ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তথ্যপ্রযুক্তি

যেভাবে বাজার হারালো নকিয়া

মনোয়ারুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮১৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৫, ২০১৩
যেভাবে বাজার হারালো নকিয়া

ঢাকা: প্রযুক্তি বিশ্ব এগিয়ে গেছে আর পিছিয়ে পড়েছে নকিয়া। স্মার্টফোনের বাজারে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে নকিয়া করপোরেশন।

স্মার্টফোন বিপ্লবের এই যুগে পেরে ওঠেনি নকিয়া।

সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্তের অভাবে বিশ্বব্যাপী বাজার হারিয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। আর বাংলাদেশে সার্ভিসিংয়ের নিম্নমান, দীর্ঘসূত্রীতা বাংলাদেশের বাজার হারানোকে ত্বরান্বিত করেছে।

কয়েক বছর বাংলাদেশে একচেটিয়া ব্যবসা করা নকিয়া মোবাইল ফোনসেট এখন আর চলে না। নানা প্রচারণা চালিয়েও ব্যর্থ হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। ফিনল্যান্ডের নকিয়া করপোরেশন বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় জমজমাট ব্যবসা করলেও এখন গ্রাহকদের প্রত্যাশিত সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। নকিয়ার বাজার দখল করেছে নতুন নতুন ব্রান্ড।

এখন বিশ্বব্যাপী স্মার্টফোনের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। সাধারণ বা বেসিক সেট ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে জাদুঘরে চলে যাচ্ছে। কারণ স্মার্টফোনগুলোর আকর্ষণীয় সব ফিচার, ইন্টারনেট সুবিধা, ভালো মানের ছবি স্মার্টফোনকে জনপ্রিয় করেছে। একজন মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী কোনো সেটের রিপ্লেস করতে স্মার্টফোনের কথাই ভাবেন সবার আগে। আর সেই স্মার্টফোনের বাজারে নকিয়ার কোনো ভালো অবস্থান নেই। নকিয়া ব্যবসা করেছে মূলত বেসিক সেট ও মাল্টিমিডিয়া সেট নিয়ে।

বাংলাদেশে নকিয়া সেট কেনার পর সার্ভিসিংয়ের সমস্যা পোহাতে হয় গ্রাহকদের। একসময় নামমাত্র কিছু সার্ভিস সেন্টার থাকলেও সেখানে গ্রাহকরা সন্তোষজনক সেবা পায়নি। প্রায় সবার অভিযোগ নকিয়া সার্ভিসিং সেন্টারে গেলে একমাসের আগে সেট হাতে পাওয়া যায় না।

বাংলাদেশে নকিয়া যখন খুব বেশি জনপ্রিয় ছিলো সেসব সেট ছিলো ফিনল্যান্ড ও হাঙ্গেরিতে তৈরি। পরে মেড বাই নকিয়া লিখে চায়না সেট বাজারজাত করা শুরু করে নকিয়া। নকিয়ার চীনের ফ্যাক্টরিতে তৈরি মোবাইলগুলোতে মেইড ইন চায়না লেখা থাকে। চায়না সেট নিম্নমানের হয় এ ধারণা বাংলাদেশে বদ্ধমূল। ফলে গ্রাহকরা নকিয়ার মান নিয়ে আস্থা হারায়।

কয়েক বছর আগেও বাজারে নকিয়া ফোনের চাহিদা ছিলো সবচেয়ে বেশি। তখন নকিয়ার থেকে বেশি ফিচার নিয়ে অনেক সেট কমদামে বাজার দখল করতে থাকে। আর নকিয়া দাম না কমিয়ে বেসিক ও মাল্টিমিডিয়া সেটের বাজারজাত করতে থাকে। আর এখন ফোনসেটের বারবার দাম কমানো সত্ত্বেও কোনো সাড়া পাচ্ছে না নকিয়া। বাংলাদেশের এক নম্বর মোবাইল সেটের ব্রান্ড থেকে নকিয়ার পতন এখনো চলছে। নকিয়ার বাজার দখল করে নিচ্ছে একাধিক ব্রান্ড ও কোম্পানি।

স্মার্টফোনে পতন
স্মার্টফোনের বাজারে যখন অ্যাপলের রাজত্ব তখন দ্বিতীয় অবস্থানও ধরে রাখতে পারেনি বিশ্বের শীর্ষ মোবাইল ফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নকিয়া। উপরন্তু গত বছরের লোকসান পুষিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি উদীয়মান বাজারে উৎপাদন স্থানান্তর করতে কর্মী ছাঁটাই করে প্রতিষ্ঠানটি। এরপর স্যামসাংয়ের স্মার্টফোনের জনপ্রিয়তার ধারেকাছেও যেতে পারেনি নকিয়া। মার্টফোনের তীব্র প্রতিযোগিতায় নকিয়া লুমিয়া ছেড়েও বাজার ধরতে পারেনি, তখন খ্যাতির চূড়ায় স্যামসাং ও অ্যাপলের আইফোন।

স্মার্টফোনের বাজারে নকিয়া দাঁড়াতেই পারেনি। বিশ্বজুড়ে বারবার হাজার হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের কারণে প্রতিষ্ঠানটির প্রতি মানুষের আস্থায় চিড় ধরে। কর্মীদের মনোবল ভেঙে যায়। এর ফলে নকিয়া করপোরেশন এখন একটি অস্তগামী সূর্যের মতো ব্রান্ডনেম।

সম্প্রতি বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইডিসির এক জরিপে জানানো হয়, প্রস্তুতকারক দেশ ফিনল্যান্ডের বাজারেও সেলফোন বিক্রিতে পিছিয়ে পড়েছে নকিয়া। অপারেটিং সিস্টেম হিসেবে সিমবিয়ান চালু করে আবার সে অবস্থান থেকে সরে আসে নকিয়া। সিম্বিয়ান, লিনাক্স বেসড মায়েমো, উইন্ডোজ কোনো সিস্টেমই অ্যান্ড্রয়েডের সঙ্গে পেরে ওঠেনি।

নকিয়া যুগের ইতি
অবশেষে সব জল্পনা-কল্পনা আর গুজবের ইতি টেনে নকিয়া যুগের অবসান হলো। ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয়ে নকিয়ার সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে গেল। চুক্তি অনুসারে নকিয়ার মোবাইল ইউনিট এখন থেকে মাইক্রোসফট বাজারে আনবে।

এক যুগেরও বেশি সময় দাপুটে আর শীর্ষ স্থানে থাকা নকিয়াকে এভাবে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হবে তা কল্পনাও করেনি ব্যবসা বিশেষজ্ঞরা। আইফোন আর অ্যানড্রইড ঘরানার স্মার্টফোনের তোড়ে একেবারেই বেসামাল হয়ে পড়ে নকিয়া। ফিনল্যান্ডভিত্তিক এ সুপরিচিত প্রতিষ্ঠান ২০০৬ সালের পর থেকেই অ্যাপল, স্যামসাং এবং সম্ভাব্য গুগলের স্মার্টফোন অপারেটিং অ্যানড্রইডের সঙ্গে বাজার প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে শুরু করে। কিন্তু এ প্রতিযোগিতায় আমলে না নেওয়ার কারণেই এমন আর্থিক পতনে সম্মুখীন হয় নকিয়া।

২০১০ সাল থেকে নকিয়া দারুণ আর্থিক প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হয়। এক সময়ের ৭২০ কোটি ডলার আয়ের প্রতিষ্ঠান পরিণত হয় ২৭২ কোটি ডলার আয়ের প্রতিষ্ঠানে। ফলে আর্থিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর সবগুলো দরজা একে একে বন্ধ হয়ে যেতে থাকে।

এ মুহূর্তে আইফোন আর গুগল অ্যানড্রইডভিত্তিক ফোনগুলো বিশ্ব স্মার্টফোনের বাজারের ৯৫ ভাগই দখলে নিয়েছে। এ পরিসংখ্যান নেওয়া হয়েছে স্মার্টফোন বিশ্বের শীর্ষে থাকা যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের গ্রাহকদের কাছ থেকে।

এ মুহূর্তে উইন্ডোজ ফোনের নিয়ন্ত্রণে আছে মাত্র ১০ ভাগ বাজার। তাও আবার মেক্সিকো এবং ফ্রান্সের বাজারেই শুধু এ চাহিদা লক্ষ্য করা গেছে। আপাতত মাইক্রোসফট ‘লুমিয়া’ এবং ‘আশা’ ব্র্যান্ডনেম কিনে নিয়েছে। এ চুক্তি অনুসারে মাইক্রোসফট আগামী ১০ বছর নকিয়া ব্র্যান্ডনেম ব্যবহার করতে পারবে।

তবে চুক্তি অনুসারে নকিয়া ব্র্যান্ডনেম এখনও কোম্পানির আয়ত্বে থাকবে। এর অর্থ আগামী এক যুগ নকিয়া নিজস্ব ব্র্যান্ডনেমে কোনো হ্যান্ডসেট বাজারে আনতে পারবে না। ফলে ৩০ বছরের সফল মোবাইল ফোন ব্যবসার আপাতত ইতি টানতে হলো নকিয়াকে।

বাংলাদেশ থেকেও নকিয়া অচিরেই ব্যবস্তা গোটাতে বাধ হবে বলে মনে করছেন প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা।

বাংলাদেশ সময়: ০৮০৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৫, ২০১৩
এমআইআর/এএইচএস/বিএসকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।