ইসলামের ইতিহাসে ‘সোনালি যুগ’ বলতে মূলত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকালের পর চার খলিফার শাসনকালকে (খুলাফায়ে রাশেদা) বোঝানো হয়। প্রায় ৩০ বছরব্যাপী এই সময়কালকে ইসলামের স্বর্ণযুগ বলা হয়।
কোরআন ও হাদিসে নেতৃত্ব নির্বাচনের মূলনীতি
ইসলামে নেতৃত্ব (ইমামত বা খিলাফত) একটি আমানত। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দেন, তোমরা আমানত তাদের কাছে পৌঁছে দাও, যারা এর হকদার। ’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৫৮)
এ আয়াতের আলোকে নেতৃত্ব বা শাসনক্ষমতা এমন ব্যক্তির হাতে ন্যস্ত করতে হবে, যে প্রকৃত যোগ্য ও আমানতদার।
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যখন দায়িত্ব অযোগ্য ব্যক্তির হাতে তুলে দেওয়া হবে, তখন কিয়ামতের প্রতীক্ষা করো।
(বুখারি, হাদিস : ৬৪৯৬)
অতএব, নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে যোগ্যতা, তাকওয়া, জ্ঞান, ন্যায়বিচার ও দক্ষতা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথম খলিফা: আবু বকর (রা.)-এর নির্বাচন
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকালের পর মুসলমানরা এক বিরাট শূন্যতার মধ্যে পড়ে যায়। তখন সাহাবারা সাকিফা বানু সাইদাহ এলাকায় সমবেত হন। আনসাররা প্রস্তাব দেন-একজন নেতা আনসার থেকে, একজন নেতা মুহাজির থেকে করা হোক।
এ সময় উমর (রা.) ও আবু উবাইদাহ (রা.) আবু বকর (রা.)-এর হাত ধরে বলেন, ‘আমাদের মধ্যে রাসুল (সা.) ইমাম বানিয়েছিলেন তাঁকেই। সুতরাং আমরা তাঁকে নেতা মানতে সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত। ’ আনসাররাও ঐকমত্যে রাজি হন। সবার সম্মতিতে আবু বকর (রা.) প্রথম খলিফা নির্বাচিত হন।
পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য
এক. শুরা বা পারস্পরিক পরামর্শের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত।
দুই. মুহাজির ও আনসারদের সর্বসম্মতি।
তিন. যোগ্যতা ও রাসুল (সা.)-এর নৈকট্যের ভিত্তিতে নির্বাচন।
দ্বিতীয় খলিফা : উমর ফারুক (রা.)-এর নির্বাচন
খলিফা আবু বকর (রা.) মৃত্যুশয্যায় উম্মাহর জন্য একজন উত্তরসূরি নির্ধারণ করার প্রয়োজন অনুভব করেন। তিনি উম্মাহর মতামত নিয়ে, শীর্ষ সাহাবিদের সঙ্গে পরামর্শ করে উমর (রা.)-কে মনোনীত করেন। তবে এটি ছিল নিছক মনোনয়ন, চাপিয়ে দেওয়া নয়। আবু বকর (রা.) বলেন, ‘আমি তোমাদের জন্য উমর ইবনুল খাত্তাবকে মনোনীত করছি। যদি তোমরা তাকে গ্রহণ করো, তবে সে-ই তোমাদের জন্য উত্তম। ’ মুসলমানরা সর্বসম্মতভাবে উমর (রা.)-কে খলিফা হিসেবে গ্রহণ করে।
পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য
এক. পূর্ববর্তী খলিফার মনোনয়ন।
দুই. শীর্ষ সাহাবিদের সঙ্গে পরামর্শ।
তিন. উম্মাহর সর্বসম্মতি ও বায়াত।
তৃতীয় খলিফা: উসমান গনি (রা.)-এর নির্বাচন
উমর (রা.) ইন্তেকালের আগে খলিফা নির্বাচনের জন্য ছয়জন বিশিষ্ট সাহাবির একটি ‘শুরা পরিষদ’ গঠন করেন। সদস্যরা ছিলেন:
এক. উসমান ইবনে আফফান (রা.)
দুই. আলী ইবনে আবি তালিব (রা.)
তিন. আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.)
চার. সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.)
পাঁচ. জুবাইর ইবনে আওয়াম (রা.)
ছয়. তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ (রা.)।
এ কমিটি পরামর্শ করে সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) মুসলমানদের মতামত সংগ্রহ করেন। বেশির ভাগের মত ছিল: উসমান (রা.)। সুতরাং সর্বসম্মতিক্রমে তিনি তৃতীয় খলিফা নির্বাচিত হন।
পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য
এক. নির্বাচনী পরিষদ (শুরা)।
দুই. মুসলমানদের মতামত গ্রহণ।
তিন. সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে খলিফা নির্বাচন।
চতুর্থ খলিফা: আলী (রা.)-এর নির্বাচন
উসমান (রা.)-এর শাহাদাতের পর মুসলমানরা গভীর সংকটে পড়ে। তখন মদিনার জনগণ ও সাহাবিরা আলী (রা.)-কে খলিফা হতে অনুরোধ করেন। তিনি প্রথমে অস্বীকৃতি জানান; কিন্তু উম্মাহর চাপ ও ঐকমত্যে অবশেষে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য
এক. উম্মাহর স্বতঃস্ফূর্ত দাবি।
দুই. সাধারণ জনগণ ও সাহাবিদের সম্মিলিত বায়াত।
তিন. সংকটকালে ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন।
সোনালি যুগে খলিফা নির্বাচনের মূলনীতি
এক. শুরা ও পরামর্শ : প্রতিটি নির্বাচনে শীর্ষ সাহাবিদের পরামর্শ ও সাধারণ মুসলমানদের মতামত গুরুত্ব পেয়েছে।
দুই. যোগ্যতার ভিত্তি : বংশ বা সম্পদের ভিত্তিতে নয়; তাকওয়া, জ্ঞান, নেতৃত্বগুণ ছিল মূল শর্ত।
তিন. সর্বসম্মতি বা সংখ্যাগরিষ্ঠ মত : আবু বকর (রা.), উসমান (রা.) ও আলী (রা.)-এর ক্ষেত্রে দেখা যায়, সাধারণ মুসলিম জনতার সমর্থন অপরিহার্য ছিল।
চার. অমানতদারি ও দায়িত্ববোধ : নেতৃত্ব ছিল সেবা, শাসন নয়; দায়িত্ব, সুবিধা নয়।
সোনালি যুগের নির্বাচন পদ্ধতির শিক্ষণীয় দিক
এক. গণতান্ত্রিক চেতনা : যদিও আধুনিক অর্থে গণতন্ত্র ছিল না, তবে জনগণের মতামতের প্রতিফলন ছিল সুস্পষ্ট।
দুই. ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর : সশস্ত্র বল প্রয়োগে নয়, বরং পরামর্শ ও ঐকমত্যে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছে।
তিন. ন্যায়ভিত্তিক নেতৃত্ব : প্রত্যেক খলিফা ছিলেন ন্যায়পরায়ণ, আমানতদার ও যোগ্য নেতা।
চার. দলীয় বিভাজনহীনতা : শুরুতে মুসলিম সমাজ এক কাতারে থেকে নেতৃত্ব গ্রহণ করেছে, যদিও পরে রাজনৈতিক ভিন্নমত দেখা দেয়।
পাঁচ. জনস্বার্থ প্রাধান্য : প্রতিটি নির্বাচনেই মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ ছিল মুখ্য বিবেচ্য।
ইসলামের শিক্ষা
সোনালি যুগের খলিফা নির্বাচন পদ্ধতি ছিল মানব ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। এখানে রাজতন্ত্র বা বংশানুক্রমিক শাসন ছিল না; ছিল না একনায়কতন্ত্র বা ক্ষমতার জবরদখল। বরং ছিল পরামর্শ, যোগ্যতার মর্যাদা, জনগণের মতামত এবং ন্যায়নিষ্ঠ নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য। ইসলামের মূল শিক্ষা হলো-নেতৃত্ব একটি আমানত, যা শুধু যোগ্য ব্যক্তির হাতে ন্যস্ত হতে হবে।
আজকের পৃথিবীতে রাজনৈতিক অস্থিরতা, স্বার্থান্বেষী নেতৃত্ব ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দূর করতে চাইলে সোনালি যুগের খলিফা নির্বাচন পদ্ধতি থেকে শিক্ষা নেওয়া অপরিহার্য।
পরিশেষে বলা যায়, খলিফা নির্বাচন পদ্ধতির এই ইতিহাস শুধু মুসলমানদের জন্য নয়; বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য একটি দিকনির্দেশনা, যা ন্যায়, সাম্য ও মানবকল্যাণের আদর্শ প্রতিষ্ঠায় সহায়ক।
লেখক: মুহতামিম, জহিরুল উলুম মহিলা মাদরাসা, গাজীপুর
এসআই