মায়াময় ও সুন্দর ভুবনে বেঁচে থাকার কত না আকুতি মানুষের। তবু তাকে চলে যেতে হয় অর্থ, যশ, স্বজন এবং সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে।
মানবজীবন নিতান্তই ক্ষণিকের। চোখের পলকে স্বপ্নে বিভোর জীবন কখন যে ফুরিয়ে যাবে টেরও পাওয়া যাবে না। তাই প্রতিটি মানুষকে সময় থাকতে তিলে তিলে জীবনের মূল্যায়ন করতে হবে। ক্ষণিকের এ পার্থিব জীবনকে নেক আমলের ফুলে-ফসলে সাজাতে না পারলে দুনিয়াবি জীবন হবে বড় আফসোসের, আর পরকাল হবে ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক।
পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়া মানে জীবনাবসান নয় বরং প্রকৃত জীবনের সূচনা।
আল্লামা ইকবাল (রহ.) বলেন, ‘গাফেল মনে করছে মৃত্যুর মাধ্যমেই বুঝি জীবনের অবসান ঘটে, অথচ এ মৃত্যু অনন্ত জীবনের সূচনা মাত্র। ’ হজরত রাসূলে পাক (সা.) বলেছেন, ‘সে ব্যক্তিই জ্ঞানী, যে আপন নফসকে নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং মৃত্যুর পরবর্তী সময়ের জন্য আমল করে। ’
পবিত্র কোরআন ও হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, মৃত্যু মূলত একটা বিবর্তন বা পরিবর্তনের নাম। দেহ থেকে আত্মা বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর হয় তা আজাবে নিপতিত হবে নচেৎ শান্তি ও সুখ ভোগ করতে থাকবে। মৃত্যুর পর দেহের ওপর আত্মার আর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। মৃত্যুর মাধ্যমে দেহের সব অঙ্গ রুহের অবাধ্য হয়ে যায়। আত্মা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন হয় এবং আত্মীয়-স্বজন, ধন-সম্পদ, বাড়ি-গাড়ি ইত্যাদি দুনিয়াবি মায়ার বন্ধন থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়।
একজন মানুষের পার্থিব ভোগ-বিলাস ও আরাম-আয়েশই শেষ কথা নয়। সৃষ্টির প্রধান জীব মানুষ। আল্লাহর খলিফা হিসেবে দুনিয়াতে তার দায়-দায়িত্ব অনেক। মৃত্যুর কথা স্মরণ প্রতিটি মানুষকে সৎ পথে চলার পথ বাতলিয়ে দেয় এবং সঠিকভাবে দায়-দায়িত্ব পালনের ব্যালেন্স রক্ষা করে। শয়তান তাকে গাফেল করতে পারে না।
হাদিসে আছে, ‘মৃত্যুকে বেশি বেশি স্মরণ করো, তা গোনাহ মিটিয়ে দেয়। ’ তাই নির্জনে, একাগ্রচিত্তে একান্ত আপনজন, বন্ধু-বান্ধবের বিদায়ের কথা স্মরণ করতে হবে। তাদের স্মৃতিচারণ করে প্রতিটি পদক্ষেপে অগ্রসর হলে শঠতা, অন্যায়, দুর্নীতি, লোভ, পাপ ও মিথ্যা থেকে নিজেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। আমিত্বের অহঙ্কার থাকবে না এবং বাহুল্য আশায় মন ভারাক্রান্ত হবে না।
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আদম সন্তান বৃদ্ধ হয়ে যায় কিন্তু তার দু’টি বিষয় অবশিষ্ট থাকে- লোভ ও আশা। ’ যৌবনের উন্মাদনায়, লোভ ও আশার মোহে মানুষ মৃত্যুর কথা ভাবার অবকাশ পায় না। বয়সের ভারে জীবন নিস্তেজ হয়ে গেলেও লোভ ও আশা নিস্তেজ হয় না। তাই মৃত্যুর কথা ভেবে মানুষের বেশি লোভ ও অধিক আশা ত্যাগ করা উচিত।
মৃত্যু কখনও ঢাকঢোল পিটিয়ে আসবে না, মৃত্যু আসবে নীরবে। মৃত্যুর দৃশ্য থেকে প্রতিটি মানুষকে শিক্ষা নেওয়া উচিত, দুনিয়া স্থায়ীভাবে বসবাসের জায়গা নয়। এ বিষয়ে কোরআনে কারিমে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘জন্মালে মরতেই হয়। আর সে মৃত্যু শ্বাসনালী থেকে আরও নিকটবর্তী এবং সেকেন্ড থেকেও কম সময়ে সংঘটিত হয়ে থাকে। ’
বস্তুত মানুষের জীবনের রশি আল্লাহর হাতে, তিনি তা কখন টান দেবেন তা কারও জানা নেই। আজীবন মন্দ কাজ করে মাথার ওপর মৃত্যু এসে উপস্থিত হলে তখন তওবায় কাজ নাও হতে পারে। সময় থাকতে মাওলার দরবারে কাঁদতে হবে, তওবা করতে হবে। কাঁদলে রুহ সাফ হয়, কাঁদলে গোনাহ মাফ হয়। যৌবনের প্রতিটি মুহূর্তে সুস্থতায় ও অবসরে আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করতে হবে এবং গুরুত্ব দিতে হবে নেক আমলের প্রতি। যাতে অন্তিম দিবসটি শান্তিময় হয়। কালেমা মুখে মৃত্যু হয়।
মৃত্যুর স্বাদ সব মানুষকেই আস্বাদন করতে হয়েছে এবং করতে হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ইরশাদ হচ্ছে, ‘সব মানুষই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে, অতঃপর তোমরা আমারই দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে। ’ মাটির মানুষ মাটির কোলেই ফিরে যাবে, আবার মাটি থেকেই পুনরুত্থান হবে। মানুষকে আল্লাহর নিয়ামতের জবাবদিহিতার জন্য তার শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ করার জন্যই আবার সৃষ্টি করা হবে, যা অন্যসব সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন নেই। তাই কোরআনে মানুষকে সতর্ক করে বলা হয়েছে, ‘মানুষকে আমি অন্তর দিয়েছি সে অন্তর দিয়ে চিন্তা করে না, কান দিয়েছি সে কান দিয়ে শ্রবণ করে না, চোখ দিয়েছি সে চোখ দিয়ে দেখে না, তারা চতুষ্পদ জন্তুর মতো, এমনকি তার চেয়েও নিকৃষ্ট। ’ এতে প্রমাণিত হয়- মন, চোখ, কান, হাত, পা থাকলেই মানুষ হওয়া যায় না; মানুষ হওয়ার জন্য প্রয়োজন বিবেক-বুদ্ধিকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো। ভালো কাজের জন্য মানুষ দুনিয়াতেও শান্তি পাবে, আখেরাতেও মিলবে জান্নাত। আর মন্দ কাজের জন্য ইহকাল-পরকাল দু’কালেই ভুগতে হবে নরকের যন্ত্রণা।
মৃত্যুর কাছে সবাই অসহায়। তাই মৃত্যু আসার আগেই প্রত্যেকের প্রস্তুতি নিতে হবে। খোদার স্মরণে কাটাতে হবে জীবনের প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণ। মৃত্যু থেকে কেউই রেহাই পাবে না। সর্বশক্তিমানের কোনো হুকুম মানুষ রুখতে পারে না।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৪ ঘণ্টা, মে ৪, ২০১৬
এমএ/