ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প

সৈয়দপুর ঢাকার জিঞ্জিরা নাকি চীনের সাংহাই! 

মো. আমিরুজ্জামান, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৩৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৮, ২০১৬
সৈয়দপুর ঢাকার জিঞ্জিরা নাকি চীনের সাংহাই!  ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সৈয়দপুর (নীলফামারী): এখানে ঘরে ঘরে মিনি কারখানা। সেসব কারখানার ঠকঠক, টুং টাং শব্দে সকালের ঘুম ভাঙে অনেকের।

ট্রাঙ্ক, বালতি, মোমবাতি, আগরবাতি, শোকেস, ফাইল কেবিনেট, সাবান, গুল, জর্দা, প্লাষ্টিকের কৌটা কি নেই এখানকার উৎপাদিত পণ্য তালিকায়। বিস্কুট, চানাচুর, চিপস, পাঁপর তৈরি হচ্ছে। রেডিমেড ফার্নিচার, ফাউন্ড্রি কারখানাও রয়েছে। বেনারসী শাড়ি তৈরি, পোশাকে কারচুপি, চুমকি ও পাথর বসানোর কাজ চলে। আছে তৈরি পোষাকের ছোট ছোট কারখানাও।  

উত্তরের বাণিজ্যিক কেন্দ্র নীলফামারীর সৈয়দপুরের অলিগলি, পাড়া-মহল্লায় ছড়িয়ে রয়েছে এসব কারখানা। এতে দিনে-রাতে কাজ করছেন হাজার হাজার শ্রমিক।
এখানে তৈরি ট্রাঙ্ক উন্নতমানের হওয়ায় সেনাবাহিনীর জোয়ানরা শান্তি মিশনে যোগ দিতে যাওয়ার সময় বিদেশের মাটিতে নিয়ে যাচ্ছেন বলেও দাবি এর কারিগরদের।  

সৈয়দপুরে লেদ মেশিনে এমন সব ডাইস তৈরি হচ্ছে যা দেশের অন্যস্থানে করা সম্ভব নয় বলেও দাবি তাদের। এখানকার উৎপাদিত পণ্যের গুণগতমান অন্যান্য স্থানের চেয়ে অনেক ভাল বলে সুনাম রয়েছে।
সৈয়দপুরকে এ কারণে ঢাকার জিঞ্জিরার সঙ্গে, আর কেউ কেউ আরেকটু বাড়িয়ে চীনের সাংহাইয়ের সঙ্গে তুলনা করেন।

কারখানার মালিকরা জানান, তাদের উৎপাদিত পণ্য উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হচ্ছে।  দেড় লক্ষাধিক জনসংখ্যার সৈয়দপুরে এসব কারখানা নানা কারণে গড়ে উঠেছে। যার একটি ঐতিহাসিক ভিত্তিও রয়েছে।  

১৮৭০ সালে সৈয়দপুরে দেশের বৃহত্তম রেলওয়ে কারখানা প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখানে নানা কারণেই দক্ষ শ্রমিক তৈরি হতে শুরু করে। সড়ক, রেল ছাড়াও বিমানবন্দর প্রতিষ্ঠায় সৈয়দপুরের গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়।  
এভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যে সৈয়দপুর এগিয়ে যেতে থাকলে তার প্রভাব পড়ে এখানকার অর্থনীতিতে। এখানে ২৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখা খোলা হয়েছে, যা একটি বড় উন্নয়নের মাপকাঠি।  

বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা গেছে, বহু নারী-পুরুষ ও শিশু শ্রমিক চুক্তিভিত্তিতে বা দৈনিক হাজিরায় কাজ করছে। ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টিও একটি বড় অগ্রগতি। ঝুট কাপড়ে তৈরি পোষাকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গার্মেন্টস কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব পোশাক এখন যাচ্ছে ভারত, নেপাল ও ভুটানে।
শহরের বাঁশবাড়ি, সাহেবপাড়া, উত্তরা আবাসন, নতুন বাবুপাড়া, মিস্ত্রিপাড়া, মুন্সিপাড়া, পুরাতন বাবুপাড়া, হাওয়ালপাড়া, গোলাহাট, ঘোড়াঘাট, এলাকায় গড়ে ওঠা এসব কারখানা।  

সৈয়দপুর রফতানিমুখী ক্ষুদ্র গার্মেন্টস মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক মতিয়ার রহমান দুলু জানান, তারা ঢাকার মিরপুর, কালিগঞ্জ, গাজীপুর, সাভার, টঙ্গী, নারায়নগঞ্জ ও চট্টগ্রামের বড় বড় পোশাক কারখানাগুলো থেকে ঝুট কাপড় সংগ্রহ করে এসব পোশাক তৈরি করা হয়। যা দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশে রফতানি করা হচ্ছে।

শহরের গোলাহাট, নতুন বাবুপাড়াসহ বিভিন্ন অলগলিতে ৫০টির বেশি আগরবাতি ও মোমবাতির কারখানা রয়েছে। নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোররা দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে এসব কাজ করছেন। হাতে ও মেশিনে আগরবাতিতে মসলা লাগিয়ে রোদে শুকিয়ে দেওয়া হয় সৈয়দপুর থেকে। এরপর বড় বড় নামি-দামি কোম্পানিগুলো এসব আগরবাতি পছন্দমত সুগন্ধি ব্যবহার করে বাজারজাত করে।  

আগরবাতি কারখানার মালিক শওকত আলী জানান, কাঠের গুঁড়ো ও অন্যান্য উপকরণ মেশিয়ে আগরবাতি তৈরি হয়।  

বেনারসী পল্লীতে তৈরি করা হচ্ছে ৫ থেকে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকার দামের শাড়ি। আটকেপড়া পাকিস্তানিদের ২২টি ক্যাম্প ও বিভিন্ন মহল্লায় পোষাকে কারচুপির কাজ করছেন নারী-পুরুষ ও শিশু- কিশোররা। এস শাড়ি ও কারচুপির কাজ পাঠানো হচ্ছে ঢাকার বড় বড় শপিং মলে।  

বাড়িতে বসে কাঠ মিস্ত্রীরা তৈরি করছেন খাট, ড্রেসিং টেবিল, সোফা, চেয়ার, টেবিল প্রভৃতি সৌখিন আসবাবপত্র। পাইকাররা এসব কিনে নিয়ে বিভিন্ন হাটবাজারে বিক্রি করছেন। কম দামি কাঠে তৈরি এসব আসবাবপত্র সস্তায় মেলায় দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।  

শহরের সিংগীপুকুর এলাকায় কারখানাগুলোতে তৈরি করা হচ্ছে সুস্বাদু শনপাঁপড়ি ও তিলের খাঁজা। এখান থেকে হকার ও দোকানদাররা কিনে বিক্রি করেন।  বাঙালিপুর নিজপাড়ায় জুতা তৈরির চামড়ায় নকশা করছেন তিনি শতাধিক নারী। দৃষ্টিনন্দন এসব কাজ পাঠানো হচ্ছে ঢাকার জুতা ফ্যাক্টরিতে। পরে তা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতে চলে যাচ্ছে।

সৈয়দপুর শহরের ওয়াপদা গোলাহাটে  বাণিজ্যিকভাবে তৈরি হচ্ছে শুধুমাত্র দা ও কুড়াল। প্রায় ৭০ জন কামার ও শতাধিক কর্মচারি কাজ করছেন এই কারখানায়। তৈরি এসব দা ও কুড়াল পাঠানো হচ্ছে দক্ষিণের জেলাগুলোতে।  

কারখানার মালিক শাহিন হোসেন জানান, লোহা, কয়লার দাম ও মজুরি বেড়ে যাওয়ায় লাভের ভাগ কমে এসেছে। ক্রেতাদের চাহিদার কারণে কারখানাটি চালু রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি।
 
দি সৈয়দপুর বণিক সমিতির সভাপতি ইদ্রিস আলী জানান, শহরের নানা স্থানে গড়ে ওঠা মিনি কারখানাগুলো ঋণ সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বিকশিত হতে পারছে না। ব্যাংকগুলো শর্ত শিথিল করে এসব কারখানার মালিকদের ঋন সহায়তা দিলে এখানকার চিত্র পাল্টে যাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।  

রেলের স্থান দখল করে এসব কারখানা গড়ে ওঠায় ঋণ মিলছে না বলে জানিয়েছেন অনেকেই।  

সৈয়দপুরের সচেতন মানুষ মনে করেন, এখানে নেতৃত্বের অভাবে মিনি কারখানাগুলো বিকশিত হতে পারছে না। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জায়গা বরাদ্দের পাশাপাশি ব্যাংকগুলো সহজ শর্তে ঋন দিলে মিনি কারখানাগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। যাতে শত শত লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।  এতে করে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক দৃশ্যপট পাল্টে যাবে বলে মনে করেন তারা।  

বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৮, ২০১৬
এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।