২০২০ সালের জাতীয় নিরাপত্তা আইনের অধীনে একটিভিস্ট এবং সাংবাদিকদের ভয় দেখানো এবং সেল্ফ-সেন্সরশিপ বাড়ছে।
২০১৮ সালে প্রয়াত শেফ, পর্যটক এবং টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব অ্যান্থনি বুরদিন হংকং নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করেন যেখানে তিনি একটি স্থানীয় পোস্ট-পাঙ্ক ব্যান্ডের সদস্যদের সাক্ষাৎকার নেন।
২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে করোনা মহামারির কারণে হংকংয়ে লাইভ কনসার্ট বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে সেখানে বেইজিংয় জাতীয় নিরাপত্তা আইন (এনএসএল) আরোপ করে। এর মানে নাগরিকরা আর যা খুশি তা বলতে পারবে না। প্রতিবাদ স্লোগান নিষিদ্ধ করা হয়েছে, হংকংয়ের জাতীয় সঙ্গীত নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং সাদা কাগজ নিয়ে বিক্ষোভ করার অভিযোগে অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এনএসএল যতটা অস্পষ্ট: এটি বিচ্ছিন্নতা, অধঃপতন, সন্ত্রাসবাদ এবং বিদেশি বাহিনীর সাথে সংঘর্ষ নিষিদ্ধ করেছে; এটি জনগণকে কেন্দ্রীয় এবং হংকং সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা উস্কে দিতে নিষেধ করে; এখতিয়ারের বাইরে হংকংয়ে জাতীয় নিরাপত্তা অফিস স্থাপন করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের আরও বেশি ক্ষমতা প্রদান করেছে, যার মধ্যে রয়েছে আদালতের আদেশ ছাড়া নজরদারি চালানো।
সরকার বলেছে, খুব কম লোককে টার্গেট করা হবে। কিন্তু আমি দেখেছি বন্ধু এবং পরিচিতরা আইন প্রণয়নের আগেই হোয়াটসঅ্যাপে দীর্ঘদিনের সাধারণ আলোচনা গ্রুপ ছেড়ে দিয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের কাছে হংকং-এর হস্তান্তরের ২৩তম বার্ষিকীর এক ঘণ্টার মধ্যে অনেক গ্রুপ উধাও হয়ে গেছে।
তারপর থেকে সাত মাসে ভিন্নমত প্রকাশের জায়গা নাটকীয়ভাবে সংকুচিত হয়েছে। এই মাসের শুরুতে পুলিশ বলেছে, এনএসএল লঙ্ঘনের অভিযোগে ৯৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং কয়েকদিন পরপর আরো গ্রেপ্তারের ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে।
পুলিশ প্রধান এই বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। কিন্তু অনেক হংকংবাসী এখন ভয়ে বাস করছেন যে তাদের কথা তাদের বিপদে ফেলতে পারে, অথবা এমনকি তাদের স্বাধীনতাও খর্ব হতে পারে। ২০১৯ সালের বিক্ষোভের সময় ভিপিএন এবং এনক্রিপ্ট করা মেসেজিং অ্যাপের ব্যবহার বেড়েছে।
কিন্তু হংকংয়ের জনগণ জাতীয় নিরাপত্তা আইন ভঙ্গ না করে যখন নিজেদের মত প্রকাশ করার উপায় খুঁজছে, তখন সরকারের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ এটাই বলছে যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, তথ্যের স্বাধীনতা এবং তথ্যে প্রবেশাধিকার আরো সংকুচিত হতে যাচ্ছে।
জানুয়ারির শেষে সরকার মোবাইল ফোনের সিম কার্ড কেনার সময় জনগণকে তাদের পূর্ণ নাম, জন্ম তারিখ এবং কপি প্রদানের পরিকল্পনা নিয়ে এক মাসব্যাপী আলোচনা শুরু করে। সিদ্ধান্ত হয়, কারো তিনটির বেশি সিম কার্ড থাকবে না। কর্মকর্তারা বলছেন, অপরাধ মোকাবেলার জন্য এই পদক্ষেপ প্রয়োজন। কিন্তু অনিবন্ধিত প্রি-পেইড সিম কার্ড একটিভিস্ট এবং প্রতিবাদকারীরা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে এবং সেই সাথে যারা রাজনৈতিক মতামত প্রকাশের সময় তাদের গোপনীয়তা নিয়ে উদ্বিগ্ন, তারাও ব্যবহার করেন।
এক সপ্তাহ পরে, প্রধান নির্বাহী ক্যারি লাম শহরের আইনসভায় তার প্রথম ভাষণে ‘সাহসী’ পদক্ষেপ ঘোষণা করেন। যেহেতু চারজন গণতন্ত্রপন্থী আইনপ্রণেতা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি প্রদানের ফলে অযোগ্য হন এবং এক ডজনেরও বেশি ব্যক্তি প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন। তিনি যে সব পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করেন তার মধ্যে ছিল ‘ভুয়া খবর’ এবং ডক্সিং মোকাবেলা করার পরিকল্পনা। কিন্তু এর মধ্যে থাকতে পারে জনগণের রেকর্ড, যেমন যানবাহন নিবন্ধন, সম্পত্তি লেনদেন এবং কর্পোরেট ফাইলিং- জনস্বার্থ তদন্ত পরিচালনাকারী সাংবাদিকদের ব্যবহৃত সরঞ্জাম। এছাড়া লাম ইঙ্গিত দিয়েছেন যে গোপনীয়তা কমিশনার বিষয়বস্তু অপসারণের জন্য আপত্তিকর ওয়েবসাইট এবং প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা পেতে পারে।
এর ফলে হংকংয়ের পরিচয়ের কেন্দ্রে রয়েছে ‘এটা চীনের আরেকটি শহর নয়’। যদিও শহরটি রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে পুনর্নির্মাণের প্রচেষ্টা চলছে, তারপরও হংকংবাসীরা ভাবছেন যে তারা চীনের মূল ভূখণ্ডে নিষিদ্ধ প্ল্যাটফর্ম এবং ওয়েবসাইটে অবাধে প্রবেশ করতে পারবেন।
জানুয়ারিতে একটি গণতন্ত্রপন্থী ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেয় হংকংয়ের আইএসপি। এতে বোঝা যায়, কোনো সাইটের কোনো কন্টেন্ট যদি ‘জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি’ হয়ে ওঠে তবে তা বন্ধ করতে আইএসপিদের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে পারবে পুলিশ।
অবরুদ্ধ সাইটটি ২০১৯ সালের প্রত্যার্পণ বিরোধী বিল আন্দোলনের সময় গড়ে ওঠে (HKChronicles.com)। এই সাইটে পুলিশ কর্মকর্তা এবং সরকারপন্থী ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত তথ্য এবং ছবি প্রকাশ করা হয়। তারা দাবি করে, বিক্ষোভকারীদের হয়রানি করা হচ্ছে।
হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশনের সহকারী অধ্যাপক লোকমান সুই আমাকে বলেছেন, যদিও তিনি ডক্সিং অনুশীলনের সাথে একমত নন। তিনি মনে করেন, এটি কোনো এনএসএলের বিষয় নয়। এটি একটি গোপনীয়তার বিষয় এবং এই প্রসঙ্গে এনএসএল ব্যবহার করা হচ্ছে।
সুই বলেছেন, তিনি হংকংয়ে বিনামূল্যে ইন্টারনেটের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। তিনি বলেন, ভিন্নমতকে দমন করার জন্য অফলাইনে এনএসএলের অপব্যবহার করা হয়েছে। তিনি বলেন, ভয় হচ্ছে এ আইন এখন অনলাইনে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বন্ধ করার জন্য ব্যবহার করা হবে।
হংকং জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান ক্রিস ইয়ুং বলেন, মুক্ত ইন্টারনেট, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হংকংয়ের বেঁচে থাকার ‘চূড়ান্ত পরীক্ষা’ যা এখনো হংকং হিসেবে স্বীকৃত।
ইয়ুং বলেন, বার্তাকক্ষে সেল্ফ-সেন্সরশিপ বেড়েছে এবং এনএসএলের প্রেক্ষাপটে সূত্রগুলো ছড়িয়ে পড়েছে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর হামলা চলছে। গত মাসে পুলিশের জাতীয় নিরাপত্তা ইউনিটের কর্মকর্তারা চারটি স্থানীয় সংবাদ সংস্থা পরিদর্শন করে এবং তাদের কাছে তথ্য-উপাত্ত হস্তান্তরের দাবি জানায়।
সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর গণতন্ত্রপন্থী শিবিরের প্রাথমিক নির্বাচনে দাঁড়ানো প্রার্থীদের তথ্য খুঁজছিল পুলিশ। একই দিনে এনএসএল লঙ্ঘনের অভিযোগে মোট ৫৩ জন প্রার্থী এবং একটিভিস্টকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ইযুং আমাকে বলেন, অন্যায় অনুরোধকে চ্যালেঞ্জ করতে আগে আদালতে যেতে পারতো গণমাধ্যম। কিন্তু এনএসএলের অধীনে আর তা সম্ভব নয়। গণমাধ্যমকে সহযোগিতা করা কেউ নেই, আপিল বা প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ নেই।
সবকিছুই নির্ভর করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আত্মসংযমের ওপর। কিন্তু আমরা এখন পর্যন্ত শূন্য সংযম দেখেছি।
এই প্রতিটি ঘটনাকে হংকংয়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং তথ্যের জন্য উদ্বেগজনক হিসেবে দেখা যেতে পারে। এটা এমন একটা শহরকে দেখাচ্ছে যা অচেনা হয়ে যাচ্ছে। হংকং-এর লালিত স্বাধীনতার জন্য ইয়ুং বলেছেন যে ‘সবচেয়ে খারাপ সময় এখনো আসেনি’। সূত্র: আল জাজিরা
বাংলাদেশ সময়: ২০১৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২১
নিউজ ডেস্ক