মানুষ সামাজিক জীব। দুনিয়ায় সুখে-শান্তিতে জীবনযাপন করতে মানুষকে একে-অন্যের দারস্থ হতে হয়।
এর বিপরীতে অনেকেই মানুষের ক্ষতি করে এক ধরনের বিকৃত তৃপ্তি পায়। এমন মানসিকতা অসুস্থ্য মনের পরিচায়ক। পরিবেশের কারণে, আদর্শহীন শিক্ষার কারণে মানুষ এ ধরণের রোগে আক্রান্ত হয়।
একজন মানুষের একটু অনুরোধ, একটু সুপারিশ, দু-এক মিনিটের একটি ফোন কল, এক লাইনের একটি নোট, একটি স্বাক্ষর ক্ষেত্রবিশেষ কোনো বিপদগ্রস্থ মানুষকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারে। একজন শিক্ষিত তরুণের চাকুরির ব্যবস্থা হতে পারে। কারো কোনো স্বপ্ন পূরণ হতে পারে। মানুষ হিসেবে অন্য মানুষের উপকারার্থে সামান্য এই কাজটুকু কি নিঃস্বার্থভাবে করা যায় না? কিন্তু না, সুপারিশের মতো সময় ও শ্রমহীন একটি সামান্য কাজও এখন আর কেউ স্বার্থ ছাড়া করতে রাজি নয়। নিঃস্বার্থভাবে কেউ কারো উপকার করার মানসিকতা লালন করে না।
সমাজের ওপর থেকে নিচের কেউ যখন বিনিময় ছাড়া সুপারিশ করে না- সে সমাজে বিনিময় গ্রহণকে স্বাভাবিক বিষয় মনে হয়। আর এ বিনিময় গ্রহণে তখন কারো বিবেকে বাঁধে না, অন্তরে ঘৃণার সৃষ্টি হয় না। সুপারিশ করে বিনিময় গ্রহণ যতটুকু সমস্যা, তার চেয়ে বড় সমস্যা হলো- এ কাজকে অন্যায় মনে না করা। কাজটিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে না দেখা। মানুষের স্বাভাবিক চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির এমন অধঃপতন বর্তমান সময়ের এক জটিল সামাজিক সমস্যা।
আগে বলা হতো- ‘মামু নাই যার- চাকুরি নাই তার’। তখনকার মামুরা বিনে পয়সায় ভাগ্নে-ভাগ্নিদের চাকুরি মিলিয়ে দিতেন। ব্যাপারটিতে সততা নিয়ে আপত্তি থাকলেও সম্পর্ক ও পরিচয়ের একটা নির্মোহ মূল্যায়ন ছিলো। কিন্তু হাল সময়ে মামা-ভাগ্নের সম্পর্কও এখন নিরস হয়ে যাচ্ছে, নির্জীব হয়ে উঠছে। এখন আর বিনিময় ছাড়া ওসব চলে না।
এই তো কিছুদিন আগেও শোনা যেত, সরকারি দল করলে চাকুরি হয়। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, সে আশায়ও গুঁড়েবালি। এখন দলীয় পরিচয়ও অর্থলিপ্সার সামনে পরাজিত। চাকুরির বাজারে এখন একটাই মানদণ্ড, আর সেটা হচ্ছে- অর্থ, অর্থ এবং অর্থ।
পরিস্থিতি এখন এতটাই ভয়াবহ রূপ নিয়েছে যে, সমাজের দরিদ্র ও নিম্নবিত্তদের তো কথাই নেই। নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির শিক্ষিত মেধাবীরা চাকুরির বাজারে অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে- শুধুমাত্র অর্থের অভাবে। যাদের পারিবারিক বিত্ত নেই, তাদের সন্তানদের জন্য লেখাপড়া এখন অহেতুক বিলাসিতা মাত্র। বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থায় তাদের কাঙ্খিত স্বপ্নপূরণ হচ্ছে না। যদি কারো ক্ষেত্রে হয়ও তবে তা সোনার হরিণ লাভের মতো বিরল সৌভাগ্যের ব্যাপার।
বাস্তবতা হলো, যে পরিমাণ অর্থ খরচ করে সুপারিশের মাধ্যমে চাকুরি নেওয়া হয়; চাকুরির স্বাভাবিক বেতন দিয়ে তা পূরণ করতে দীর্ঘ সময় দরকার। তাই সুপারিশের মাধ্যমে এমন বিনিময় প্রথা পরোক্ষভাবে দুর্নীতিকে উৎসাহিত করছে। শুধু উৎসাহিত নয়, চাকুরিজীবিকে দুর্নীতি করতে বাধ্য করছে, কর্মজীবনে ঘুষ নিতে বাধ্য করছে।
শেষ নবী হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি কারো জন্য সুপারিশ করল, অতঃপর সে সুবাদে তাকে কোনো কিছু উপহার দেওয়া হলো- আর সে তা গ্রহণ করলো সে সুদের বড় দরজা দিয়ে প্রবেশ করল। ’ সুনানে আবু দাউদ: ৩৫৪৩
আর সুদ সম্পর্কে হাদিসে বলা হয়েছে, ‘সুদের সর্বনিম্ন স্তর হলো- মায়ের সঙ্গে ব্যাভিচার করার তুল্য। ’
বর্ণিত হাদিস দু’টোকে একসঙ্গে মিলিয়ে দেখলে খুব সহজেই বুঝে আসে, সুপারিশের বিনিময় গ্রহণ করা কতো নিকৃষ্টতম ও জঘন্যতম গর্হিত অপরাধ। এ বিনিময় একদিকে দুর্নীতিকে লালন করে। অন্যদিকে দরিদ্র এবং অসহায়দের স্বচ্ছল হওয়ার পথ রুদ্ধ করে দেয়। যা দারিদ্র্য বিমোচন ও আর্থসামাজিক বৈষম্যরোধের বড় অন্তরায়।
বাংলাদেশ সময়: ১৯২৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০১৬
এমএ/