ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইসলাম

কফির আবিষ্কারক ছিলেন এক মুসলিম রাখাল!

মুফতি মুহাম্মাদ মিনহাজ উদ্দিন, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০১৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৯
কফির আবিষ্কারক ছিলেন এক মুসলিম রাখাল!

কফি ছাড়া কেউ দিন শুরু করতে পারেন না। আবার কারো কারো রাত জাগাও কফি বিনে অপূর্ণ থেকে যায়। তুমুল জনপ্রিয়তার কারণে কফি বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা বাণিজ্যশিল্প। আধুনিক পৃথিবীতে কফির সর্বাধিক প্রচলন উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে। তবে আফ্রো-এশিয়া ও ওশেনিয়ার বহু দেশে মানুষ প্রতিদিন কফি পান করে। বিবিসির একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রতিদিন প্রায় ২০০ কোটি কাপ কফি পান হয় পৃথিবীতে।

কফির বীজ বিশ্বের সত্তরটিরও বেশি দেশে উৎপাদিত হয়। বিশেষ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গ্রিন কফির চাহিদা অপরিশোধিত তেলের পর ব্যবসায়িকভাবে ব্যবহৃত পণ্যের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।

(নাবিল মুহান্না ও লাইলি আস-সিবাই, তাসনিউ ওয়া তাবিয়াতুল কাহওয়া: ০৯/০৬/২০১৮)

ইন্টারন্যাশনাল কফি অর্গানাইজেশনের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯১ সালে সারা বিশ্বে ৬০ কেজি ওজনের কফির ব্যাগ বিক্রি হয় ৯ কোটি। আর ২০১৮ সালে সেই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ১৬ কোটিতে।

মুসলিম জ্ঞানতাপসদের কফি পান।  ছবি: সংগৃহীতঅনেক সচেতন কফিপ্রেমীও হয়তো জানেন না কফি আবিষ্কারের ইতিহাস। সর্বপ্রথম কোথায়, কখন ও কিভাবে কফি আবিষ্কার হয়েছে—তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য।

কফি যেভাবে আবিস্কার হয়
কফির আবিস্কার হয় নবম শতকে। খালেদি নামের মুসলিম এক মেষপালকের হাত ধরে। আরব-ইথিওপিয়ান এই রাখালের মেষগুলো ক্লান্ত হয়ে যেত। কিন্তু হঠাৎ দেখা গেল, মেষ-ছাগলগুলোর ক্লান্তিভাব দূর হয়ে গেছে। উদ্যমতা ও চঞ্চলতায় ভরে ওঠেছে শরীর-মন।

খালেদি এর কারণ অনুসন্ধান করতে শুরু করলেন। অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে লক্ষ্য করলেন, চেরি ফলের মতো খাচ্ছে ছাগলগুলো। ধর্মপ্রাণ ও তাপস-প্রকৃতির খালেদি গাছ থেকে কয়েকটি ফল নিয়ে নিলেন। এরপর দ্রুত হাজির হলেন স্থানীয় মসজিদের ইমামের কাছে। (উইলি, কফি ট্রি অ্যান্ড কফি: ১৪-১৫, ২০০৫)

ওসমানি খিলাফতের শাসনামলে কফি হাউজ।  ছবি: সংগৃহীতফলগুলো কাঁচা খেতে পারা সম্ভব হবে না ভেবে, ইমাম পাশে রাখা জ্বলন্ত আগুণে ফলগুলো ফেলে দেখলেন। প্রথমে ফলগুলোকে ‘শয়তানের প্রলোভন’ মনে হয়েছিল তার। কিন্তু কিছুক্ষণের ভেতর তার ধারণা পরিবর্তন হয়। আসতে থাকে বিমল সুঘ্রাণ। মুগ্ধ হতে থাকে হৃদয়-প্রাণ।  

ইমামের শিষ্যরা ফলগুলো সিদ্ধ করে খেতে চাইলেন। তাই তারা সেই বীজগুলো একটি কড়াইতে রাখলেন এবং গরম পানি দিয়ে সিদ্ধ করলেন। এভাবেই পৃথিবীর প্রথম পানীয়-কফি তৈরি হয়।

ইমাম ও তার শিষ্যরা এই আবিষ্কারে খুব খুশি ও আনন্দিত হন। পানীয়টির প্রভাবে তারা দীর্ঘ রাত জেগে অধ্যাবসায় চালিয়ে যেতে সক্ষম হলেন। ইবাদত-বন্দেগি ও প্রার্থনার জন্য অত্যন্ত কার্যকরী উপাদানের ব্যবস্থা হয় তাদের। ক্রমে এই পানীয়ের কথা বিভিন্ন দিকে ছড়াতে শুরু করে। প্রাচীন ইতিহাসের গ্রন্থগুলোতে এভাবেই উল্লেখ রয়েছে। (দ্য হিস্টোরি অব কফি, www.ncausa.org; ২০১৮/৪/৩ সম্পাদিত)

ইয়েমেনের এক সুফি-সাধকের নামও এসেছে
বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে দেখা গেছে, কফি আবিষ্কারের ক্ষেত্রে ইয়েমেনের এক সুফি-সাধকের নাম এসেছে। তার কফির আবিষ্কারের সময়কালও নবম শতাব্দী বলা হয়েছে। সেই সুফির নাম নুরুদ্দিন আবুল আল-হাসান আল-সাআদিলি। ইথিওপিয়ায় বেড়াতে গিয়েছিলেন তিনি। সুন্দর একটি পাখিকে অচেনা লাল রঙের একটি ফল খেতে দেখেন। এরপর কৌতূহলী হয়ে নিজেও সেটা খেয়ে দেখেন।  (সূত্র: আল-মাকাহি আল-আরবিয়্যা, মুলহিমাতুল মুবদিইন ওয়া মানশাউল মাদারিস আল-আদবিয়্যা)

ইয়েমেনে কফি আবিষ্কারের নথিপত্র।  ছবি: সংগৃহীতপরে একদল শিক্ষার্থী ফলগুলো মিশরের কায়রোতে নিয়ে আসেন। এরপর দ্রুত তৎকালীন মুসলিম সাম্রাজ্যের আশপাশের অঞ্চলগুলোতে কফি প্রচারিত হতে থাকে। ১৩ শতাব্দীতে কফি তুরস্কে পৌঁছে। ১৬ শতাব্দীতে ইউরোপে কফি চাষ শুরু হয়। এক ইতালিয়ান ব্যবসায়ী নিজের দেশে নিয়ে যান। (ওলিভিয়া স্ট্যার্নস, সিএনএন: ২৯ জানুয়ারি, ২০১০)

কফি পান হতো তখন মসজিদ-সংলগ্ন স্থানে 
মুসলিমদের জন্য মদপান সম্পূর্ণ হারাম। তাই ইউরোপীয়দের মদপানের মতো কোনো কফি হাউজ মুসলিম দেশে দেখা যেত না। আর মুসলমানদের গল্প, আলাপ-আলোচনা ও নৈশ-পর্যালোচনা ইত্যাদির স্থান ছিল মসজিদ-সংলগ্ন স্থান। ফলে ইবাদত বন্দেগির উদ্দেশ্যে মুসল্লিরা কফি নিয়ে মসজিদের আশপাশের জায়গাগুলোতে বসতেন। এরপর কয়েকজন মিলে কফি খেয়ে কিছুক্ষণ কথা বলতেন। তারপর রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগি ও প্রার্থনা করতেন। (মাহা ফাজ্জাল, কিসসাতুল মাকহা; আল-জাজিরা অ্যারাবিক, ১৪/০৬/২০১৯ দ্রষ্টব্য)

মসজিদ-সংলগ্ন স্থানে চলতো কফি পান ও আলাপের মজলিস।  ছবি: সংগৃহীতপশ্চিমা গবেষক মার্ক পেন্ডারগ্রেস্ট বলেন, (মসজিদ-সংলগ্ন স্থান ছাড়া) মানুষ কফি পান করার জন্য তখন অনেক বেশি স্থান ছিল না। যাতে সমাজের সর্ব স্তরের মানুষ একত্রিত হয়ে দেখা-সাক্ষাৎ ও গল্প করতে পারে। এরপর থেকে বিভিন্ন স্থানে কফি হাউজ হতে থাকে। এমন দৃষ্টান্ত এর আগে দেখা যায়নি। তবে কেউ কেউ কফি হাউজকে মন্দের কারণ, পরনিন্দাস্থল ও বিদ্রোহের স্থান মনে করেন তখন। তবে কিছু ভালো দিকও ছিল। বাস্তবে মানুষ কফি হাউজে এসে তৎকালীন সময়ে রাজনীতি নিয়ে কথা বলতো। (পিবিএস-ব্ল্যাক কফি, পার্ট: ১-৩)

প্রথম কফি হাউজ চালু হয় মুসলিম বিশ্বে
পৃথিবীর প্রথম কফি হাউজ চালু হয় ১৪৭৫ সালে। তুরস্কের কনস্টান্টিনোপলে। কফি ছিল মুসলমানদের আবিষ্কার। এরপরও অনেক মুসলিম রাষ্ট্রে কফিকে ভিন্নভাবে দেখা হতো। ১৫১১ সালে মক্কার মক্কার তৎকালীন তুর্কি গভর্নর খায়ের বেগ কফি নিষিদ্ধ করেন। ভেবেছিলেন, কফির আড্ডায় বিভিন্ন আলাপে জনগণের অসন্তোষ জেগে উঠলে পতন ঘটবে। তাই জোর করে কফিকে হারাম ঘোষণা করান তিনি। তবে ১৫২৪ সালে ওসমানি সুলতান প্রথম সেলিম ফতোয়া জারি করেন এবং কফি খাওয়ার বৈধতা ঘোষণা করেন। খায়ের বেগকে অবৈধ হস্তক্ষেপের কারণে শাস্তি দেওয়া হয়। (মাহা ফাজ্জাল, কিসসাতুল মাকহা; আল-জাজিরা অ্যারাবিক, ১৪/০৬/২০১৯ দ্রষ্টব্য)

তুর্কিদের আমলে কফি হাউজ।  ছবি: সংগৃহীতষোড়শ শতকের মধ্যেই সিরিয়া, তুরস্ক, পারস্য, মিশরের মতো দেশগুলোতে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠে কফি হাউজ। এমনকি ১৬২৩ খ্রিস্টাব্দে ইস্তাম্বুলে ছয় শতেরও বেশি কফি হাউজ ছিল। আরবা কয়েক শতাব্দী কফির ঘ্রাণে মুগ্ধ হওয়ার পর ইউরোপে কপি যেতে শুরু করে। এরপর শুরু হয় কফির নতুন ইতিহাস। (স্টিভেন টফিক, কফি অ্যাজ এ সোস্যাল ড্রাগ)

মধ্যপ্রাচ্য, তুরস্ক ও বলকান অঞ্চল হয়ে কফি ইতালিতে যাত্রা করে। এরপর খুব দ্রুতই ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে এর জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে। ডাচদের মাধ্যমে পশ্চিমে আমেরিকা ও লাতিন আমেরিকায় কফির প্রচলন ঘটে। ১৭২০ সালে লাতিন আমেরিকায় কফি চাষ শুরু হয়। এদিকে প্রাচ্যের ওশেনিয়া অঞ্চলের ইন্দোনেশিয়া ও মালেশিয়া ইত্যাদিতেও কফি দ্রুত সবার নজর কাড়তে শুরু করে। (দ্য হিস্টোরি অব কফি অ্যান্ড হাউ ইট ট্রান্সফরমেড আওয়ার ওয়ার্ল্ড; মার্ক পেন্ডারগ্রাস্ট)

আমেরিকায় কফি হাউজের প্রচলন।  ছবি: সংগৃহীতউপমহাদেশে কফির প্রচলন
ভারতবর্ষে চায়ের প্রচলন হয় ব্রিটিশদের মাধ্যমে। তবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আসার বহু আগেই কফির প্রচলন হয়। অর্থ্যাৎ ভারতবর্ষে কফির ইতিহাস চায়ের ইতিহাসের চেয়েও প্রাচীন।

জানা গেছে, ১৬৭০ সালে বাবা বুদান নামের একজন ভারতীয় প্রথম কফির বীজ নিয়ে আসেন দক্ষিণ ভারতে। সেখান থেকেই তা ছড়িয়ে পড়ে গোটা ভারতবর্ষে। বাংলাদেশ এখনো বাণিজ্যিকভাবে কফি উৎপাদন শুরু হয়নি। তবে নিজস্ব উদ্যোগে চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় অনেকে চেষ্টা করে দেখছেন। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এমনটা জানা গেছে।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, দ্বিগুণ গতিতে বেড়েছে কফির জনপ্রিয়তা। কফির সঙ্গে আধুনিক কোনো পানীয় পাল্লা দিয়ে উঠতে পারছে না।

ইসলাম বিভাগে আপনিও লিখতে পারেন। লেখা ও প্রশ্ন পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ২০১৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৯
এমএমইউ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।