এসময় বাঙালি হিন্দুরা যেমন তিনদিনের দুর্গাপূজায় মেতে ওঠে ঠিক তেমনি অবাঙালিরা নয়দিনের বিশেষ দুর্গাপূজা করে থাকে। যাকে বলা হয়, নবরাত্রি।
অন্যদিকে, মহালয়ার দিনই হয় দেবীর চক্ষুদান। অর্থাৎ শিল্পীর তুলির টানে জেগে ওঠে প্রতিমার ত্রিনয়ন। বলা যায়, দুর্গাপূজার সূচনাই হয় এই চক্ষুদানের মাধ্যমে। রামায়ণের বিবরণ অনুযায়ী রাবণ বসন্তকালে দেবী দুর্গার পূজা শুরু করেন। সে কারণেই এই পূজার নাম হয় বাসন্তী পূজা। কিন্তু শ্রীরামচন্দ্র রাবণের সঙ্গে যুদ্ধে অংশগ্রহণের আগে শরৎকালে দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। আর অসময়ে করা, শ্রীরামচন্দ্রের এই পূজাকে বলা হয় অকালবোধন। তারপর থেকে বাঙালিরা যুগ যুগ ধরে এই সময়েই পূজা করে আসছেন। যা পরিচিতি পায় শারদীয়া দুর্গাপূজা হিসেবে।
বারোয়ারি পূজা শুরুর আগে এই পূজা এক সময় শুধু রাজবাড়ি বা জমিদার বাড়িতে হতো। সেখানে বৈশাখ মাসে প্রতিমার কাঠামো গড়ে, সেই কাঠামো পূজা হতো জন্মাষ্টমীর দিনে। রীতি অনুসারে মহাসপ্তমীর দিন নবপত্রিকা প্রবেশের পর সকালে হতো প্রতিমার চক্ষুদান পর্ব। কিন্তু দেবীপক্ষের শুরু হয় মহালয়ার দিনে। তাই আগেকার দিনে অনেক জমিদার বাড়িতে এই দিনটিকেই শুভ মেনে দেবী প্রতিমার চক্ষু আঁকা হতো এদিনই। তবে ধর্ম মতে প্রতিমায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা হতো মহাসপ্তমীতে।
একজন শিল্পী এবং পুরোহিতের চোখে এই চক্ষুদান কতখানি গুরুত্বপূর্ণ, হিন্দুশাস্ত্র মতে এর ব্যাখ্যা কী, উপাচারেই বা কী কী লাগে-এসব নিয়ে রামকৃষ্ণ সারদা মঠের পূজারি রবিশঙ্কর ঘোষালকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, দুর্গাপূজায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আচার হলো চক্ষুদান। সপ্তমীর সকালে শুদ্ধাচারে ডান হাতে কুশের অগ্রভাগ নিয়ে দেবীকে কাজল পরানো হয়। প্রথমে ত্রিনয়ন বা ঊর্ধ্বনয়ন, তারপর বাম চক্ষু এবং শেষে ডান চক্ষু মন্ত্রোচ্চারণের মধ্য দিয়ে অঙ্কন করা হয়। এই চক্ষুদানের পরই প্রতিমায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। পর্দায় ঢাকা ঘেরাটোপে পূজারি এবং তান্ত্রিকদের উপস্থিতিতে লেলিহান মুদ্রায় মোট ১০৮ বার বীজমন্ত্র জপ করা হয়। এই রীতির ফলেই মৃন্ময়ী থেকে চিন্ময়ী রূপে প্রতিষ্ঠিত হন দেবী। হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী এর অর্থ, মাটির প্রতিমা থেকে রক্তমাংসের শরীরে পরিণত হলেন দেবী-এমনই মনে করা হয়। প্রাণ প্রতিষ্ঠা শুধু দেবী দুর্গারই করা হয়, তা কিন্তু নয়। প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয় লক্ষ্মী, গণেশ, সরস্বতী, কার্তিক এবং তাদের বাহনদেরও। এমনকি বাদ যায় না অসুরও। প্রত্যেকের জন্যই রয়েছে আলাদা আলাদা মন্ত্র এবং উপাচার।
চক্ষুদান সম্পর্কে কালীঘাটের পটুয়া পাড়ার প্রতিমা শিল্পী সনাতন পাল বলেন, বহুদিন ধরেই দেখে আসছি, মহালয়ার দিন ভোরবেলা স্নান করে শুদ্ধ কাপড়ে দেবীর চক্ষুদান করা হয়। আমিও সেই মতোই করে আসছি। এইদিন কাকভোরে রেডিওতে মহালয়া পাঠ, তর্পণ, দেবীপক্ষের শুরু। সব মিলিয়ে এক অনন্য আবহের সৃষ্টি হয়। এটা একটা নস্টালজিক বিষয়। তবে আমার কাছে এর কোনও শাস্ত্রগত ব্যাখ্যা জানা নেই।
আরেক শিল্পী বিশ্বনাথ দিন্দা বলেন, একটা সময় ছিলো যখন আট-দশটা প্রতিমা তৈরি হতো। এখন সেই প্রতিমা তৈরি হয় ত্রিশ থেকে চল্লিশটা। সে কারণে নিয়ম মেনে মহালয়ের দিন চক্ষুদান করা সম্ভব হয় না। অনেক আগে থেকে তুলি ধরতে হয়।
অন্যদিকে, এবার দেবীর চক্ষুদানের দিন অভিনব উদ্যোগ নিয়েছে কালীঘাটের শ্রীসঙ্ঘ ক্লাব। সেক্রেটারি যতনকুমার গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, চোখ মানুষের কাছে অমূল্য সম্পদ। এই বার্তা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাই। তাই আমরা বেছে নিয়েছি মহালয়ার দিন দেবীর চক্ষুদানের সময়। এদিন কোনও সেলিব্রিটি নয়, বরং অন্ধ শিশুদের হাতেই চোখের আদলে তৈরি হওয়া মণ্ডপের উদ্বোধন করা হবে। পাশাপাশি মৃত্যুর পর যাতে সবাই নিজেদের চোখ আই হসপিটালে দান করেন এই সচেতনতার বার্তাও ছড়িয়ে দিতে চাই। সেজন্যই মণ্ডপে আগত সমস্ত দর্শনার্থীর হাতে একটি লিফলেট দেওয়া হবে যাতে থাকবে একাধিক আই হসপিটালের ঠিকানা। যদি একজনও এই লেখা পড়ে মৃত্যুর পর চক্ষুদানের সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে পূজায় নেওয়া আমাদের এই উদ্যোগ সফল বলে মনে করবো।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩২ ঘণ্টা, ৮ অক্টোবর ২০১৮
ভিএস/আরআর