ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

একাকিত্বের ভয়ে যক্ষ্মা রোগ গোপন করছেন আক্রান্তরা

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪১ ঘণ্টা, মার্চ ২৪, ২০১৭
একাকিত্বের ভয়ে যক্ষ্মা রোগ গোপন করছেন আক্রান্তরা রাজশাহী বক্ষব্যাধি হাসপাতাল;ছবি-বাংলানিউজ

রাজশাহী: পরিবার ও সমাজ থেকে একা হওয়ার ভয়ে রোগ গোপন করছেন নতুনভাবে যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগীরা। জনবিচ্ছিন্ন জীবন-যাপন এড়াতে গিয়ে আক্রান্তদের অনেকেই উপযুক্ত চিকিৎসা অভাবে নীরবেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। অথচ সঠিক সময়ে যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত করা গেলে নিয়মিত চিকিৎসায় এটি সম্পূর্ণভাবে সারিয়ে তোলা সম্ভব। সরকারই এর চিকিৎসা ভার বহন করে।

বাংলাদেশের যক্ষ্মা পরিস্থিতি নিয়ে ২০১৬ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই পর্যবেক্ষণের কথা তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে বাংলাদেশে প্রতি বছর তিন লাখ ৬২ হাজার মানুষ নতুনভাবে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন।

আর ৭৩ হাজারেরও বেশি রোগী মারা যান।

তবে ডটস পদ্ধতির সফলতার কারণে বাংলাদেশে যক্ষ্মা এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে ডটস কর্মসূচির আওতায় সরাসরি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে স্বল্প মেয়াদে যক্ষ্মা রোগীকে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত রোগীরা অনেক বেশি সুফল ভোগ করতে পারছেন।

২০১৬ সালে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওই প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে রাজশাহী বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. আশিষ কুমার সাহা বলেন, সারাদেশে সরকারিভাবে ৮শ’ ৫০টি ডটস (ডাইরেক্ট অবজার্ভড ট্রিটমেন্ট, শর্ট কোর্স) সেন্টার রয়েছে।

সেন্টারগুলোতে প্রত্যেক রোগীর জন্য প্রায় ৩২ হাজার টাকা খরচ হয়। বাংলাদেশে যক্ষ্মার প্রার্দুভাব ও মৃত্যুহার ২০১৫ সালের মধ্যে অর্ধেকে নামিয়ে আনাই এ কর্মসূচির লক্ষ্য ছিল। জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির উদ্দেশ্য ছিল ২০১৫ সালের মধ্যে শতকরা ৮৫ ভাগ নতুন যক্ষ্মা আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তোলা। সেখানে এর অর্জন ছিল ৯৫ শতাংশ।

তিনি উল্লেখ করে বলেন, কুসংস্কারের কারণে এখনও পরিবার ও সমাজে যক্ষ্মা রোগীদের আলাদা করে রাখা হয়। যা আক্রান্ত রোগী মানসিকভাবে মেনে নিতে পারেন না। চিকিৎসা করতে গেলে সবাই বিষয়টি জেনে যাবে এই ভয়ে আক্রান্ত অনেকে কফ পরীক্ষা বা চিকিৎসা করাতে চান না। এজন্য ২০১৬ সালে তারা আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ৬১ শতাংশ যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত করতে পেরেছেন। মানুষের মধ্যে সচেতনতা না বাড়লে এই শনাক্তের হার শতভাগে উন্নীত করা যাবে না। মৃত্যুর হারও শূন্যে নামানো যাবে না।     

তিনি বলেন, যক্ষ্মা হলে রক্ষা নাই, এই কথার ভিত্তি নাই। ঠিক সময়ে যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হলে নিয়মিত চিকিৎসায় এটি পুরোপুরিভাবে নিরাময় বা ভালো হয়। সরকারি খরচেই এর চিকিৎসা করা হয়। তাই এজন্য সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো দরকার বলেও মন্তব্য করেন স্বাস্থ্য পরিচালক।

এদিকে, শুক্রবার (২৪ মার্চ) সরেজমিনে রাজশাহী বক্ষব্যাধি হাসপাতালে গিয়েও দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। সাধারণত অন্য সব হাসপাতালগুলো রোগীতে ঠাসা। বেড না পেয়ে সবাই হাসপাতালের মেঝেতে ও বারান্দায় গাদাগাদি করে চিকিৎসা নিচ্ছেন। অথচ যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত এই হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা কম। ১শ’৫০ শয্যা বিশিষ্ট এই হাসপাতালটির অনেকাংশই ছিল ফাঁকা।

অথচ যক্ষ্মা রোগের জন্য সেখানে সব ধরণের ইনডোর সেবার পাশাপাশি আউটডোর চিকিৎসার সু-ব্যবস্থা রয়েছে। রোগ শনাক্তকরণের সর্বাধুনিক জিন এক্সপার্ট মেশিন, ডিজিটাল এক্স-রে মেশিনসহ সব ধরনের প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষারও যন্ত্রপাতি রয়েছে। ১০ জন চিকিৎসক, ১শ’ জন নার্সসহ পর্যাপ্ত জনবলও রয়েছে এ হাসপাতালে। কিন্তু রোগীর সংখ্যা কম। এখনও লোকলজ্জায় সেখানে যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা চিকিৎসা করাতে আগ্রহী নন। যারা আছেন নিবিড় পর্যবেক্ষণে তাদের চিকিৎসা চলছে।

রাজশাহী বক্ষব্যাধি হাসপাতালের সুপারিনটেন্ডেন্ট ডা. আমীর হোসেন বলেন, কেবল রাজশাহী শহর-গ্রাম বিভাগ বা উত্তরাঞ্চলই নয় আশপাশের প্রায় ২৩টি জেলার সাধারণ ও জটিল যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালটিই একমাত্র ভরসাস্থল। কিন্তু অসচেতন ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন অনেক মানুষ এখনও হাসপাতালে সেবা নিতে চান না। কার্যদিবসগুলোতেও আউটডোরে তেমন একটা রোগীকে বসে থাকতে দেখা যায় না।

ডা. আমীর হোসেন বলেন, ২০১৬ সালে রাজশাহী বিভাগে মাত্র ১১ হাজার ৪শ’ ২৮জন নতুন যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত করা গেছে। ২০১৫ সালের তুলনায় তা ৪শ’ ১২ জন বেশি। তবে এর পরও সমাজের একটি বড় সংখ্যার মানুষ শনাক্তের বাইরে রয়েছে। আর সঠিক সময়ে রোগ শনাক্ত না হলে তার চিকিৎসা দেওয়াও যায় না। তাই যক্ষ্মা নয় আক্রান্ত অনেক ব্যক্তি কেবল অসচেতনতার কারণেই মৃত্যুবরণ করেন।   

তিনি উল্লেখ করে বলেন, যক্ষ্মা সংক্রামক রোগ। যা আক্রান্ত রোগীর শ্বাস ও হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়ায়। এজন্য বুকে ব্যথার সঙ্গে তিন সপ্তাহেরও বেশি কাশি থাকলে তাকে অবশ্যই কফ পরীক্ষা করাতে হবে। রোগের লক্ষণ দেখা মাত্র বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা নিতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা হাসপাতাল, সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

প্রসঙ্গত, শুক্রবার (২৪ মার্চ) সকাল থেকে রাজশাহীসব বিভিন্ন স্থানে বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস পালন করা হচ্ছে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘ঐক্যবদ্ধ হলে সবে, যক্ষ্মা মুক্ত দেশ হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬১৮ ঘণ্টা, মার্চ ২৪, ২০১৭
এসএস/আরআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।