ঢাকা, বুধবার, ২ আশ্বিন ১৪৩২, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

ইসলাম

মানবতার চূড়ান্ত ত্রাণকর্তা মহানবী মুহাম্মদ (সা.)

মুফতি সাইফুল ইসলাম, সৌজন্য কালের কণ্ঠ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮:৩৬, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৫
মানবতার চূড়ান্ত ত্রাণকর্তা মহানবী মুহাম্মদ (সা.)

মানব ইতিহাসে এমন কিছু মুহূর্ত এসেছে, যখন সভ্যতা ধ্বংসস্তূপে ভেঙে পড়েছে। চারদিক থেকে ধেয়ে এসেছে অন্ধকার, রক্তপাত, অমানবিকতা আর অবিচারের হিংস্র দাপট।

মনে হয়েছে মানুষ যেন মানুষ নয়, বরং হিংস্র পশু। সেই ঘন কালো আঁধারের ভেতর হঠাৎই উদিত হয়েছে এক অবিনাশী আলো, যা কেবল একটি জাতিকে নয়, সমগ্র মানবজাতিকে দিশা দেখিয়েছে।

সেটি হচ্ছে আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমন। যার আগমণে পৃথিবী পেয়েছে নতুন দিশা। আল্লাহ তাঁকে সম্বোধন করে বলেছেন—
وَمَآ أَرْسَلْنَـٰكَ إِلَّا رَحْمَةًۭ لِّلْعَـٰلَمِينَ

“আমি তো আপনাকে সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছি। ” (সুরা আল-আম্বিয়া, আয়াত : ১০৭)

আঁধারের পৃথিবীতে আলো ঝলকানি

মক্কার বুকে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্ম হয়েছিল এমন সময়ে, যখন গোত্রীয় যুদ্ধ ছিল নিত্যদিনের ঘটনা, সমাজ ছিল মদ ও জুয়ায় নিমজ্জিত, অমানবিকতার চরম রূপে পৌছে গিয়েছিল দাসপ্রথা।

আর নারী ছিল অবমাননার প্রতীক। কন্যাশিশু জন্মালেই মাটিচাপা দিয়ে ফেলা হতো। ইতিহাসবিদ ইবনে হিশাম লিখেছেন, আরব সমাজ ছিল তখন ‘জাহেলিয়াতের মরুভূমি’—যেখানে ন্যায়, সত্য, মানবতা কিছুই টিকে ছিল না।
এই অবস্থায় মহানবী (সা.) এলেন জ্ঞানের আহ্বান নিয়ে।

প্রথম ওহি ছিল— “পড়ো, তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। ” (সুরা আল-‘আলাক, আয়াত : ১)
এ এক বৈপ্লবিক আহ্বান—অজ্ঞতার আঁধার ভেদ করে জ্ঞানের আলোয় মানবতাকে উন্মোচনের ডাক।

সীমাহীন দয়ার প্রতীক

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন মানবতার জন্য এক মহাগ্রন্থ। তিনি ছিলেন সীমাহীন দয়ার প্রতীক। শত্রুর প্রতিও তাঁর হৃদয় ভরে ছিল করুণায়।

তায়েফের পথে যখন তাঁকে পাথর ছুড়ে রক্তাক্ত করা হলো, তখন ফেরেশতা পাহাড় চাপিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু নবী (সা.) তাদের ক্ষমা করে দিয়ে তাদের জন্যেই আল্লাহর কাঝে হেদয়ায়েতের দোয়া করলেন আর বললেন:  “আমি আশা করি এদের সন্তানদের মধ্য থেকে এমন এক প্রজন্ম জন্ম নেবে যারা এক আল্লাহর ইবাদত করবে। ” (বুখারি, হাদিস :৩২৩১। )
এমন উদাহরণ মানব ইতিহাসে বিরল। ইবনে কাসীর মন্তব্য করেছেন, নবীজির দয়া ও ক্ষমাশীলতা ছিল “অসীম সমুদ্রের মতো, যার সীমা কেবল আল্লাহ জানেন। ”

নারী-শিশু ও দুর্বলদের মুক্তিদাতা

নারীকে তিনি মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন। হাদিসে বলেছেন— “তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি সর্বোত্তম, যে তার স্ত্রীর সঙ্গে উত্তম আচরণ করে। ” (তিরমিজি, হাদিস: ৩৮৯৫)

শিশুদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল সীমাহীন। তিনি বলেছেন— “যে আমাদের ছোটদের প্রতি দয়া করে না এবং বড়দের সম্মান করে না, সে আমাদের দলভুক্ত নয়। ” (আবু দাউদ, হাদিস: ৪৯৪৩)

দাসপ্রথার বিরুদ্ধে তিনি বিপ্লবী পরিবর্তন এনেছেন। দাসমুক্তিকে করেছেন শ্রেষ্ঠ ইবাদতের অংশ। একাধিক আয়াতে আল্লাহ দাসমুক্তিকে তাকওয়ার নিদর্শন হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

রাষ্ট্রনায়ক ও ন্যায়বিচারক

মদিনায় হিজরত করে তিনি যে রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিলেন, তা ছিল মানবতার ইতিহাসে প্রথম বহুধর্মীয় সমাজচুক্তি। ‘মদিনার সনদ’ প্রমাণ করে, ইসলামী রাষ্ট্র কেবল মুসলিমদের জন্য নয়, বরং সব সম্প্রদায়ের জন্য ন্যায় ও নিরাপত্তার প্রতীক। ইমাম গাজ্জালী লিখেছেন, মহানবী (সা.) -এর রাষ্ট্রদর্শন মানব ইতিহাসে ন্যায়বিচারের সর্বোচ্চ উদাহরণ।

তাঁর ন্যায়বিচার ছিল অসাধারণ। একবার এক প্রভাবশালী মহিলা চুরির অপরাধ করলে অনেকে শাস্তি লঘু করার সুপারিশ করেছিল। তখন রাসুল (সা.) বললেন— “আল্লাহর কসম! যদি আমার কন্যা ফাতিমা-ও চুরি করত, তবে আমি তার হাত কেটে দিতাম। ” (বুখারি, হাদিস : ৬৭৮৮)

এমন ন্যায় মানবসভ্যতা কবে দেখেছে?

মানবতার পথপ্রদর্শক

মহানবী (সা.) প্রমাণ করেছেন—ক্ষমতা মানে জুলুম নয়, বরং দায়িত্ব; সম্পদ মানে ভোগ নয়, বরং আমানত; শক্তি মানে নির্যাতন নয়, বরং দুর্বলকে রক্ষা করা। আল্লামা ইকবাল তাঁর শায়েরিতে বলেছেন—  “মুহাম্মদ (সা.)-এর দৃষ্টিতে মানবজাতি এক দেহের মতো। যেখানে ব্যথা লাগে, সেখানেই সমগ্র দেহ কেঁপে ওঠে। ”

আজকের বিশ্বে নববী আদর্শের প্রয়োজনীয়তা

পৃথিবী আজ আবার অশান্ত। যুদ্ধ, বৈষম্য, নারী নির্যাতন, বর্ণবাদ, ভোগবাদে মানুষ দিশাহারা। কোটি কোটি শিশু ক্ষুধার্ত, নারী নিপীড়িত, দুর্বলরা পিষ্ট। মানবসভ্যতা যেন আবার জাহেলিয়াতের আঁধারে নিমজ্জিত।

এই অন্ধকার ভেদ করতে পারে কেবল নবীজির আলো। তাঁর শিক্ষা যদি প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে পৃথিবী আবার শান্তির বাগানে রূপ নেবে। তাঁর বাণীই আমাদের বলে— “তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে নিজের জন্য যা চায়, তা-ই তার ভাইয়ের জন্যও না চায়। ” (বুখারি, হাদিস : ১৩; মুসলিম, হাদিস: ৪৫)

এ বাণীতে রয়েছে মানবতার শ্রেষ্ঠ সংবিধান।

মানবতা আজ ত্রাণকর্তার খোঁজে। অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—এ পৃথিবীতে কেবল একজনই মানবতার প্রকৃত ত্রাণকর্তা ছিলেন, তিনি হলেন মুহাম্মদ (সা.)। তাঁর দয়া, তাঁর ন্যায়, তাঁর সত্য—এসবই আমাদের মুক্তির একমাত্র আশ্রয়। আল্লাহর কাছে আমাদের প্রার্থনা—তিনি যেন আমাদের অন্তরে নবীজির ভালোবাসা ও আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেন, যেন তাঁর দেখানো পথে চলেই আমরা মানবতার মুক্তি ও শান্তি অর্জন করতে পারি।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।