গাইবান্ধা: সাতশ বছরের পুরোনো স্থাপনা অথচ দেখে মনে হবে সবে নির্মিত! প্রাচীন স্থাপত্য নকশা ও আরবি হরফ মুদ্রিত রহস্যে ঘেরা দেশের সবচেয়ে ছোট এ মসজিদটিকে ঘিরে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। ঐতিহাসিক এ স্থাপনাটিকে ঘিরে লোকমুখে রয়েছে নানা কিংবদন্তি।
এ মসজিদে নামাজ পড়তে পারেন ইমামসহ সর্বোচ্চ চার থেকে পাঁচজন। কে কখন, কেনই বা এত ছোট আকারের এ মসজিদটি নির্মাণ করেছেন তার সঠিক কোনো তথ্য নেই। তবে সাতশ বছর আগে এক রাতে অলৌকিকভাবে মসজিদটি তৈরি হয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
রহস্যে ঘেরা মসজিদটি গাইবান্ধার পলাশবাড়ী পৌরশহরের নুনিয়াগাড়ি গ্রামে অবস্থিত। এর পূর্বে রংপুর-ঢাকা মহাসড়ক ও পশ্চিম পাশ দিয়ে গেছে পলাশবাড়ী-ঘোড়াঘাট সড়ক। দুই সড়কের ঠিক মাঝ দূরত্বে নুনিয়াগাড়ী গ্রামের বুক চিড়ে নির্মিত পিচঢালা সড়কের দক্ষিণে অবস্থিত ঐতিহাসিক এ মসজিদটি। পলাশবাড়ী জিরো পয়েন্ট চৌমাথা মোড় থেকে মসজিদটির দূরত্ব আধা কিলোমিটার।
এটি দেশের সবচেয়ে ছোট এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ, যা প্রাচীন ইসলামিক ঐতিহ্যের এক অনন্য নিদর্শন। যা কালের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে। এটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা। অন্তত সাতশ বছরের পুরোনো এ মসজিদটি এক কক্ষ বিশিষ্ট। এর উপরিভাগে একটি গম্বুজ এবং চার কোণায় রয়েছে চারটি পিলার। প্রাচীন এ মসজিদটিতে একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন ইমামসহ চার থেকে পাঁচজন। মসজিদটির অভ্যন্তরে নামাজের জায়গা রয়েছে দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে মাত্র ছয় ফুট।
স্থানীয় কেরামত উল্লাহ মণ্ডলের ছেলে কাদিরবক্স মণ্ডলের নামে মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত হয়েছে। কিন্তু মসজিদটির নাম নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। এলাকাবাসীসহ তার বংশধরেরা বলছেন, তিনি এটি নির্মাণ করেননি।
নুনিয়াগাড়ি গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা ও মসজিদ কমিটির সাবেক সভাপতি রেজানুর রহমান ডিপটি বলেন, ধারণা করা হয়, এটি নবাব সুজা-উদ-দৌলার আমলের। বিভিন্ন সময় স্থানীয় ও সরকারিভাবে মসজিদটির ইতিহাস উদ্ঘাটনের চেষ্টা চালানো হয়েছে। ১৯৯১ সালে পলাশবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হিসেবে দায়িত্বে আসেন আব্দুল মালেক। তৎকালীন গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক ছিলেন আব্দুর সবুর। তারা মসজিদটি পরিদর্শন করেন এবং এটির ইতিহাস উদ্ঘাটনের জন্য স্থানীয়দের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন। সেই কমিটির সদস্যরা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কামারদহ ইউনিয়নের মাস্তা এলাকার প্রাচীন লাল মসজিদ ও দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার ওসমানপুর এলাকার প্রাচীন সৌর মসজিদ দেখে ধারণা করা হয়, এটি নবাব সুজা-উদ-দৌলার আমলের। কারণ নবাব সুজা-উদ-দৌলার আমলে নির্মিত ওই মসজিদ দুটোর হুবহু আদল-অনুকরণে তৈরি করা হয়েছে পলাশবাড়ীর প্রাচীন এ এক গম্বুজ বিশিষ্ট সবচেয়ে ছোট মসজিদটি। তবে এর নাম নিয়ে ভিন্নমত দেন তিনি।
মণ্ডল পরিবারের সদস্য মসজিদ কমিটির সাবেক সেক্রেটারি আব্দুল মতিন মণ্ডল জানান, মসজিদটি সংরক্ষণের জন্য জেলা-উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগসহ বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করা হয়। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর ২০১৩ সালের ২ জুন মসজিদটি সংরক্ষিত প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়। ফলে মসজিদটি রংপুর বিভাগের মধ্যে প্রাচীন স্থাপত্যের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।
তিনি আরও জানান, মসজিদটির স্মৃতি রক্ষায় এর পূর্ব পাশে নতুন বড় একটি মসজিদ নির্মিত হয়েছে। যেখানে নামাজ আদায় করা হয়।
ওই মসজিদের দায়িত্বপ্রাপ্ত কোষাধ্যক্ষ আবু তোরাব তালুকদার বলেন, বিশেষ করে সপ্তাহের শুক্র ও শনিবার দূর-দূরান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ মানুষ দেশের সবচেয়ে ছোট প্রাচীন এ মসজিদটি দেখতে আসেন। তারা এখানে নামাজ আদায় করে থাকেন। তারা রোগ-শোক থেকে মুক্তিসহ মনের নেক নিয়াত পূরণে আল্লাহর দরবারে দোয়া করেন এবং সুফল পেয়ে থাকেন। ফলে তারা শোকরানা স্বরূপ মসজিদে দান-খয়রাত করে থাকেন।
তিনি আরও বলেন, প্রাচীন ইসলামিক ঐতিহ্যের এক অনন্য নিদর্শন এ মসজিদটি রক্ষায় সম্প্রতি সংস্কার কাজ শেষ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩০ ঘণ্টা, মার্চ ১১, ২০২৫
আরএ