ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলাম

ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে শরিয়তের বিধান

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩৯ ঘণ্টা, আগস্ট ১৯, ২০১৯
ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে শরিয়তের বিধান ছবি : প্রতীকী

বর্তমানে ক্রেডিট কার্ডের জনপ্রিয়তা অনেক। জেনারেল ব্যাংকিং কার্ডগুলোর মধ্যে ক্রেডিট কার্ড অন্যতম। ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। তাই ক্রেডিট কার্ডের বিষয়ে শরিয়তের মৌলিক হুকুম-বিধান জেনে নেওয়া আবশ্যক।

ক্রেডিট কার্ডের পরিচয়
ক্রেডিট কার্ড মূলত ঋণ গ্রহণের কার্ড। কার্ড ইস্যুকারী ব্যাংক তার গ্রাহককে এ কার্ডের মাধ্যমে একটি নির্ধারিত পরিমাণ ঋণ গ্রহণের নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে।

এরপর এ কার্ডধারী বিভিন্ন দোকান থেকে এই কার্ডের মাধ্যমে পণ্য ক্রয় করতে পারে। যার মূল্য কার্ডধারীর ব্যাংক পরিশোধ করে থাকে। এখানে শরিয়তের দৃষ্টিতে কার্ডধারী হলো ঋণ গ্রহীতা। আর কার্ড ইস্যুকারী ব্যাংক হলো ঋণদাতা।

নির্ধারিত সময়ে বিল পরিশোধে ব্যর্থ হলে সুদ দেওয়া
ক্রেডিট কার্ড দিয়ে কার্ডধারী যা কেনাকাটা করে থাকে তা গ্রাহকের পক্ষে তার ব্যাংক বিক্রেতাকে পরিশোধ করে দেয়। পরে গ্রাহক সে বিল ব্যাংককে পরিশোধ করে। এখানে বিল পরিশোধের দুইটি সময় থাকে। একটি হলো, মিনিমাম ডিউ। এ সময়ের মধ্যে বিল পরিশোধ করলে গ্রাহককে অতিরিক্ত কোনো ইন্টারেস্ট পে করতে হয় না। ওই সময় পার হলে ইন্টারেস্ট দিতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো, একজন মুসলিম ক্রেডিটকার্ডধারী ওই শর্তে বা চুক্তিতে ক্রেডিট কার্ড নেয়ার সময় যদি নিয়তে রাখে যে, মিনিমাম ডিউর আগেই বিল পরিশোধ করে দেবে, তবে কি ওই নিয়তে তা নেয়া জায়েজ হবে? এ প্রশ্নটি ক্রেডিট কার্ড বিষয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। মূলত এ প্রশ্নের উত্তরের ওপরই নির্ভর করছে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের বৈধতা ও অবৈধতা।

এ ব্যাপারে অগ্রগণ্য মতামত হলো— ওই চুক্তিতে ক্রেডিট কার্ড গ্রহণ জায়েজ নয়। কারণ, ওই শর্ত মেনে দস্তখত করার অর্থ একটি সুদি চুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া। চুক্তিটিই হারাম ও সুদি চুক্তি। কোনো লেনদেন হালাল-হারাম হওয়ার মূল বুনিয়াদ হলো মূল চুক্তিনামা, যা উভয়পক্ষের মাঝে আলোচনা হয়ে সিদ্ধান্ত হয়। ক্রেডিট কার্ডধারী পরে নিজেকে সুদ থেকে বাঁচালেও সে এমন এক চুক্তির সঙ্গে একমত হয়েছে, যা সুদি লেনদেন।

তাছাড়া এটিও একটি বাস্তবতা যে, বর্তমানে ৯৫ শতাংশ বা তারও বেশি ক্রেডিট কার্ডধারী সুদি কারবারে লিপ্ত। তাই এ চুক্তিতে জড়ানো যাবে না। যদিও উক্ত সুদি শর্ত নিজের ওপর বাস্তবায়নের নিয়ত না থাকে। যদি বাস্তবায়ন করা হয় তবে তো দ্বিগুণ গোনাহ। আর বাস্তবায়ন না হলেও সুদি চুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার গোনাহ তো আছেই। বর্তমান ফকিহদের অধিকাংশের রায় এটিই। প্রায় সবক’টি আন্তর্জাতিক ফিকহ ফোরামের সিদ্ধান্তও অনুরূপ।

আন্তর্জাতিক ইসলামিক ফিকহ একাডেমির বক্তব্য
জেদ্দার ১২তম ফিকহ সেমিনারে এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, ‘ক্রেডিট কার্ডের মূলে যেহেতু সুদ প্রদানের শর্ত থাকে তাই এ ধরনের ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করা যেমন নাজায়েজ, তেমনি ব্যবহারও নাজায়েজ। যদিও ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকের দৃঢ় ইচ্ছা থাকে যে, মিনিমাম ডিউর আগেই বিল পরিশোধ করে দেবে। ’

AAOIFI তাদের এ সংক্রান্ত শরিয়া স্যান্ডার্ডের ধারা ৩.৩ এ বলা হয়েছে, ‘কোনো প্রতিষ্ঠানের এমন ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করা বৈধ নয়, যার মূল চুক্তিতে এ শর্তারোপ থাকে যে, কার্ডধারী কিস্তিতে অতিরিক্ত সুদ প্রদানের শর্তে বিল পরিশোধ করতে পারবে। ’

ইসলামী ফিকহ একাডেমি ইন্ডিয়ার ব্যাংকিং কার্ডবিষয়ক ১৫তম ফিকহ সেমিনারের সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, ‘ক্রেডিট কার্ডের প্রচলিত পদ্ধতি যেহেতু সুদি লেনদেননির্ভর, তাই ক্রেডিট কার্ড বা এ ধরনের কোনো কার্ড গ্রহণ করা বা ব্যবহার করা বৈধ নয়। ’

সৌদি আরবের গবেষণা-ফতোয়ার স্থায়ী বোর্ডের বক্তব্য
সৌদি আরবের গবেষণা ও ফতোয়ার স্থায়ী বোর্ড (আল-লাজনাতুত দায়িমা লিল বুহুসিল ইলমিয়্যা ওয়াল ইফতা) তাদের এক ফতোয়ায় লিখেছে, (প্রশ্ন ছিল, মিনিমাম ডিউর আগে বিল পরিশোধ করে দিলে কোনো ফি নেই, আর না হয় অতিরিক্ত টাকা আদায় করতে হয়) ‘বিষয়টি বাস্তবে এমনি হয়ে থাকলে সেটা অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ গ্রাসের নামান্তর। এটি জাহেলি রিবা যা শরিয়তে হারামের অধীনে পড়ে যায়। জাহেলি রিবা হলো, এখন আদায় করো। নতুবা অতিরিক্ত প্রদানের শর্তে সময় নাও। সুতরাং এ ধরনের ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করা বা ব্যবহার করা জায়েজ নয়।

ওই ফতোয়ায় যারা সম্মতি প্রকাশ করেছেন তারা হলেন— সদস্য : বকর আবু যায়েদ, আবদুল আজিজ আলে শাইখ, সালেহ ফাওজান, আবদুল্লাহ ইবনে গাদইয়ান। প্রধান : আবদুল আজিজ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে বাজ (রহ.)। (ফাতাওয়া লাজনাতুত দায়িমা, প্রকাশ : চতুর্থ প্রকাশ, ২০০২ইং, ফতোয়া নং ১৭৬১১)

মুফতি তাকী উসমানীর ভাষ্য
আরব-আজমের অধিকাংশ ওলামায়ে কেরামের মতামত এরূপই। শায়খুল ইসলাম মুফতি তাকী উসমানী হাফিজাহুল্লাহর ভাষ্য। ১৪৩৫ হিজরিতে তার বিখ্যাত রচনা ‘ফিকহুল বুয়ু’ গ্রন্থে লিখেছেন—
‘ডেবিট কার্ডের যদি ব্যবস্থা না হয়, ক্রেডিট কার্ড ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যদি এ চুক্তিতে একমত না হওয়া যায় যে, ক্রেডিট কার্ড বিল সরাসরি কার্ডধারীর অ্যাকাউন্ট থেকে কেটে রাখা হবে, আবার এদিকে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের তীব্র প্রয়োজনও দেখা দেয়, তাহলে আশা করা যায়, মিনিমাম ডিউতে বিল শোধ করে দেবে এ নিয়তে ওই চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে ক্রেডিট কার্ড গ্রহণ করলে আল্লাহর কাছে সে মাজুর হিসেবে গণ্য হবে। এটিও তখনই হবে যখন সবধরনের সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হবে, যেন সুদ দিতে না হয়। (ফিকহুল বুয়ু, পৃ. ৪৬৩)

মোদ্দাকথা, মিনিমাম ডিউতে পরিশোধের নিয়ত থাকলেও ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার জায়েজ নয়। কারণ এখানে চুক্তিটিই সুদি চুক্তি। আর কোনো চুক্তি সুদি চুক্তি হওয়াটাই একটি স্বতন্ত্র গোনাহ। এ জন্যই জেনারেল ব্যাংকের প্রাপ্ত সুদ সদকা করে দেবে এ নিয়তেও তাতে অ্যাকাউন্ট খোলা বৈধ নয়।

অবশ্য কখনও এমন হয় যে, ক্রেডিট কার্ড ছাড়া কাজ হয় না। যেমন, অনলাইনে পেমেন্ট করা। এসব ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত শর্তসাপেক্ষে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার বৈধ হবে। শর্তগুলো হলো—

এক. বৈধ কোনো প্রয়োজন থাকা, যা ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সমাধা করা সম্ভব নয়।
দুই. ডেবিট কার্ডে সমাধা না হওয়া।
তিন. ক্রেডিট কার্ডে ডাইরেক্ট ডেবিটের ব্যবস্থা করতে না পারা।
চার. মিনিমাম ডিউতে বিল পরিশোধ করতে হবে।
পাঁচ. মিনিমাম ডিউর মধ্যেই যেন বিল পরিশোধ করা সম্ভব হয় এ জন্য সর্বদিকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
ছয়. প্রয়োজন পরিমাণ কাজেই এর ব্যবহার সীমাবদ্ধ রাখা।
এই ৬টি শর্তে তীব্র প্রয়োজনের সময় সাময়িকভাবে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করা যাবে।

প্রকাশ থাকে যে, এখানে শুধু জেনারেল ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তাছাড়া কার্ড সংক্রান্ত আরও অনেক শরিয়া আছে, যা এখানে আলোচনা করা হয়নি। পাঠকদের অনুরোধ করব, বিস্তারিত জানতে কোনো বিজ্ঞ মুফতির সঙ্গে যোগাযোগ করতে।

লেখক: ফতওয়া-গবেষক ও মাদরাসাশিক্ষক

ইসলাম বিভাগে লিখতে পারেন আপনিও। লেখা পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৮ ঘণ্টা, আগস্ট ১৯, ২০১৯
এমএমইউ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।