ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

তথ্যপ্রযুক্তি

সফলতা অর্জনে কাজের গভীরে ঢুকতে হবে: হোসনে আরা বেগম

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩২৬ ঘণ্টা, মার্চ ৮, ২০১৯
সফলতা অর্জনে কাজের গভীরে ঢুকতে হবে: হোসনে আরা বেগম হোসনে আরা বেগম

হোসনে আরা বেগম বাংলাদেশের প্রথম নারী ম্যাজিস্ট্রেটদের মধ্যে অন্যতম একজন। ১৯৮৩ সালে ফরিদপুর সদরে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার মাধ্যমে নিজের কর্মজীবন শুরু করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর শেষ করার পর স্বপ্ন ছিল বিজ্ঞানী এবং গবেষক হওয়ার। ডক্টরেট সম্পন্ন করতে না পারলেও ২০১০ সালে অর্জন ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ থেকে অর্জন করেছেন এনডিসি ডিগ্রি। 

২০১৩ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ২০১৭ সালে নিয়োগের মেয়াদ শেষ হলেও সরকার তাকে সচিব পদে পদোন্নতি দিয়ে আরও দুই বছরের জন্য একই পদে পুনঃনিয়োগ দেন।

হাইটেক পার্কে দেশি বিদেশি বিনিয়োগ অর্জনের মাধ্যমে উজ্জ্বল করে চলেছেন দেশ ও সরকারের ভাবমূর্তি।  

৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবস উপলক্ষে নিজের ব্যক্তিগত এবং কর্ম জীবন নিয়ে বাংলানিউজের সাথে বিশেষ এক সাক্ষাৎকারে মিলিত হয়েছেন হোসনে আরা বেগম। সাক্ষাৎকার নেন শাওন সোলায়মান।  

বাংলানিউজ: শুরুতেই জানতে চাইব যে, ব্যক্তিগত জীবন এবং ক্যারিয়ারে আজকের এই অবস্থানে আসতে নারী হিসেবে আপনার পথচলা কেমন ছিল?

হোসনে আরা বেগম: আমার পথচলা খুবই মিশ্র প্রকৃতির ছিল। আমি খুবই রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে। যে কারণে খুব অল্প বয়সেই আমার বিয়ে হয়ে যাওয়ার অবস্থা তৈরি হয়েছিল। আমার বাবা খুবই বিদ্যানুরাগী একজম মানুষ ছিলেন। কিন্তু তবুও তিনি চাইতেন আমার যেন বিয়ে হয়ে যায়। তবে আমার মায়ের জন্য তেমনটা হয়নি। মাস্টার্সের আগে বিয়ে করতে হয়নি। এরপর বিয়ে করলাম। আমি খুবই সৌভাগ্যবতী যে, জীবনসঙ্গী হিসেবে এমন একজন মানুষ পেয়েছি যিনি আমাকে প্রতি পদে সাপোর্ট করেছেন, সহায়তা করেছেন। যদি উচ্চ শিক্ষার আগেই আমার বিয়ে হয়ে যেতো অথবা বিয়ের পর আমার স্বামী যদি এতটা সহায়ক না হতেন তাহলে হয়তো আজ আমি এই অবস্থানে আসতে পারতাম না। আমি আজ যেখানে তার বড় কৃতিত্ব আমার মা এবং স্বামীর। সব মিলিয়ে মিশ্র প্রকৃতির সময়ের মধ্যে দিয়ে আমাকে এই অবস্থানে আসতে হয়েছে।  

হোসনে আরা বেগম

বাংলানিউজ: দেশে প্রথম যে ৪০ জন নারীকে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় আপনি তাদের মধ্যে একজন ছিলেন। একটি রক্ষণশীল পরিবার থেকে উঠে এসে হঠাত করেই এমন একটি দায়িত্বে। চ্যালেঞ্জগুলো কেমন ছিল?
হোসনে আরা বেগম:
প্রতিটি মুহূর্ত সাংঘাতিক রকমের চ্যালেঞ্জিং ছিল। কেননা আমাদের তখন প্রথম মেয়ে হিসেবে মাঠ পর্যায়ে পোস্টিং হয়েছিল। সেই সময়ে প্রতিটা সময় হিসেব করে চলতে হতো, প্রতিটা পদক্ষেপ বা কাজের আগে চিন্তাভাবনা করতে হতো। আমাদের জন্য সব থেকে বড় যে চ্যালেঞ্জ ছিল তা হলো আমরা সরকারি চাকরিতে যে ‘ইমেজ’ তৈরি করতে পারবো সেই ইমেজ থেকেই পরবর্তীতে আসা নারী কর্মকর্তাদের মাপা হবে। তখন তো সরকারী প্রশাসনে নারী কর্মকর্তা ছিল না। তাই আমরা খারাপ কিছু করলে পুরো ব্যবস্থায় একটি দাগ লেগে যেতো। শুধু আমাদের নিজেদের বড় হওয়ারই বিষয় ছিল না বরং পরে যেসব মেয়েরা আসবে তাদের জন্য আমাদের পরিবেশ তৈরি করে দিয়ে আসার একটা গুরু দায়িত্ব ছিল।  


বাংলানিউজ: আপনার ক্যারিয়ারেরর পরবর্তী সময় নিয়ে একটু জানতে চাই। সরকারি আমলা থেকে হাইটেক পার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। অবসরকালীন ছুটিতে গিয়েও দ্বিতীয় দফায় নিয়োগ পেয়েছেন। আপনি এমন একটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে আছেন যা শুধু একটি সরকারী প্রতিষ্ঠান নয় বরং সরকার ও দেশের ব্র্যান্ডিং করে এই প্রতিষ্ঠান। দায়িত্বপূর্ণ এই পদের ভার কীভাবে সামলাচ্ছেন?

হোসনে আরা বেগম: আমার একটা ভালো দিক আছে, আর তা হচ্ছে আমি অনেক কিছুই খুব ভালোভাবে মনে রাখতে পারি। অধতনদের কাজ আমি মনিটরিং করি। আমার সমস্ত প্রজেক্টের ‘কম্পোনেন্ট ওয়াইজ’ কাজ আমার নখদর্পণে আছে। তবুও মাঝে মাঝে মনে হয় যে, আমি আমার কাজের সবটুকু বোধহয় এখনও করতে পারিনি। আইসিটি খাতে এখনও অনেক কাজ করার আছে। প্রচুর কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে।  


বাংলানিউজ: দেশের আইটি খাতে নারীদের অবস্থা কেমন বলে আপনি মূল্যায়ন করেন?

হোসনে আরা বেগম: আইটি বা আইসিটি খাতের কিছু জায়গা আছে যেখানে মেয়েরা খুব সহজেই ভালো করতে পারে এবং করছে। যেমন ই-কমার্স, আউটসোর্সিং। আবার কিছু দিক রয়েছে যেখানে কাজ করা এখনও মেয়েদের জন্য খুব চ্যালেঞ্জিং। যেমন দীর্ঘক্ষণ সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ করা, গভীর রাত অথবা খুব সকাল পর্যন্ত কল সেন্টারগুলোতে কাজের জন্য যাতায়াত করা। এসব প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি অনেকের আবার বিয়ে হয়ে যাওয়াতে ক্যারিয়ারের মাঝপথে এসে অনেকেই ঝরে পড়ে। এই খাতে কাজ করতে হলে অনেক মনযোগ দিতে হয়। অনেক সময়েই মেয়েরা বিয়ের পর সংসারের বাড়তি দায়িত্ব থেকে এই খাতের কাজগুলোতে মনযোগ দিতে পারে না। এধরনের কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে।

বাংলানিউজ: প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে নারীদের জন্য আপনার পরামর্শ কী থাকবে?

হোসনে আরা বেগম: নারীকে সবসময় আত্মবিশ্বাস ধরে রাখতে হবে। সেইসাথে একটা বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে যে, আজকালকার নারী ও পুরুষ উভয়ের মধ্যে দেখি যে, আমরা কোনো বিষয়ের গভীরে ঢুকতে চাই না। কিন্তু সফলতা অর্জন করতে হলে কাজের গভীরে ঢুকতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনে প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে। এভাবে পরিশ্রম করে কাজ করে কাজের ফিনিশিং দিতে হবে। এভাবে যে কাজ করবে তার ক্যারিয়ারও ভালো যাবে আর তিনি ব্যক্তি জীবনেও উন্নতি করবেন। নারীর পাশাপাশি পুরুষের জন্যও কথাটি সমানভাবে প্রযোজ্য।  

বাংলানিউজ; প্রতিবন্ধকতার কথা যেহেতু আসলো জানতে চাই যে, ক্যারিয়ারে মেয়েদের সব থেকে বড় বাধা কী? বিয়ে কী মেয়েদের সফল ক্যারিয়ারের অন্তরায়? বাঁধা অতিক্রমে আপনার পরামর্শ কী থাকবে? 

হোসনে আরা বেগম: ঠিক সেভাবে না। এখনকার সময়ে আমাদের প্বারিপার্শিকতার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। অন্য যেসব সহকর্মীরা আছেন তাদের মন মানসিকতায় ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। নারীরাও অনেক দিন থেকে শক্তিশালী ও স্বাবলম্বী হচ্ছেন। তারপরও কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিয়ে একটি বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।  

আরেকটি সত্য বিষয় হচ্ছে যে, এখনও মেয়েদেরকে কর্মক্ষেত্রে অনেক জায়গায়ই অবমূল্যায়ন করা হয়। শুধু নারী হওয়ার জন্য একজন কর্মী ভালো কাজ করতে পারবে না; এমনটা এখনও আমাদের মাঝে অনেকেই মনে করেন। এই সময়টায় নারীদের অপেক্ষা করতে হবে, অস্থির হওয়া যাবে না। চেঁচামেচি- হৈচৈ করার দরকার নেই। এই সময়ে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে পেশাদারিত্ব নিয়ে নম্রভাবে কথা বলতে হবে। একটা সময় অবশ্যই আসবে যখন সে নিজের কাজ দিয়েই নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারবে।  

বাংলানিউজ: আপনার ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবন নিয়ে একটু জানতে চাই।  

হোসনে আরা বেগম: সত্যি কথা হচ্ছে ক্যারিয়ারে কাজ করতে গিয়ে পরিবারে বা সংসারে খুব কম সময় দিতে পেরেছি আমি। এরজন্য মাঝে মাঝে দুঃখবোধও হয়। তারপরেও স্বামীর সহযোগিতায় সবকিছু গোছাতে পেরেছি। আমার এক ছেলে ও এক মেয়ে। দু’জনই আইটি খাতে নিজেদের সফল ক্যারিয়ার গড়েছে।  

বাংলানিউজ: প্রশাসন সামলানো বেশি কঠিন নাকি সংসার সামলানো বেশি কঠিন?

হোসনে আরা বেগম: (হাসি দিয়ে) দু’টা একেবারেই ভিন্ন দুই বিষয়। এদুইটিকে মিলিয়ে ফেললে চলবে না। ক্যারিয়ারের শুরুটা যখন হয় তখন কিন্তু সাংসারিক জীবনেরও শুরু হয়। দু’টোই বেশ কঠিন। অনেক সময় দেখা যায়, সন্তানদের সামলানো নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বেশি মতবিরোধ দেখা দেয় যেখানে বাবা-মা দুইজনই কর্মজীবী।  

আবার যদি অফিসের কথা আসে তাহলে দেখা যায় ক্যারিয়ার একদম শুরুর দিকে। তখন দায়িত্ব এবং দায়িত্ববোধ দুটোই খুব বেশি থাকে। প্রথম অবস্থায় কষ্ট হয় কিন্তু এর মধ্যেই আনন্দ আছে।  

বাংলানিউজ: শেষ প্রশ্ন। কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ নিয়ে আপনি কী ধরনের স্বপ্ন দেখেন?

হোসনে আরা বেগম: আমি স্বপ্ন দেখি যে, কর্মক্ষেত্রে অন্তত ৩০ শতাংশ থাকবে নারী কর্মীরা। ৫০ শতাংশ হলে আরও ভালো। তবে নিজের কথা বললে বলি যে, আমি আমার আয়ত্তের মধ্যে হয়তো এখনও এই স্বপ্ন পূরণ করতে পারিনি। আমি চাই কর্মসংস্থান তৈরির পরিবেশ সৃষ্টি করতে। এখনও কাজ করে যাচ্ছি। আশা করি একদিন এই স্বপ্ন পূরণ হবে।  


বাংলাদেশ সময়: ১৮২৮ ঘণ্টা, মার্চ ৮,২০১৯
এস এইচ এস/ এসআইএস

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।