবার বিশেষত ভাত বেশি গ্রহণ করছে এবং সেই তুলনায় শারীরিক পরিশ্রম বা হাঁটা-চলাফেরা কম করছে, তাদের ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা সবচাইতে বেশি। বাইরের খাবার গ্রহণ, দিনে পাঁচ ঘণ্টার বেশি যাদের বসে থাকতে হয় এবং একই সঙ্গে কায়িক পরিশ্রম কম তাদের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। আলোচকরা খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী খাদ্য তৈরি করতে বাধ্য করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক ডা. এ এস এম মতিউর রহমান (অব.) বলেন, ফ্যাটি লিভারকে মাল্টি ডিসিপ্লিনারি এপ্রোচ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে মাল্টি সেক্টরকে যুক্ত করে সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করতে হবে। এ রোগ প্রতিরোধে জাতীয় পর্যায়ে বিশেষ করে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে যেমন কাজ করতে হবে একই সঙ্গে কমিউনিটিকেও যুক্ত করে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি নিতে হবে। ফ্যাটি লিভার প্রতিরোধে শৈশবকালীন থেকেই সবাইকে সচেতন হতে হবে।

সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম বলেন, ফ্যাটি লিভার প্রতিরোধই প্রধান চিকিৎসা। মাত্র একটি পরীক্ষা করেই এ রোগ চিহ্নিত করা সম্ভব। ফ্যাটি লিভারের ধরন অনুযায়ী রোগীদের স্বার্থে বিজ্ঞান সম্মতভাবে চিকিৎসা দিতে হবে। রোগটি প্রতিরোধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ধর্ম মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, এলজিইডিসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করে সম্মিলিতভাবে কাজ করে যেতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশে ফ্যাটিলিভার রোগ প্রতিরোধে কর্মপন্থা নির্ধারণে যে সুপারিশ তুলে ধরেন সেগুলো হলো, প্রত্যেক ব্যক্তির সপ্তাহে অন্তত পাঁচদিন এবং প্রতিদিন অন্তত ত্রিশ মিনিট করে হাঁটতে হবে। দড়ি লাফ এবং সাইকেল চালানো শরীরচর্চার জন্য ভালো। দুধ, ফল, শাক-সবজি খাওয়া বাড়ানো এবং চিনিযুক্ত খাবার, কোমল পানীয়, চকলেট, আইসক্রিম, ফাস্ট ফুড এবং (ভাজা খাবার) ট্রান্স-ফ্যাটের পরিমাণ কমানোর মাধ্যমে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করে ক্যালরি গ্রহণ কমাতে হবে। শরীরচর্চা বাড়ানো যায় এ রকম পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

দেশের প্রতিটি স্কুল এবং প্রশাসনিক ওয়ার্ডে খেলার মাঠ রাখা বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং প্রতিটি শিশুকে খেলতে এবং অন্যান্য শারীরিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের জন্য অনুপ্রাণিত করতে হবে। মেইন রোডের পাশে বাইসাইকেল চালানো এবং হাঁটার জন্য আলাদা লেন তৈরি করা, যা স্বাস্থ্য এবং অর্থনীতি উভয়ের জন্য উপকারী হবে।

গণ সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অধিক স্যাচুরেটেড ফ্যাট, চিনি এবং লবণযুক্ত জাঙ্কফুড এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার পরিহার করতে উৎসাহিত করতে হবে। প্রক্রিয়াজাত খাবারের পুষ্টিমান সঠিক রাখার জন্য (উদাহরণ স্বরূপ, ট্রান্স ফ্যাট, স্যাচুরেটেড ফ্যাট, চিনি এবং লবণ পরিহার) খাদ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইনের অধীনে আনতে হবে।

সফট ড্রিঙ্কের পরিবর্তে ফ্রেস ফলের জুস এবং পানি পানকে উৎসাহিত করতে হবে। ছোট-বড় সবার জন্য পার্ক, খেলার মাঠ, স্কুল এবং কর্মস্থলে পরিষ্কার পানির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রক্রিয়াজাত খাবারের ক্ষেত্রে প্যাকেটের গায়ে পুষ্টিমান এবং শক্তিমান (ক্যালরি) উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক করতে হবে।

সব চিকিৎসককে ফ্যাটি লিভার সংক্রান্ত পর্যাপ্ত জ্ঞান দিতে হবে, এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠির দিকে খেয়াল রাখতে হবে যাতে তারা ন্যাশের ঝুঁকিতে না পড়ে। ব্যবহার ও প্রয়োগ কমানোর জন্য ( ফ্যাট টেক্স) ‘চর্বি বা চিনি কর’ ধার্য করার চিন্তা করা যেতে পারে।

আরকেআর/জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।