বয়স নিয়ে কথা বলব। তাই একটু সাবধানে বলব যেন ‘কাউকে ছোট করা’ না হয়।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির কারণে মানুষ এখন দীর্ঘ সময় সুস্থ ও সক্রিয়ভাবে বাঁচতে পারছে। কিন্তু আমরা এখন দেখছি অনেক প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা বয়স বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতা আরও শক্তভাবে ধরে রাখছেন, যা প্রায়ই তরুণ নেতাদের সুযোগ কমিয়ে দেয়।
ক’দিন আগেই ন্যাটোর বার্ষিক সম্মেলনে, এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এবং মেট ফ্রেডরিকসেন (দুজনেরই বয়স ৪৭), জর্জিয়া মেলোনি (৪৮) ও পেদ্রো সানচেজের (৫৩) মতো নেতারা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ৫ শতাংশ সামরিক ব্যয় বাড়ানোর দাবি মেনে নিতে বাধ্য হন। ন্যাটোর রাষ্ট্রপ্রধানদের গড় বয়স ৬০ বছর। জার্মানির ফ্রিডরিখ মের্ৎসের বয়স ৬৯ এবং তুরস্কের রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের বয়স ৭১ বছর।
সবাই ৫ শতাংশ সামরিক বাজেট বাড়ানোর বিষয়টি মেনে নিয়েছেন। এটি কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ বা আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারিত হয়নি। এমনকি দেশগুলোতে গণতান্ত্রিকভাবে আলোচনাও হয়নি। এটি নির্ধারিত কোনো নীতি ছিল না, বরং এক পাগলাটে বুড়োর ইচ্ছার কাছে নতজানু হওয়া। সম্মেলনে ৫৮ বছর বয়সী ন্যাটোর মহাসচিব মার্ক রুত্তে ট্রাম্পকে ‘ড্যাডি’ বলেও ডেকেছেন। এটি কূটনীতি নয়, বরং আত্মসমর্পণ।
এই প্রজন্মের সংঘাত শুধু রাজনৈতিক মঞ্চেই নয়, অন্য জায়গাগুলোতেও স্পষ্ট। ইউক্রেনের ৪৭ বছর বয়সী প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি প্রবীণ পুতিনের সাম্রাজ্যবাদী চেষ্টা রুখছেন।
৭০ বছরের শি জিনপিংয়ের চোখ রয়েছে তাইওয়ানে, যেখানকার নেতা তার চেয়েও সাত বছরের ছোট। আর ৭৫ বছর বয়সী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনের গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছেন, যে উপত্যকার প্রায় অর্ধেক মানুষ ১৮ বছরের কম বয়সী।
ইরানের জনগণের গড় বয়স ৩২। দেশটিতে ক্ষমতা ধরে রেখেছেন ৮৬ বছর বয়সী এক নেতা। ৯২ বছর বয়সী ক্যামেরুনের পল বিয়া ১৯৮২ সাল থেকে ক্ষমতায় রয়েছেন। যেখানে জনগণের গড় বয়স মাত্র ১৮ এবং গড় আয়ু ৬২ বছর। এগুলোই দেখায় কীভাবে প্রবীণরা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে তরুণদের ওপর আধিপত্য বজায় রেখেছেন, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এখানে কোনো প্রবীণদের ষড়যন্ত্র নেই, কোনো সিনিয়র সিটিজেনস ক্লাব নেই, যারা বিশ্ব আধিপত্যের জন্য কাজ করছেন। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো, যাদের জীবন গড়ে উঠেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বব্যবস্থার ওপর, ঠিক তারা এখন সেই বিশ্বব্যবস্থাকে ভেঙে দিচ্ছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার সময় খামেনির বয়স ছিল মাত্র ছয় বছর। ট্রাম্প জন্মেছিলেন ১৯৪৬ সালে, সেই বছরই জাতিসংঘের প্রথম সাধারণ অধিবেশন হয়।
নেতানিয়াহুর জন্ম ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার এক বছর পর। মোদীর জন্ম ১৯৫০ সালে, যখন ভারত প্রজাতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পুতিনের জন্ম ১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে, স্তালিনের মৃত্যুর কয়েক মাস আগে। শি জিন পিং ১৯৫৩ সালের জুনে জন্মগ্রহণ করেন, ঠিক স্তালিনের মৃত্যুর পর। এরদোয়ান জন্মান ১৯৫৪ সালে, তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য হওয়ার দুই বছর পর। তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থার সন্তান। এখন তারাই জীবনের শেষ দিকে এসে যেন সেই ব্যবস্থাটাই ধ্বংস করার চেষ্টা করছেন। যেন তারা প্রতিশোধ নিচ্ছেন। ডিলান থমাস আমাদের বলেছিলেন— ‘আলো নিভে যাওয়ার আগে রাগে ফেটে পড়ো’। এই লাইন এতটাই সত্যি মনে হয় আজকাল।
হ্যাঁ, নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা কাগজে যেমন পরিকল্পিত ছিল, বাস্তবে তা সবসময় ঠিকঠাক কাজ করেনি। তবে অন্তত একটা আদর্শ ছিল। একটা সাধারণ বিশ্বাস ছিল যে, মানুষ যেন পুরনো সময়ের বড় বড় অন্যায় আর যুদ্ধ না করে। যদিও কিছুটা দুর্বল, কিন্তু এই বিশ্বাসের উদ্দেশ্য ছিল মহৎ। সবারই বিশ্বাস ছিল, আলোচনা আর শান্তিপূর্ণ সমঝোতা বা কূটনীতি হলো সবচেয়ে ভালো পথ। সেই বিশ্বাস এখন অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে, বিশেষ করে তাদের, যাদের এটাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে রক্ষা করা উচিত ছিল।
এখন একটা নতুন পরিস্থিতি। হিটলার, মুসোলিনি, স্তালিন, মাও সেতুংয়ের মতো নেতারা সবাই তরুণ বয়সে ক্ষমতায় এসেছিলেন। নতুন প্রজন্ম নতুন পৃথিবী বানিয়েছিল এবং তার ফলও পাওয়া যাচ্ছিল। আজ সেই নতুন পৃথিবী ধ্বংস করছে এক বৃদ্ধ প্রজন্ম, যারা এই ধ্বংস দেখতেও পারবে না।
আপনি সহজেই বলতে পারেন ড্রিল, বেবি, ড্রিল (আরো তেল বা গ্যাস খোঁজো)। আপনি হয়তো ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় আপনার জীবনে দেখবেন না। ফরাসি ভাষায় এ নিয়ে একটা কথা যাচ্ছে, যার অর্থ এমন— আমাদের পরে যা হবে, সেটা তো আমাদের দেখার বিষয় নয়।
আপনি ভাবতে পারেন, যারা দীর্ঘ জীবন লাভের সৌভাগ্য পেয়েছেন, তারা হয়তো স্নেহ, কৃতজ্ঞতা এবং বিশ্ব নেতৃত্বের একটি সুন্দর উত্তরাধিকার রেখে যাবেন। কিন্তু এর পরিবর্তে, আমরা দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর নিপীড়ন, সহিংসতা, গণহত্যা, পরিবেশের ধ্বংস এবং আন্তর্জাতিক আইনের অবজ্ঞার পুনরুত্থান দেখছি, যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ৭০ থেকে ৮০ বছর বয়সী নেতাদের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। শান্তি রক্ষার চেয়ে তারা বিচার এড়ানোয় বেশি আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে।
কিন্তু পরিস্থিতি এমন না-ও হতে পারে। নেলসন ম্যান্ডেলা যখন রাজনীতি থেকে সরে যান, তখন তিনি ‘দ্য এল্ডার্স’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন। এই সংগঠনে সাবেক বিশ্বনেতারা শান্তি, ন্যায়বিচার আর মানবাধিকার রক্ষার জন্য কাজ করেন। আফ্রিকার সম্মিলিত সিদ্ধান্ত আর প্রবীণদের জ্ঞান থেকে অনুপ্রাণিত এই সংগঠন দেখিয়েছে, বয়স মানে শুধু ক্ষমতা নয়, বয়স মানে হতে পারে স্পষ্ট দৃষ্টি, সহমর্মিতা আর বিবেক।
সমস্যা বয়স নয়। সমস্যা হলো, কেউ বয়সের শক্তিকে কীভাবে ব্যবহার করছেন। পৃথিবীর আর দরকার নেই এমন প্রবীণ শাসকদের, যারা শক্তি আঁকড়ে ধরে থাকতে চান। এখন দরকার এমন প্রবীণদের, যারা ক্ষমতা ছেড়ে দিতে প্রস্তুত এবং অন্যদের পথ দেখাতে চান। এমন মানুষ দরকার, যারা উত্তরাধিকারকে ব্যক্তিগত গৌরব হিসেবে ভাবেন না, বরং কেমন একটা পৃথিবী রেখে যাচ্ছেন, সেটি নিয়ে ভাবেন। এই বয়সের যুগে আমাদের দরকার আধিপত্য নয়, দরকার জ্ঞান। এটিই শেষ পর্যন্ত শাসক আর নেতার মধ্যে পার্থক্য।
নিবন্ধটি লিখেছেন নেদারল্যান্ডস ও ফ্ল্যান্ডার্সের দার্শনিক ডেভিড ভ্যান রেইব্রুক। তার লেখা বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘রেভলুসি: ইন্দোনেশিয়া অ্যান্ড দ্য বার্থ অব দ্য মডার্ন ওয়ার্ল্ড’ ও ‘কঙ্গো: দ্য এপিক হিস্টোরি অব অ্যা পিপল’ ।
আরএইচ/এমজেএফ