ঢাকা: সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয় আর শত শত লোকবল নিয়োগের পরও রোগ পরীক্ষার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগী ও তাদের স্বজনদের দালালদের কাছে খুঁজতে হয় আশ্রয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হাসপাতালের ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি আর অনিয়মই এজন্য দায়ী।
কখনো স্বাভাবিক যান্ত্রিক ত্রুটি, আবার কখনো বা অদৃশ্য হাতের ইশারায় নষ্ট হয় এখানকার প্যাথলজিক্যাল যন্ত্রপাতি। কোনো যন্ত্র একবার নষ্ট হলেই আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় বিকল থাকে দিনের পর দিন। অদ্ভুত কারণে জরুরি অনেক টেস্টই সকালে হয় তো, বিকেলে আর হয় না। অথচ এ হাসপাতালে অপারেশন কিন্তু ২৪ ঘণ্টাই হয়ে থাকে।
হাসপাতালের সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিচালকসহ অনেকেই এ নিয়ে হতাশ। সমস্যা সমাধানে শিগগিরই এ নিয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নেবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
মোস্তফা কামাল। গত ২৬ জুন জরুরি অপারেশনের জন্য ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেলে। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক জানান, সন্ধ্যায় অপারেশন হবে। পাশাপাশি তাকে সিবিসি, র্যানডম ব্লাড সুগার, হেপাটাইটিস বি ও হেপাটাইটিস সি পরীক্ষা করার কথা বলেন।
পরীক্ষার জন্য ঢাকা মেডিকেলের নতুন ভবনের প্যাথলজি বিভাগে গিয়ে জানা যায়, বেলা ১২ টার পর কাউন্টার বন্ধ হয়ে গেছে, এখন টেস্ট হবে না। পরে অনুরোধ করলে শুধু সিবিসি টেস্টটি করার জন্য তারা রক্ত নেয়। বাকি টেস্টগুলো পরের দিন সকাল ছাড়া করা সম্ভব নয় বলে সাফ জানিয়ে দেয়া হয়।
অথচ সন্ধ্যায় অপারেশন। সমাধানের কোনো পথ না পেয়ে হতাশ রোগী ও তার স্বজনরা। সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের কাছে গিয়ে বিষয়টি জানানো হলে, তিনি হতাশা ও দুঃখ প্রকাশ করেন। পরে উপায়ান্তর না দেখে চিকিৎসক দালালের মাধ্যমে পরীক্ষাগুলো করিয়ে আনার পরামর্শ দেন।
মজার বিষয় হলো, রোগী বা তার স্বজনদের দালালকে খুঁজে বের করতে হয়নি। যেমনটি খুঁজতে হয় হাসপাতালের নার্স বা সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের। দালাল সব সময় রোগীর বিছানার পাশেই ওঁত পেতে থাকে, শিকার ধরার জন্য। শুধু ওয়ার্ড নয়, হাসপাতালের সব রোগীর ঘাড়েই নিশ্বাস ফেলছে এই দালালরা।
বাধ্য হয়ে রোগীর স্বজনরা দালাল ‘দি প্যাথলজি সেন্টার’-এর মার্কেটিং ম্যানেজার জুবেল আহমেদের মাধ্যমে র্যানডম ব্লাড সুগার, হেপাটাইটিস বি ও হেপাটাইটিস সি-- এই টেস্ট তিনটি করানোর ব্যবস্থা করেন। এই টেস্টগুলোর জন্য ২ হাজার টাকা লাগবে বলে জানায় দালাল। পরে কিছু কম রাখার অনুরোধ করলে, করুণা ভিক্ষার মতো ১০০ টাকা কম ১ হাজার ৯ শত টাকা রাখেন। যেখানে হাসপাতালে এই তিনটি পরীক্ষা করালে খরচ হতো মাত্র ৫০০ টাকা।
এখানে ‘সুখবর’ একটাই। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যেখানে রোগীর চরম মুহূর্ত্বে পাশে না দাঁড়ালেও দালাল জুবেল আহমেদ ঠিকই সন্ধ্যার মধ্যে টেস্ট রিপোর্টগুলোর প্রাপ্তি নিশ্চিত করে রোগীর জরুরি অপারেশনে সহায়তা করে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাসপাতালের বায়োকেমিস্ট্রি-সংশ্লিষ্ট মেশিনটি অকেজো পড়ে আছে এক মাস ধরে। অন্যদিকে ইলেকট্রোলাইটিক সংশ্লিষ্ট পরীক্ষার যন্ত্রটিও বিকল ১ মাস ১০দিন। একই দশা একটি ইএসআর পরীক্ষার যন্ত্রেরও। এহেন সংকটে সীমিত হয়ে আছে রোগীদের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা কার্যক্রম। বিশেষ করে বিকেলে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ টেস্ট বন্ধ। ফলে বাধ্য হয়েই রোগী ও স্বজনদের সমাধান খুঁজতে হয় দালালদের কাছেই। শুধু যন্ত্র নষ্ট বলেই নয়, ঢাকা মেডিকেলে দালালদের দৌরাত্ম্য সব সময়।
এই যন্ত্রগুলো দীর্ঘদিনের পুরোনো বলেই নষ্ট হয়েছে বলে বাংলানিউজ জানতে পেরেছে।
তবে হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ‘নষ্ট হওয়া’র পিছনে কোনো অসাধু চক্রের হাত থাকতে পারে বলে মনে করেন প্রকাশ করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘বাইরের প্যাথলজি সেন্টারগুলোকে সুযোগ করে দিতেই কর্মচারীদের দ্বারা হাসপাতালের যন্ত্র নষ্ট করা হলেও হতে পারে। ’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা মেডিকেলে অবাধে বিচরণরত দালালরা রোগী ও তাদের স্বজনদের প্রতারিত করার সবচেয়ে বেশি সুযোগ নেয় বিভিন্ন প্যাথলজিক্যাল টেস্টের প্রয়োজন পড়লে। রোগীদের তথ্যের অভাব, দালাল ও তাদের এজেন্ট বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারীদের দ্বারা রোগীদের প্রভাবিত করা কিংবা দ্রুত ও সহজে টেস্ট রিপোর্ট পাওয়ার আশায় দালালদের হাতে প্রতিনিয়ত জিম্মি হন রোগী ও স্বজনরা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল প্যাথলজি বিভাগের ইনচার্জ ডা. ইয়াসমিন সাত্তার বাংলানিউজকে বলেন, ‘এখানে মর্নিং ও ইভেনিং শিফটে পরীক্ষাগুলো হয়ে থাকে। সকালে সব ধরনের পরীক্ষা চলছে। তবে দুটি মেশিন নষ্ট থাকায় সন্ধ্যায় কিছু পরীক্ষা আপাতত হচ্ছে না।
হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘এ যন্ত্রগুলো যদি দ্রুত মেরামত করা সম্ভব হতো তবে রোগীদের দুর্ভোগ কমতো। পাশাপাশি নতুন যন্ত্র পেলে আমরা আমাদের সক্ষমতাও বাড়াতে পারতাম। এটা হলে তা আমাদের জন্য যেমন সুবিধার, তেমনি রোগীদের জন্যও লাভজনক সাশ্রয়ী হতো। ’
দালাল আর যন্ত্রপাতিগুলো দীর্ঘদিন নষ্ট থাকায় হাসপাতালের সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ মিজানুর রহমানও বাংলানিউজের কাছে হতাশা প্রকাশ করেন।
হাসপাতালের নষ্ট যন্ত্রপাতি মেরামতে দীর্ঘ আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমরা চাইলেও খুব তাড়াতাড়ি নষ্ট যন্ত্রপাতি সারাতে পারি না। আমাদের যে ফান্ড আছে তা দিয়ে এসব যন্ত্র মেরামত করা সম্ভব হলেও কিন্তু সেটা করার অনুমতি নেই। এসব যন্ত্রপাতি ঠিক করাতে ‘নিমো’ থেকে অনুমতি নিতে হয়। ’
ভবিষ্যতে আর বাইরে থেকে করা টেস্টের রিপোর্ট গ্রহণ করা হবে না –এমন পরিকল্পনার কথা জানিয়ে মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেল থাকতে লোকজন কেন বাইরে থেকে টেস্ট করাবে! আমরা ধারাবাহিকভাবে সক্ষমতা আরো বাড়াবে। ভবিষ্যতে বাইরের টেস্ট রিপোর্ট গ্রহণ না করার ব্যবস্থা নেবো। ’
দালাল নিমূর্লের পরিকল্পনা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘সবাইকে ড্রেস কোড মেনে চলতে হবে। সবার জন্য আইডি কার্ড নিশ্চিত করা হবে। যারা রোগীর সঙ্গে আসবেন তাদের দর্শনার্থী কার্ড থাকবে। তখন আমরা বাইরের কাউকে পেলে চ্যালেঞ্জ করবো। এজন্য আমাদের নিয়মিত ভিজিল্যান্স টিম থাকবে। প্রয়োজনে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা নেবো। ’
‘দ্রুতই অবস্থার পরিবর্তন হবে’--এই আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমাকে একটু সময় দিন। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। একে একে সব সমস্যার সমাধান করা হবে। ’
বাংলাদেশ সময়: ০৭৪৯ ঘন্টা, জুলাই ০৭, ২০১৫
সম্পাদনা: জেএম