ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইসলাম

এগুলো হাদিস নয়, তবে হাদিস হিসেবে প্রচলিত

মাহফুজ আবেদ, অতিথি লেখক, ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০১৬
এগুলো হাদিস নয়, তবে হাদিস হিসেবে প্রচলিত

হাদিস বলা হয় শেষ নবী হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা, কাজ ও কোনো কাজের প্রতি সমর্থন কিংবা মৌন সম্মতিকে। আর যে হাদিসটি নির্ভরযোগ্য ও পূর্ণ স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন বর্ণনাকারী বর্ণনা করেছেন. যার সনদ পরস্পর সম্পৃক্ত, তার মধ্যে গোপন কোনো ত্রুটি নেই এবং তা অন্য কোনো অধিকতর নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীর বর্ণনার বিরোধীও নয়- তাকে সহিহ হাদিস বলে।



প্রসিদ্ধ হাদিস গ্রন্থগুলো হলো- সহিহ বোখারি, সহিহ মুসলিম, সুনানে তিরমিজি, সুনানে আবু দাউদ, সুনানে নাসাঈ ও সুনানে ইবনে মাজাহ। এই ছয়টি গ্রন্থকে একত্রে সিহাহ সিত্তা বলা হয়। এ ছাড়াও আরও কয়েকটি প্রসিদ্ধ হা‍দিস গ্রন্থ হলো- মুসনাদে আহমাদ, মুয়াত্তা মালেক, দারাকুতনি, সুনানে দারেমি ও সুনানে বায়হাকি।

আর জাল হাদিস বলা হয়, যে কথাটি মানুষ তৈরি করেছে, অতঃপর সেটা তা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। জাল হাদিস মূলত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী নয়। এগুলো মানুষের বানানো কথা। মুহাদ্দিসরা একে ‘মাওযু’ নামে অভিহিত করেছেন। ‘মাওযু’ শব্দটি আরবি। যা মূলধাতু ‘ওয়াযাআ’ হতে নির্গত। এর আভিধানিক অর্থ তৈরি করা, সৃষ্টি করা, বানানো ইত্যাদি।

লিসানুল আরব গ্রন্থে উল্লেখ হয়েছে, এটি ‘উঁচু’ এর বিপরীতার্থক শব্দ। মাওযু হাদিসের পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে, ইমাম ইবনে সালাহ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ‘মনগড়া ও বানোয়াট হাদিসকে মাওযু বলা হয়। ’ -মুকাদ্দামায়ে ইবনে সালাহ : পৃ. ৭৭

মুহাদ্দিস আল্লামা জাফর আহমদ ওসমানি (রহ.) বলেন, ‘নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণীর নামে স্বেচ্ছায় মিথ্যা কথা বানানো হয়েছে, এমন হাদিসকে মাওযু বলা হয়। ’ -মুকাদ্দামায়ে ইলাউস সুনান : ১/২৯

উপরোক্ত সংজ্ঞাসমূহে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, স্বেচ্ছায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামে মনগড়া-বানানো মিথ্যা বাণীর প্রচার-প্রসারকে জাল হাদিস বলা হয়।

মুহাদ্দিসগণ এ ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, স্বেচ্ছায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামে মানব সমাজে মিথ্যা ও বানোয়াট হাদিস বানিয়ে প্রচার-প্রসার করা জঘন্যতম অপরাধ; যা কবিরা গুনাহের শামিল।

কারণ, এটি এমন একটি মহাঅপরাধ, যার চূড়ান্ত পরিণতি হলো জাহান্নাম। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ প্রসঙ্গে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার প্রতি স্বেচ্ছায় মিথ্যারোপ করে, সে যেন নিজেই জাহান্নামে তার স্থান বানিয়ে নেয়। ’ –সহিহ বোখারি : ১/৩১৭

অতএব, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামে মিথ্যা ও বানোয়াট হাদিস বানিয়ে প্রচার-প্রসার করা সম্পূর্ণ হারাম। -আল-ওয়াজউ ফিল হাদিস : ১/৩১৭

এ জঘন্যতম অপরাধ তথা জাল হাদিস প্রচার-প্রসারের প্রারম্ভিক কাল সম্পর্কে কয়েকটি মতামত রয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য মত হচ্ছে, হিজরি ১ম শতাব্দীর চল্লিশের দশকের পর মিথ্যা বা জাল হাদিসের সূচনা হয়। বর্তমানে এ অপকর্মের সঙ্গে যোগ দিয়েছে মুসলিম নামধারী কিছু ভণ্ড ও প্রতারক। তারা এসব জাল হাদিসকে ব্যবহার করে তাদের অসৎ স্বার্থ হাসিলের অপচেষ্টায় লিপ্ত। আবার এক শ্রেণীর অসচেতন আলেমের দ্বারাও তাদের অজান্তে কিছু জাল হাদিস জনসমাজে ছড়িয়ে পড়ছে।

কিন্তু উলামায়ে কেরামের সতর্কতামূলক পদক্ষেপ ও নিরলস প্রচেষ্টার ফলে বরাবরই তাদের এ ধরনের অপপ্রয়াস ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে। কেননা, প্রত্যেক যুগে বিদগ্ধ মুহাদ্দিসরা এসব জাল হাদিসের বিষয় সমসাময়িক মানুষকে সতর্ক করেছেন। বস্তুত আল্লাহতায়ালা দ্বীন ইসলামকে হেফাজত করার ওয়াদার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছেন এর মাধ্যমে।

তবে অনেক সময় সেসব জাল হাদিস সম্পর্কে অনবহিত ও অসচেতনার ফলে বিপথগামী হতে হয় অনেককেই। এ জন্য বহুল প্রচলিত কয়েকটি জাল হাদিসের পরিচয় দেওয়া হলো-

১. জ্ঞান অর্জনের জন্য সুদূর চীনে যেতে হলেও যাও (তবে জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব প্রসঙ্গে প্রচুর হাদিস রয়েছে)।
২. জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়ে বেশি পবিত্র (এ জাতীয় ভিন্ন বর্ণনা রয়েছে, তবে এ বর্ণনা নেই)।
৩. সবুজ গাছপালা ও শস্যের দিকে তাকিয়ে থাকলে দৃষ্টি শক্তি বৃদ্ধি পায়।
৪. আল্লাহ ওই বান্দাকে ভালবাসেন, যে তার ইবাদতে ক্লান্ত, নিস্তেজ হয়ে পড়ে। ‍ৎ
৫. আজানের মধ্যে আঙ্গুল চুম্বন করে চোখে মোছা ফজিলতের কাজ।

৬. এক ঘণ্টা গভীরভাবে চিন্তা করা ৬০ বছর ইবাদতের সমান।
৭. যারা মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দেয় এবং মানুষকে ইসলাম গ্রহন করায় তাদের জন্য জান্নাত নিশ্চিত।
৮. পাগড়ী পরিধান করে নামাজ আদায় করেল ১৫টি পাগড়ী ছাড়া নামাজ আদায়ের সমান সওয়াব।
৯. আমার উম্মতের আলেমরা বনি ইসরাইলিদের নবীদের সমান।
১০. আমি তোমাদেরকে দু’টি উপশম বলে দিলাম- মধু এবং কোরআন।

১১. যদি আরবদের অধঃপতন হয়, তাহলে ইসলামেরও অধঃপতন হবে।
১২. যে কোরআন শেখানোর জন্য কোনো পারিশ্রমিক নেয়, সে কোরআন শিখিয়ে আর কোনো সওয়াব পাবে না।
১৩. বিয়ে করো, আর কখনও তালাক দিয়ো না, কারণ তালাক দিলে আল্লাহর আরশ কাঁপে।
১৪. যে বরকতের আশায় তার ছেলের নাম মুহাম্মদ রাখবে সে এবং তার ছেলে জান্নাত পাবে।
১৫. যে স্ত্রী তার স্বামীর অনুমতি না নিয়ে ঘরের বাইরে যায়, সে ফেরত না আসা পর্যন্ত আল্লাহর অসন্তুষ্টিতে থাকবে বা যতক্ষণ না তার স্বামী তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়।

১৬. যদি নারী জাতি না থাকতো, তাহলে আল্লাহর যথাযথ ইবাদত হতো।
১৭. নারীর উপদেশ মেনে চললে অনুশোচনায় ভুগবে।
১৮. দুনিয়া আখেরাতের ফসলি ভূমি।
১৯. আলেমরা ব্যতীত সব মানুষই ধ্বংসের পথে। আমলকারীরা ব্যতীত আলেমরাও ধ্বংসের পথে। মুখলিসরা ব্যতীত আমলকারী আলেমরাও ধ্বংসের পথে। আর মুখলিসরাও আছেন ভীষণ ভয়ের মধ্যে।
২০. মসজিদে অপ্রয়োজনীয় কথা বললে তা সৎকাজগুলোকে ধ্বংস করে, যেভাবে প্রাণী ঘাস সাবাড় করে।

এই হাদিসগুলো কেন জাল করা হয়েছে, কারা জাল করেছে এবং কোন হাদিস বিশারদরা জাল প্রমাণ করেছেন- তারও বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে।

অনেক ওয়ায়েজ ও বক্তাদের মুখে এগুলো হাদিস হিসেবে বলতে শোনা যায়। অনেকে লেখার মাঝেও এগুলো হাদিস হিসেবে বর্ণনা বরে থাকেন। কিন্তু হাদিসের গ্রন্থসমূহে অনুসন্ধান করলে হাদিস হিসেবে এসবের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।

আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে সহিহ হাদিসের ওপর আমল করার তওফিক দান করুন। আমিন।



বাংলাদেশ সময়: ১৭১৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২০, ২০১৬
এমএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।