ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তথ্যপ্রযুক্তি

গুগলের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার গোপনীয়তা প্রকাশ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৪০ ঘণ্টা, মে ৩, ২০১৬
গুগলের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার গোপনীয়তা প্রকাশ ছবি: সংগৃহীত

টানা ছয় বছর ধরে শতাধিক স্বনামধন্য কোম্পানির কর্মজীবীদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষস্থান অধিকার করেছে ইন্টারনেট সার্চ ইঞ্জিনের জন্য বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান গুগল। গত পাঁচ বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শতাধিক বার শীর্ষ স্বীকৃতও হয়েছে এ প্রতিষ্ঠানটি।

গুগলে কাজের পরিবেশ অসাধারণ হওয়ার কারণ কি?

গুগলের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ল্যাজলো বক লোকবল পরিচালনার উপর ‌ওয়ার্ক রুল! ইনসাইটস ফ্রম ইনসাইড গুগল দ্যাট উইল ট্রান্সফর্ম হাউ ইউ লাইভ অ্যান্ড লিড নামে  একটি বই লিখেছেন। ২০১৫ সালে হোয়ারটন পিপল এনালিটিকস কনফারেন্সে তিনি বইটি সম্পর্কে বলেন, গুগল থেকে আমরা যা শিখেছি বইটি তার একটি উন্মুক্ত উৎস যা যেকোনো কর্মক্ষেত্রকে আরও কাজের উপযোগী করে তুলতে সাহায্য করবে।

ভাইস প্রেসিডেন্ট ল্যাজলো বকের বায়োডাটা থেকে জানা যায়, তিনি বিশ্বব্যাপী গুগলের মানবসম্পদ পরিচালনা করেন। যার মধ্যে প্রলোভন, উন্নতি এবং কর্মী ধরে রাখার ক্ষেত্রগুলো বিশেষ নজরদারিতে রাখেন।

বক গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন, সাম্প্রতিক সময়ে অনেক কর্মজীবীদের কাছে কাজ একটি বিভীষিকার নাম। তারা কোনোভাবেই কাজের মধ্যে প্রশান্তি খুঁজে পান না। বক আবিষ্কার  করেন, কেউই সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা কাজ করে না। একটু হিসেব করলে দেখা যাবে, মানুষ অধিকাংশ সময় নিজেদের শখের কাজ, প্রিয়জনের সাথে সময় অতিবাহিত এবং ঘুমিয়ে দিনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করে।

যদি এসব সময় কাজের ক্ষেত্রে দেওয়া যেতো আরও ভালো ফলাফল পাওয়া সম্ভব ছিলো। যা আপনাকে উৎসাহিত করতো, আর আপনিও কাজকে ভালবাসতেন। এমনটিই জানান, ল্যাজলো বক।

মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় মানবসম্পদের বাইরের লোকজনদেরও প্রয়োজন:
ল্যাজলো বকের তথ্য অনুযায়ী, গুগলের মানবসম্পদ বিভাগ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদের মধ্যে একটি বড় পার্থক্য রয়েছে। তা হচ্ছে, গুগলের মানবসম্পদ বিভাগ তিন ভাগে বিভক্ত। তিনটি ভাগের নিয়োগ কর্তারাই এ প্রতিষ্ঠানে লোক নিয়োগের কাজে জড়িত।

এক ভাগ নিয়োগকর্তা গঠিত হয় প্রথাগত মানবসম্পদ বিভাগের লোকজনকে নিয়ে, অপর একভাগ গঠন করা হয় কৌশলী বিষেশজ্ঞ ও পরামর্শকদের নিয়ে এবং তৃতীয় ভাগ গঠিত হয় মনোবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান এমন বিভিন্ন বিষয়ের উপর দক্ষ শিক্ষাবিদদের নিয়ে।

বক জানান, তিনি পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন দলের মধ্যে প্রত্যেকেই কোনো কোনো ব্যতিক্রমী কিছু নিয়ে হাজির হন।

তিনি ও তার সহকর্মীরা কীভাবে গুগলের মূল নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন এনেছেন। এ পরিবর্তন আনতে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। একটি পরিবর্তন এমন ছিলো, একজন প্রার্থী নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে গড় সংখ্যক সাক্ষাতকার নেওয়া। ২০০৬ সালে বক যখন প্রথম লোক পরিচালনার প্রধান হন। সে সময় লোক নিয়োগ করতে ছয় থেকে নয় মাস সময় লাগতো। অদ্ভূত এই লম্বা নিয়োগ চক্র বেশ কুখ্যাতিও অর্জন করেছিলো।

বক বলেন, কাজের নিয়মের মধ্যে পরিবর্তন আনতে আমরা বেশি পরিমাণে হিসাব করেছিলাম, অনেক বেশি পরিমাণ পরীক্ষা চালিয়েছিলাম। এতে কর্মী গবেষক টোড কার্লিসলির বেশ কৃতিত্বের কথা জানান বক। টোড পরীক্ষা করে দেখেন যে, চারটি সাক্ষাতকারের মাধ্যমে একজন প্রার্থীর ৮৬ শতাংশ আত্মবিশ্বাস অনুমান করা যায়। এ পরীক্ষার পর গুগল নতুন নিয়ম করে, কোনো প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়ার আগে চার বার তার সাক্ষাতকার নেওয়া হবে।   একে ‌‘রুল অব ফোর’ নামে অভিহিত করা হয়। বক তার বইতে উল্লেখ করেন এরপরও তার অধীনে সে সময় গুগলে ৬ হাজার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৬০ হাজার কর্মী হয়। আর বিশ্বের ৪০টি দেশে ৭০টিরও বেশি অফিস চালু হয় প্রতিষ্ঠানটির।

কাদের নিয়োগ দিয়ে আসছিলো গুগল?
যাদের আধুনিক ডিগ্রি রয়েছে গুগলে তাদের পক্ষপাতিত্ব করা হতো। বক জানান, একটি ভালো প্রতিষ্ঠানের গড় মানের শিক্ষার্থীদের চেয়ে যেকোনো প্রতিষ্ঠানের শীর্ষস্থানে থাকা শিক্ষার্থী অনেক ভালো হয়, এমনকি প্রধান আইভি লিগ ইউনিভার্সিটির ৬০ থেকে ৭০ ভাগ শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও তা একই। সুতরাং এক্ষেত্রে প্রমাণিত যে নিয়োগের ক্ষেত্রে আপনাকে  আরো বিস্তৃত চিন্তার অধিকারী হতে হবে আর এটিই গুগলে করা হয়।
তিনি জানান, আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং আপনার শেখার ক্ষমতা এখানে অনেক বড় ভূমিকা পালন করে থাকে।

গুগলে কর্মক্ষমতা ব্যবস্থাপনা
কর্মরত কর্মী, ব্যবস্থাপক ও দলের মূল্য যাচাইয়ে একটি বিশ্লেষণও তুলে ধরেছিলেন ল্যাজলো বক। তিনি কম দক্ষ ব্যবস্থাপকদের আচরণ ও কাজ দেখে দক্ষ ব্যবস্থাপকদের উপর করা একটি স্টাডি বর্ণনা করেছেন। এতে তিনি বলেন, একজন ব্যবস্থাপকের কর্মক্ষমতা যাচাই করতে চাইলে তার দলের কর্মক্ষমতা যাচাই করলেই চলে। দেখতে হয় তার দলের সদস্যরা অন্য কোথাও সরে যাওয়ার চিন্তা করছে কিনা। কারণ গুগলের কর্মীরা নিয়মিতভাবে চাকরি পরিবর্তন করে। এছাড়া বাজে পার্ফরমাররা যখন দক্ষ ব্যবস্থাপকের অধীনে কাজ করেন, তখন তাদের উন্নতি হয়। অদক্ষ ব্যবস্থাপকদের ক্ষেত্রে হয় ঠিক তার উল্টোটা।

গুগলের একটি পৃথক বিভাগ রয়েছে, যেখানে কর্মী উন্নয়ন ফিডব্যাক থেকে কর্মক্ষমতা ফিডব্যাক ভিন্ন। কর্মীদের পার্ফরমেন্স যাচাই করতে এর আগে তারা দুই সপ্তাহ সময় ব্যয় করেছেন। অনেক ব্যবস্থাপক জটিলভাবে এসব কর্মীদের তর্কের জবাব দেন ও তাদের বোনাস দিয়ে দিতে সম্মত হন। অপরদিকে, আমি চাই আমাদের ব্যবস্থাপকরা কর্মীদের উন্নয়নে উম্মুক্ত থাকবেন। আমরা গুগলে পার্ফরমেন্স স্টিগমা দূর করি যেভাবে।

গুগলে ব্যবস্থাপকরাও মূল্যায়িত হন। প্রতিষ্ঠানটিতে বছরে দু’বার বার্ষিক জরিপ পরিচালনা করা হয় যার মধ্যে কর্মীরা তাদের উপরের পদের কর্মীদের বিষয়ে ফিডব্যাক দেন। এসব ফিডব্যাকের প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটির কিছু একক স্বচ্ছতা রয়েছে। যদিও বক নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, এটারও একটি সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তিনি ব্যাখ্যা করেন, যদি একজন নির্বাহী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একশোর বেশি সরাসরি অভিযোগ থাকে, তাহলে জরিপটি উন্মুক্তভাবে করা হয়। কিন্তু অল্পসংখ্যক রিপোর্ট থাকলে পরিচালিত জরিপ প্রকাশের বিষয়ে মত যাচাই করা হয়। ব্যবস্থাপকদের নিম্ন রেটিং একটি ভালো নির্ধারক।

যদি আপনার প্রতিষ্ঠানে এমন ব্যবস্থাপক থাকে যার রেটিং অনেক কম, এর মানে সে তার দলকে উন্নত করতে সবচেয়ে বেশি চেষ্টা করে আসছে। ওই ব্যবস্থাপক অবশ্যই অনেক বেশি দক্ষ, সে কর্মী ছাটাই করে, কর্মীদের ঘোরায় যে কারণে কর্মীরা তার প্রতি মনোক্ষুন্ন। তবে গুগল এটা চায় না- সবাই ভাবুক এই ব্যবস্থাপক অনেক ভয়ানক। সে সেরাদের মধ্যে একজন হতে পারে।

মানবসম্পদ পেশাদারের কথা-
বক চিহ্নিত করেছেন, দক্ষ মানবসম্পদ প্রোগ্রাম গঠনে তাকে ও তার দলের প্রতি গুগলের সমর্থন পাওয়া ছিলো প্রায় একটি ঊর্ধ্বমুখী যুদ্ধ। সেই প্রথম দিন থেকে বক পার্ফরমেন্স ম্যানেজমেন্টের জন্য লড়াই করছেন। তিনি আরও উল্লেখ করেন, গুগল একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি আর এ কারণে কিছু বিশেষ চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

তিনি জানান, আমার ভাই একজন ইঞ্জিনিয়ার, আমার বাবা একজন ইঞ্জিনিয়ার। ইঞ্জিনিয়াররা সত্যিই সমস্যা সমাধানে খুব ভাল, তারা বেশ স্মার্ট এবং সমস্যা সম্পর্কে আগে থেকেই অবগত থাকেন।

এর সাথে তিনি আরো যোগ করেন, গুগলের একটি সংস্কৃতি রয়েছে। কর্মীরা যারা ইঞ্জিনিয়ার তারা কোম্পানিকে চলতে সাহায্য করে। তাই বকের প্রাথমিক চেষ্টা হলো প্রোগ্রামগুলোকে যেমন- মেধাবী ব্যবস্থাপনাকে এবং সফল পরিকল্পনাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া।

মানব ব্যবস্থাপনায় চূড়ান্তভাবে পরিবর্তন অর্জনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিলো একটি ছোট পরীক্ষার মাধ্যমে। সাড়ে ছয় হাজার কর্মীর উপর একটি পরীক্ষা চালানো হয় যেখানে আটটি ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়া সমানভাবে প্রয়োগ করা হয় কোনটি সবচেয়ে ভালোভাবে কাজ করে তা দেখার জন্য।

বক জানান, একটি কোম্পানি কখনওই গুগলের মতো এতো বড় ও লাভজনক হবে না, যদি না এর মানবসম্পদ বিভাগ এ ধরনের কিছু পরীক্ষা চালায়।

মানবসম্পদ ব্যবস্থাপকদের তিনি পরামর্শ দিয়েছেন, এমন প্রার্থীদের নিয়োগ দেওয়ার জন্য যাদের একটি মজবুত প্রেক্ষাপট রয়েছে, এছাড়া এমবিএ সমপর্যায়ের শিক্ষাগত যোগ্যতা রয়েছে। বক আরো পরামর্শ দিয়েছেন, একটি সমস্যা নিয়ে চিন্তা করতে যা ব্যবসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং একইসাথে বেশ মজাদার। বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মধ্যে পরীক্ষার মাধ্যমে কর্মক্ষমতা যাচাই করাও উচিৎ তাদের। পরীক্ষামূলক অবস্থা যেমন- দু’টির বেশি গ্রুপ নিন, ৫ জনের গ্রুপ নাকি ৫শ’ জনের গ্রুপ তা কোনো বিষয় না।

বক পর্যবেক্ষণ করেন, আমাদের সব ক্লায়েন্ট, যাদের সঙ্গে আমরা কাজ করি এবং আমাদের অংশীদার সবাই ভাবে তারা সত্যিই ভালো। কারণ আমরা চিন্তা করি, আমরা তীক্ষ্ণ বিচারক। আমাদের মনোবৃত্তি- আমি অবশ্যই সঠিক সিদ্ধান্ত নেই, পক্ষপাতমুক্ত এবং বাকি সবাই ভুল সিদ্ধান্ত নেয় ও পক্ষপাতযুক্ত।
তাই এ ধরনের পরীক্ষা সঠিক স্থানে পৌঁছানোর একটি মাধ্যম এবং নিজের বিশ্বাসযোগ্যতারও প্রমাণ পাওয়া যা এ পরীক্ষার মাধ্যমে।

তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট।

বাংলাদেশ সময়: ০১৩৮ ঘণ্টা, মে ০৩, ২০১৬
এসএমএন/এটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।