ইসলাম অন্যান্য অধিকারের মতো শ্রমিক অধিকারের ব্যাপারেও অত্যন্ত সোচ্চার। শ্রমিকের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে খুবই কঠোর।
এ প্রসঙ্গে হাদিসে কুদসিতে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘কিয়ামতের দিন তিন শ্রেণির মানুষের ব্যাপারে আমি নিজে অভিযোগ উত্থাপন করব-
এক. যে ব্যক্তি আমার নামে অঙ্গিকার করার পর তা ভঙ্গ করেছে।
দুই. যে ব্যক্তি কোনো স্বাধীন মানুষকে বিক্রি করে মূল্য ভোগ করেছে।
তিন. যে ব্যক্তি শ্রমিক দিয়ে কাজ করানোর পর, পাওনা পরিশোধ করেনি। ’-সুনানে সুগরা লিল বাইহাকি: ২/১৪০
শ্রমিকের অধিকারগুলোর মাঝে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হলো- তার পারিশ্রমিক। পারিশ্রমিক প্রদানের ক্ষেত্রে মালিক দু’টি আবশ্যকীয় বিষয় নিশ্চিত করবে।
এক. সময়মতো পারিশ্রমিক প্রদান করবে। পারিশ্রমিক দিতে বিলম্ব করবে না। যে সব শ্রমিক নিয়মিত কাজ করে এবং তাদের বেতন মাস হিসেবে নির্দিষ্ট করা; মাস শেষ হওয়া মাত্রই তাদের বেতন দিয়ে দিতে হবে। আর যে সব শ্রমিক নিয়মিত নয়, দিন হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত- তাদের দিন শেষ হওয়া মাত্রই বেতন দিয়ে দিতে হবে। এক কথায়, কাজ হিসেবে শ্রমিককে কাজে লাগালে কাজ শেষ হওয়া মাত্রই নির্ধারিত বেতন দিতে হবে।
দুই. চুক্তিমতো পারিশ্রমিক প্রদান। পূর্ব নির্ধারিত পারিশ্রমিকের চেয়ে কম দিবে না। বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান, কলকারখানাগুলোতে অনেক সময় দেখা যায়, মালিক পক্ষের কর্মকর্তরা অসহায় গরিব শ্রমিকদের ওপর জুলুম করে। কোনো শ্রমিক কোনো কারণে উপস্থিত হতে পাঁচ-দশ মিনিট বিলম্ব করলে তার হাজিরা কেটে দেয়। সারাদিন কাজ করার পরও মাস শেষে সে দিনের বেতন তাকে দেওয়া হয় না। এটা অমানবিক নীতি। ইসলাম এটা সমর্থন করে না।
প্রায়ই দেখা যায়, ঈদের আগে পোশাক খাতের শ্রমিকরা পথে এসে আন্দোলন করে। ঈদের পূর্বেই বেতন-বোনাস পরিশোধের দাবি করে। ব্যাপারটি মালিকদের জন্য অত্যন্ত লজ্জার। মুসলিম মালিকদের জন্য আরও বেশি লজ্জার। যে গরিব মানুষগুলো নিজেদের পরিশ্রমে মালিকের সম্পদ বৃদ্ধিতে সাহায্য করছে, তার নিত্যদিনের প্রয়োজন এমনকি বিলাসিতার যোগান দিচ্ছে; ঈদের আগে নিজেদের সামান্য বেতন ও বোনাসের কয়টা টাকার জন্য তারা কেন উদ্বিগ্ন থাকবে?
যে শ্রমিকের খাওয়া-পরা মালিকের দায়িত্বে সে শ্রমিকের খাওয়া-পরার ব্যাপারে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুস্পষ্ট নির্দেশ হলো- ‘তোমরা যা খাবে তাদেরও তা খেতে দিবে। তোমরা যা পরবে তাদেরও তা পরতে দিবে। ’ –সুনানে আবু দাউদ: ৫১৬৩
সাধারণত বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের খাওয়া-পরা মালিকের দায়িত্বে থাকে না। কিন্তু বাসা-বাড়ি, দোকান, ক্ষেত-খামার এবং ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের খাওয়া বা খাওয়া-পরা উভয়টা মালিকের দায়িত্বে থাকে। এ ক্ষেত্রে একজন ঈমানদার মালিক- যে আল্লাহ, নবী ও পরকালকে বিশ্বাস করে; সে নিজের পরিবারের জন্য রান্নার এক তালিকা আর শ্রমিকদের জন্য রান্নার আরেক তালিকা করতে পারে না।
যে খাবার মালিক নিজে খাবে, নিজের পরিবারের সদস্যদের খাওয়াবে- সেই খাবারই দোকানের কর্মচারিকে, ক্ষেতের মুজুরকে, প্রাইভেট গাড়ির ড্রাইভারকে, বাসার দারোয়ানকে, কাজের মেয়েকে খেতে দিতে হবে। বাসার কাজের মেয়েকে জামা দেওয়ার সময় হুবহু ওই জামা দিতে হবে, যে জামা মালিক কিংবা তার নিজের ঔরসজাত মেয়ে পরিধান করে। বাসার কাজের বুয়াকে শাড়ি দেওয়ার সময় হুবহু ওই শাড়ি কিনে দিতে হবে, যে শাড়ি মালিক নিজের স্ত্রীকে কিনে দেয়। প্রাইভেট গাড়ির ড্রাইভার, বাসার দারেয়ান, দোকানের কর্মচারি, কারখানার শ্রমিককে শার্ট-প্যান্ট দেওয়ার সময় হুবহু তা-ই দিতে হবে, যা মালিক নিজে ব্যবহার করে।
মনে রাখতে হবে, এটা ইসলামের নির্দেশ। এটা রাসূলের নির্দেশ। এটা রাসূলের আদর্শ। এটা সাহাবাদের জীবনাদর্শ। নিজে গোশত দিয়ে ভাত খেয়ে কর্মচারি ও ড্রাইভারদের শাক-ভর্তা খেতে দিয়ে, নিজে গরম ভাত খেয়ে বাসার কাজের মেয়েকে ঠান্ডা-বাসি ভাত খেতে দিয়ে- তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে, আর হজ করে ধার্মিক হওয়া যাবে না। নিজের মেয়েকে দু’হাজার টাকা মূল্যের জামা কিনে দিয়ে আর কাজের মেয়েকে সাত শত টাকা মূল্যের জামা কিনে দিয়ে রাসূলের অনুসারী, সুন্নতের অনুসারী হওয়া যায় না।
শ্রমিককে তার সাধ্যের অতিরিক্ত কাজ দেওয়া যাবে না। যদি দিতেই হয়ে তবে মালিক নিজে তার কাজে সহযোগিতা করবে। -সুনানে আবু দাউদ: ৫১৬০
ভুল-ত্রুটির জন্য মালিকের পক্ষ থেকে ক্ষমা পাওয়াও শ্রমিকের অধিকার। এক ব্যক্তি এসে হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, কর্মচারিকে কতবার ক্ষমা করব? রাসূল (সা.) কোনো উত্তর দিলেন না। নিরব থাকলেন। সে আবারও জিজ্ঞাসা করল। তিনি এবারও কোনো উত্তর দিলেন না। তৃতীয় বার জিজ্ঞাসা করার পর উত্তরে বললেন, ‘প্রতিদিন সত্তর বার ক্ষমা করবে। ’ –সুনানে আবু দাউদ: ৫১৬৬
বর্তমানে কল-কারখানার শ্রমিকদের মারধর করা না হলেও অনেক সুপারভাইজার শ্রমিকদের অকথ্য ভাষায়, অভদ্র ভাষায় গালাগালি করে। আবার বাসা-বাড়ির কাজের মেয়েদের ওপর দৈহিক নির্যাতন করা হয়। কিছু থেকে কিছু হলে মারধর করা হয়। শ্রমিকের ভুল-ত্রুটির জন্য তাকে মারধর করা, দৈহিক কষ্ট দেওয়া তো দূরের কথা, তাকে গালি দিতে বা কটূ কথা বলতেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন।
একদা হজরত আবু জর (রা.) তার এক ক্রীতদাসকে বকা দিলে সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে অভিযোগ দিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে কঠোর ভাষায় সতর্ক করে বললেন, ‘হে আবু জর! এখনও তোমার মাঝে জাহেলিয়্যাত বাকি আছে। সে তোমার ভাইয়ের মতো। তবে আল্লাহ তোমাকে তার ওপর সম্মানিত করেছেন। তাকে তোমার ভালো না লাগলে তুমি তাকে অন্যত্র বিক্রি করে দাও। আল্লাহর সৃষ্টিকে কষ্ট দিও না। ’ –সুনানে আবু দাউদ: ৫১৫৯
আল্লাহর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তেইশ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে লক্ষাধিক আলোকিত সোনার মানুষ গঠন করে এ নশ্বর দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নেওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে যখন তার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল, স্বর একেবারেই ক্ষিণ হয়ে গিয়েছিল, তখন উম্মতের উদ্দেশ্যে সর্বশেষ অসিয়ত করেছেন, “তোমাদের অধীনস্থদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। ’ –সুনানে আবু দাউদ: ৫১৫৮
এখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভয় বুঝানোর জন্য আরবিতে তাকওয়া শব্দ ব্যবহার করেছেন। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, শ্রমিক অধিকার রক্ষা করা মুত্তাকি, পরহেজগার, বুজুর্গ, নেককার, সালেহ ও অলি হওয়ার পূর্ব শর্ত।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০০ ঘন্টা, মে ০১, ২০১৬
এমএ/