ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তথ্যপ্রযুক্তি

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: মানবের কল্যাণ না ধ্বংস? 

শুভ্রনীল সাগর, ফিচার এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২১৯ ঘণ্টা, জুলাই ২১, ২০১৭
 কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: মানবের কল্যাণ না ধ্বংস?  প্রতীকী

ঢাকা: ১৯৫৬ সাল। কম্পিউটার বিজ্ঞানী ম্যাককার্থি প্রথমবারের মতো ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ শব্দ দু’টির সঙ্গে বিশ্ববাসীর পরিচয় করান। অনেকেই এর যাত্রাপথ এখান থেকেই শুরু করেন। কিন্তু সত্যিই তাই কী?

ইতিহাসের পাতা ওল্টালে পাওয়া যায়, প্রখ্যাত লেখক স্যামুয়েল বাটলার তার উপন্যাসে প্রথম ‘মেশিন কনশাসনেস’র বিষয়টি তুলে ধরেন। তার সৃষ্ট ‘এরেহোন’ আদতে একটি মেশিন কিন্তু মানুষের মতো কাজকর্ম করতে সক্ষম।

১৮৭২ সালের কথা, তখন প্রযুক্তি ততোটা এগোয়নি, তাই উপন্যাসের এরেহোন কল্পনা বিলাসেই রয়ে যায়।

এর ঠিক ৭৮ বছর পর, কল্পনার এরেহোনকে তত্ত্ব ও প্রায়োগিক জায়গায় রূপ দেন বিজ্ঞানী অ্যালান টিউরিং। তিনি ভবিষ্যৎবাণী করেন, খুব শিগগিরই কম্পিউটার মানুষের চিন্তাকে নকল করতে পারবে। এর পরের বছর অর্থাৎ ১৯৫১ সালে একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম তৈরি করা হয় যা ড্রটস খেলতে পারে।  

কম্পিউটার আবিষ্কার ও এর বিকাশের মূল ভিত্তি ছিলো, এটি কোনোরূপ বুদ্ধিমত্তা ছাড়া কেবল গাণিতিক হিসাব করবে। যদি উল্টোটা হয় অর্থাৎ, কম্পিউটারের সঙ্গে যদি চিন্তা যুক্ত হয় তাহলে কী হবে?

এর সম্ভাব্য উত্তরগুলো দেন আর্থার সি ক্লার্ক তার বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ‘২০০১ এ স্পেস অডিসি’ (১৯৬৮) বইতে। বইটি অবলম্বনে স্ট্যানলি কুবরিক সেবছর সিনেমাও তৈরি করেন। এ দুই মাস্টারপিস কাজ নিয়ে অনেক বিজ্ঞানী রসিকতা করে বলেন, মানব সভ্যতার যাত্রা নতুন করে শুরু হয় এর পর থেকেই। আসলেই তাই, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সম্পর্কিত অনেক অগ্রগামী চিন্তাধারা এ বই থেকেই মিলে যায়।

এরপরের উল্লেখযোগ্য মাইলফলকগুলোতে একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক: 
১৯৭০: রোবট নিয়ে গবেষণা ও তৈরি শুরু।
১৯৯৬: আইবিএম’র তৈরি ‘ডিপ ব্লু’ দাবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন গ্যারি কাসপারভকে হারিয়ে দেয়।  
১৯৯৯: চিত্তবিনোদনের জন্য সনি বাজারে আনে পোষা রোবট ‘এআইবিও’।
২০০৫: হোন্ডা নিয়ে আসে সবচেয়ে কাছাকাছি মনুষ্য বুদ্ধিসম্পন্ন রোবট ‘আসিমো’।
২০১১: ভার্চুয়াল আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স আনে গুগল, অ্যাপল ‘সিরি’ ও মাইক্রোসফ্ট আনে করটানা।
২০১১: প্রশ্ন-উত্তর প্রতিযোগিতায় রোবটদের মধ্যে জয়ী হয় ‘আইবিএম ওয়াটসন’।
২০১৬: বিশ্বের প্রথম আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অ্যাটর্নি ‘আইবিএম রস’।
২০১৬-২০১৭: অটোমেশন বা স্বয়ংক্রিয় রোবট নিয়ে উন্নত গবেষণা। যা চাকরির বাজারে বড়সড় পরিবর্তন নিয়ে আসে এবং এনে চলেছে।

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কী
অনেক কথা হলো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে। এটি আসলে কী? বাংলায় এর আক্ষরিক অর্থ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এই বুদ্ধিমত্তা কার? উত্তর, মানুষের। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বিজ্ঞানের একটি শাখা, যেখানে কোনো যন্ত্রে মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তা শক্তিকে কম্পিউটার দ্বারা অনুকৃত ও প্রতিস্থাপিত করার চেষ্টা ও গবেষণা করা হয়। আমাদের সবার পরিচিত রোবট যেমন কোনো প্রাণী বা মানুষ আদলে বানানো যন্ত্র যা কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা, যা মানুষ যেভাবে কাজ করে ঠিক সেই ভাবেই কাজ করতে পারে।  

এই যন্ত্রগুলোর মানুষের মতো উন্নত চিন্তা বা অনুভূতির সংবেদন তৈরি ও প্রকাশ করার ক্ষমতা নেই। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা রোবট নিয়ে বানানো সিনেমাতেও আমরা তা দেখেছি। কম্পিউটারের মাধ্যমে নির্দিষ্ট যা প্রোগ্রাম দেওয়া হচ্ছে এর বাইরে সে যেতে পারে না। একইভাবে মানুষের মতো সে অনুমান ও ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কাজে লাগিয়ে সিদ্ধান্তেও আসতে পারে না।  

বিজ্ঞানের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স শাখায় বর্তমানে রোবটকে আরও কীভাবে মানব মস্তিষ্কের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া যায় এসব নিয়েই গবেষণা চলছে।

মানবের কল্যাণ না ধ্বংস?

মানব কল্যাণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা
এক কথায় বললে, জুতো সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠ— সবই এখন স্বয়ংক্রিয় মেশিনের দখলে। অর্থাৎ সুই-সুতো বানানোর কারখানা থেকে হেল্পলাইনের ভয়েস, সবক্ষেত্রে ব্যবহার হচ্ছে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত রোবট। রোবট শব্দটির উৎপত্তি চেক শব্দ ‘রোবোটা’ থেকে, এর অর্থ ফোরসড্ লেবার বা মানুষের দাসত্ব কিংবা একঘেয়েমি খাটুনি বা পরিশ্রম করতে পারে এমন যন্ত্র। বলাই বাহুল্য, সেটি সে দারুণভাবেই করে চলেছে।  

মঙ্গল গ্রহ থেকে মার্স রোভারের নিয়মিত তথ্য পাঠানো, সমুদ্রগভীরে গিয়ে গবেষণা, কারখানায় ১শ জনের কাজ একাই করে দেওয়া অক্লান্ত কর্মী, ঝাড়ু-মোছা কিংবা শয়নকক্ষে শয্য সঙ্গী-সঙ্গীনির কাজ— সবই সে সামলাচ্ছে নিপুণভাবে। বিনিময়ে কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই।

গুগলের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কোম্পানি ‘ডিপমাইন্ড’ যৌথভাবে কাজ করছে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের সঙ্গে। তারা একটি সফটওয়্যার ডেভেলপ করছে যেটি লক্ষণ দেখে ক্যানসার নির্ণয় ও চোখের রোগ আরও নিখুতভাবে ধরতে সক্ষম হবে। পাশাপাশি হার্টের রোগ ও আলঝেইমারের উপসর্গ ও অবস্থা বলে দেবে অন্য একটি সফটওয়্যার।  
  
গ্লোবাল শিপিং ও ই-কমার্স লেনদেনের মতো জটিল বিষয়গুলোও সে সামলাচ্ছে বিশ্বস্ততার সঙ্গে। খুব বেশিদিন দূরে নেই, যেদিন যানবাহন চালনা, শেয়র মার্কেটের দেখভাল, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, হিসাব সামলানোর মতো জটিল-সময়সাপেক্ষ কাজগুলোও পুরোপুরি চলে যাবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স জিম্মায়।

পৃথিবী ধ্বংসের কারণ!
‘ভবিষ্যতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স হবে পৃথিবী ধ্বংসের কারণ’, কথাটি যখন বলেন স্টিফেন হকিংসের মতো বিজ্ঞানী তখন কপাল না কুঁচকে উপায় থাকে না।

এর মধ্যেই সারা বিশ্বের কারখানাগুলো চলে এসেছে স্বয়ংক্রিয় মেশিনের দখলে। একেকটি মেশিন কম সময়, খরচ ও নিপুণতার সঙ্গে ১শ-২শ মানুষের কাজ করে দিচ্ছে। ফলে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে বাড়ছে বেকারত্ব, সেখান থেকে অভাব-হতাশা-নৈরাজ্য। ধীরে ধীরে মানুষের কাজের জায়গাগুলো নিয়ে নিচ্ছে রোবট। এর মধ্যে ঘোর বিপদ দেখছেন অর্থনীতিবিদ ও সমাজ বিজ্ঞানীরা।

বিজনেস ম্যাগনেট এলন মাস্ক থেকে উদ্যোক্তা বিল গেটস, সবারই সতর্ক বাণী, সুপারস্মার্ট আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স মানুষের উপকারের চেয়ে ক্ষতিই করবে বেশি।  

সম্পদের চরম অসম বণ্টন, মানবিক বিপর্যয়, আর্টিফিশিয়াল স্টুপিডিটি বা কৃত্রিম নির্বুদ্ধিতাকেন্দ্রিক সমস্যা, প্রোগ্রামিং নির্ভর কৃত্রিম বর্ণবাদ, নিরাপত্তায় ধস, বড় ধরনের যান্ত্রিক ও বৈদ্যুতিক বিপর্যয়, মেশিনের অনিচ্ছাকৃত অনিষ্টের মতো ভয়ঙ্কর সব বিপদ দেখা দেবে। যুদ্ধকাজে রোবটের ব্যবহার বেড়ে যাচ্ছে। উন্নত রাষ্ট্রগুলো এর পেছনে কাড়ি কাড়ি টাকা ঢালছে। পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি ও গবেষণায় ব্যবহার হচ্ছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। এর সামান্য যান্ত্রিক ত্রুটি নিমেষেই ধ্বংস ডেকে আনবে আমাদের প্রিয় পৃথিবীর।

মনে আছে ‘আই রোবট’ সিনেমার কথা, যেখানে টেকনিকাল এররের কারণে রোবটরা বিদ্রোহ করে? এরর বা ডেভিল রোবটের নের্তৃত্বে কী তাণ্ডবটাই না চলে। বাস্তবে খুবই সম্ভব এরকম হওয়া। আদতে তো মেশিন, ত্রুটি তো দেখা দিতেই পারে এবং হকিংসদের মতো জ্ঞানীদের বক্তব্য, এরকম বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে মানব সম্প্রদায়, সেইসঙ্গে পৃথিবী।  

পরিবেশ বিজ্ঞানীরাও ক্রমাগত সতর্কবার্তা জানাচ্ছেন। রোবট বানানোর কারখানায় ব্যবহৃত রাসায়নিক উপাদান পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এগুলো গ্লোবাল ওয়ার্মিং ও পরিবেশের ভারসাম্যহীনতায় ভূমিকা রাখছে। তাদের আশঙ্কা, একসময় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা হবে, রোবটের জঞ্জাল।

সবই এখন স্বয়ংক্রিয় মেশিনের দখলে 
হ্যাকিং অব হিউম্যান ব্রেইন
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের জন্য ল্যাবরেটরিতে বানানো হচ্ছে কৃত্রিম সাইন্যাপস। এটি আমাদের স্নায়ুতন্ত্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি কোষ। এর মাধ্যমে একটি নিউরোন থেকে অন্য নিউরোনে রাসায়নিক বা বৈদ্যুতিক তথ্য যায়।

সম্প্রতি আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির দাবি, তারা আর্টিফিশিয়াল সাইন্যাপস তৈরিতে সফল হয়েছে। এখন আরও উচ্চতর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।  

যদি তারা সফলভাবে আর্টিফিশিয়াল সাইন্যাপস প্রতিস্থাপিত করতে পারেন তাহলে মানুষের মতো উন্নত চিন্তা, সংবেদন ও সেই পরিপূরক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়ে উঠবে রোবটগুলো। এমনকি এই রোবটগুলো মানব মস্তিষ্ককে হ্যাকও করতে পারবে। যা বড় ধরনের নৈতিক ও মানবিক বিপর্যয় ঘটাবে বলে বিশেষজ্ঞদের মত।  

আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির নতুন গবেষণা ও এর সাফল্য নিয়ে এর মধ্যেই শোরগোল পড়ে গেছে সব শাখার বিজ্ঞানীদের মধ্যে।

তাদের বক্তব্য, সবকিছুরই ক্রিয়া ও বিপরীত প্রক্রিয়া রয়েছে। আমাদের এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কী চাই এবং এর বিনিময়ে কী হারাবো।

বাংলাদেশ সময়: ০৮২০ ঘণ্টা, জুলাই ২১, ২০১৭
এসএনএস 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।