ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের প্রতি কাতারের অর্থনৈতিক সহযোগিতা বহুদিনের পুরোনো ও বহুল আলোচিত একটি বিষয়। তবে ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরুর পর এই ইস্যুতে নতুন করে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু খবর প্রকাশ পেলেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ও গুরুতর দিক এতদিন আড়ালেই ছিল।
সবচেয়ে বিস্ময়কর ও চাঞ্চল্যকর অভিযোগটি হলো—এই তহবিল সহযোগিতা কাতারের একক সিদ্ধান্তে নয়, বরং ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরাসরি নির্দেশ ও তার সরকারের প্রকাশ্য অনুমোদনে হয়েছে।
প্রশ্ন হলো, সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে যাদের ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে আখ্যায়িত করে আসছে, সেই হামাসকেই কীভাবে দেশটির সরকারের সম্মতিতে বিপুল পরিমাণ অর্থ সহযোগিতা করা হলো? এই সিদ্ধান্তের পেছনে নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও ভূ-রাজনৈতিক কৌশল ঠিক কী ছিল?
আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে গত ১১ এপ্রিল পোলিশ সাংবাদিক কনস্ট্যান্টি গ্যাবার্টের একটি নিবন্ধে হামাসের কার্যকলাপে ইসরায়েলের স্বার্থরক্ষা, সংগঠনটিকে কাতারের তহবিল জোগান দেওয়াসহ দেশটির ঘুষ কেলেঙ্কারির নানা তথ্য উঠে এসেছে। ‘কাতারের অর্থ কি নেতানিয়াহুকে ডোবাবে’ শীর্ষক নিবন্ধে এ নিয়ে বিস্তর লেখা হয়েছে।
ওই নিবন্ধে জানানো হয়, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা শিন বেটের প্রধান রোনেন বারকে বরখাস্ত করতে পারেন। যদিও এ কথার পেছনে একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন রয়েছে। ইসরায়েলের উদ্দেশ্য ও ভূ-রাজনৈতিক কৌশল দিক বিবেচনা করলে রোনেন বারকে বরখাস্ত করার বিষয়টি সমুচিত নয়। আবার তিনি যেহেতু গুরুতর একটি বিষয়ে নিজের ভুল স্বীকার করেছেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নেতানিয়াহু তাকে বরখাস্ত করলেও কোনো সমস্যা নেই।
তবে, গত ৮ এপ্রিল ইসরায়েলি সুপ্রিম কোর্ট বিষয়টি আমলে নেন। ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে শিন বেটের প্রধান রোনেন বারকে বরখাস্ত করার বিষয়ে নেতানিয়াহুর সিদ্ধান্তের ওপর স্থগিতাদেশ দেন আদালত। রায় নিয়ে ধোঁয়াশাও ছিল। যদিও নেতানিয়াহু আগেই ঘোষণা করেছিলেন, তার বিপক্ষে যাওয়া যেকোনো রায় তিনি উপেক্ষা করবেন।
প্রজেক্ট সিন্ডিকেটের নিবন্ধে বলা হয়েছে, নেতানিয়াহু বিচার বিভাগের কর্তৃত্ব ক্ষুণ্ন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলে মনে হচ্ছে। বিচার বিভাগের প্রতি তার এমন স্পষ্ট অবজ্ঞা সাংবিধানিক সংকটের সৃষ্টি করতে পারে। আদালত রোনেন বারের বরখাস্তের আদেশ আগামী ২০ এপ্রিল পর্যন্ত স্থগিত রেখেছেন। এর মধ্যে সরকারকে দেশের স্বাধীন অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে আপস করতে বলা হয়েছে। রোনেন বারের বরখাস্তের বিরোধিতা করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল। কেননা, তিনি মনে করেন এখানে নেতানিয়াহুর স্বার্থের সংঘাত রয়েছে।
পরিস্থিতি জটিল, কারণ ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলা ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ার দায়ে রনেন বারকে বরখাস্ত করার যৌক্তিকতা রয়েছে। রনেন বার নিজেও ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেছেন এবং এ বিষয়ে একটি রাষ্ট্রীয় তদন্ত কমিশনের আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু নেতানিয়াহু এই তদন্ত চান না, কারণ এতে তার নিজের ব্যর্থতাও প্রকাশ পেতে পারে। রোনেন বার অভিযোগ করেছেন, দুর্নীতি, জালিয়াতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য নেতানিয়াহু ফৌজদারি মামলার মুখোমুখি। বিচারে সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ পেছাতে আদালতকে রাজি করানোর জন্য তাকে চাপ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন নেতানিয়াহু।
যদিও নেতানিয়াহুর রনেন বারের ওপর থেকে ‘আস্থা হারানোর’ পেছনে কিছু যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে, তেমনি স্বার্থের সংঘাতের সম্ভাবনাও জোরালো। তবে সবচেয়ে বিতর্কিত দিক হলো ‘কাতারগেট’ কেলেঙ্কারি। এটি খুব জটিল ‘ঘুষ ও গোপন তথ্য ফাঁসের’ মামলার তদন্ত, যেখানে নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা জড়িত। এই তদন্ত শুরু হওয়ার পরপরই নেতানিয়াহু রনেন বারকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত নেন।
এই কেলেঙ্কারির সারসংক্ষেপ হলো: নেতানিয়াহুর দুই ব্যক্তিগত সহযোগী, যোনাতান উরিখ ও এলি ফেল্ডস্টেইন, কাতারের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা কাতারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমে কিছু বার্তা ফাঁস করতেন। তাদের আরেক সহযোগী, যিনি পালিয়ে সার্বিয়ায় চলে গেছেন, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে দেশটির কাছে চাওয়া হয়েছে। জেরুজালেম পোস্টের প্রধান সম্পাদককে এ বিষয়ে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে সন্দেহ করা হচ্ছে। একজন ব্যবসায়ী স্বীকার করেছেন, তিনি একজন পরিচিত মার্কিন কাতারি লবিস্টের কাছ থেকে প্রধানমন্ত্রীর মুখপাত্র এলি ফেল্ডস্টেইনের কাছে অর্থ সরবরাহ করেছিলেন।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে গোপন তথ্য ফাঁস প্রায় সময় নেতানিয়াহু নিজেই করেন বলে মনে করা হয়। কারণ, অতীতেও তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের ক্ষতি করতে গোপন তথ্য ফাঁস করেন। যদিও কাতারগেটের বিষয়ে তার ব্যক্তিগত সম্পৃক্ততার প্রমাণ নেই। কিন্তু তিনি স্বীকার করেছেন, তার নির্দেশেই যোনাতান উরিখ কিছু তথ্য ফাঁস করেন।
ধারণা করা হচ্ছে, গাজায় ইসরায়েলি জিম্মিদের ভাগ্য নিয়ে চলমান ও বিচ্ছিন্নভাবে পরিচালিত পরোক্ষ আলোচনা প্রক্রিয়ায় নিজ দেশকে একটি ‘বিশ্বস্ত অংশীদার’ হিসেবে উপস্থাপন করতেই তথ্য ফাঁসকারীদের কাতার অর্থ দিয়েছিল, এমন অভিযোগ রয়েছে। কাতার যে ঘুষ দিয়ে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করে, তা ২০২২ সালে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের কয়েকজন সদস্যের গ্রেপ্তারের ঘটনায়ও স্পষ্ট হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে কাতারি অর্থ গ্রহণের অভিযোগ ছিল।
তবে ইসরায়েলে কাতারি অর্থের গুরুত্ব ভিন্ন। ২০১৮ সাল থেকে, নেতানিয়াহুর সরকারের প্রকাশ্য অনুমোদনে, কাতার প্রতি মাসে ৩০ মিলিয়ন ডলার গাজায় হামাস শাসনকে টিকিয়ে রাখতে পাঠিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য সন্ত্রাসবাদ বিরোধী নিষেধাজ্ঞা এড়াতে এসব অর্থ পাঠানো হতো স্যুটকেসে। এই অর্থ দিয়ে গাজার সরকারি কর্মচারীদের বেতন ও কল্যাণমূলক ভাতা প্রদান করা হতো। ফলে হামাস তাদের অন্য অর্থ সন্ত্রাসে ব্যবহার করতে পারত।
ইসলামপন্থীদের প্রতি কাতারের সমর্থনের জন্য তারা আরব বিশ্বে বহুবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। হামাসকে অর্থ দেওয়ার পেছনে নেতানিয়াহুর যুক্তি ছিল, মুক্তিকামী সংগঠনটির শাসন ব্যবস্থা ইসরায়েলের স্বার্থে সহায়ক। কারণ, গাজায় সন্ত্রাসীরা, রামাল্লায় দুর্নীতিপরায়ণ ও অদক্ষ ফাতাহ আমলারা থাকায় ফিলিস্তিন ইস্যুতে আলোচনা এড়ানোর জন্য ইসরায়েলের কাছে সুবিধাজনক অজুহাত ছিল। রনেন বারের প্রস্তাবিত রাষ্ট্রীয় তদন্ত কমিশন এই সমস্ত বিষয় প্রকাশ করে দিতে পারত।
অভিযুক্তদের আইনজীবীরা সরাসরি অভিযোগের জবাব না দিলেও বলেন, কাতার কোনো ‘শত্রু রাষ্ট্র’ নয়, অর্থাৎ বিশ্বাসঘাতকতার কোনো প্রশ্ন ওঠে না। তারা আরও বলেন, ইসরায়েলি আইনে শুধুমাত্র সরকারি কর্মচারীরাই ঘুষের আওতায় পড়েন। আর নেতানিয়াহুর সহযোগীরা সরকারি কর্মচারী নন। তাই প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারীরা সেই সংজ্ঞার মধ্যে পড়েন না। তাদের পক্ষ থেকে এই যুক্তিও আসতে পারে, ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম যেভাবে অবলীলায় এই তথ্য ফাঁসগুলো প্রকাশ করেছে, তাতে তারাও কিছুটা দায়ী।
তবে ইসরায়েলের রাজনীতির পেছনে ছুরি মারা সংস্কৃতিতে তথ্য ফাঁস একটি সাধারণ ঘটনা। সাংবাদিক ও রাজনীতিক—উভয়েই এভাবে চলেন। এলি ফেল্ডস্টেইন আগেও এক তথ্য ফাঁস কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, কিন্তু চাকরি হারাননি।
ইসরায়েলি বিচারমন্ত্রী ইয়ারিভ লেভিনের মতে, নেতানিয়াহুর সরকার ‘লাখ লাখ মানুষের অধিকার রক্ষা করছে, যাদের গণতান্ত্রিকভাবে প্রদত্ত ভোটের সিদ্ধান্ত কিছু বিচ্ছিন্ন এবং অহংকারী বিচারক দখল করে নিচ্ছেন। ’ কিন্তু জনমত বলছে ভিন্ন কথা—৬৩ শতাংশ ইসরায়েলি মনে করেন দেশের গণতন্ত্র এখন হুমকির মুখে। সুপ্রিম কোর্ট, অ্যাটর্নি জেনারেল ও শিন বেটের ওপর তাদের আস্থা নেতানিয়াহু সরকারের চেয়ে দ্বিগুণ বেশি।
অনুবাদক: মাহমুদুল হাসান ধ্রুব; সিনিয়র নিউজরুম এডিটর। মূল সম্পাদনা: মো. জুবাইর; সিনিয়র নিউজরুম এডিটর, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম।
বাংলাদেশ সময়: ২২০২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০২৫