প্রকৃতপক্ষে ঠিক কবে থেকে মুসলিমদের বঙ্গদেশে আগমন হয়েছিল ও তারা কীভাবে ইসলাম প্রচার শুরু করেছিল এ নিয়ে বিশেষ কোনো গবেষণা নেই। এ ব্যাপারে ঐতিহাসিকদের কোনো আগ্রহও নেই।
কাজী আবদুল ওদুদের অভিমত
সাধারণভাবে এ অঞ্চলের মুসলিমরা মনে করে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে বখতিয়ার খলজির মাধ্যমেই প্রথমবারের মতো মুসলিমরা বাংলায় পদার্পণ করেছিল। হালে সামান্য তথ্য যুক্ত হয়েছে যে বখতিয়ারের আগে কিছু কিছু সুফি-দরবেশ বাংলায় প্রবেশ করে ইসলাম প্রচার শুরু করেছিলেন। ঐতিহাসিকদের ধারণা ও অনুমান এর বেশি কিছু নয়। এ বিষয়ে দু-একটি উদ্ধৃতি দেখা যেতে পারে:
১. বাংলায় মুসলমান দরবেশদের আগমন অতি প্রাচীন ব্যাপার। সেন রাজত্বের শেষভাগে এমনই একজন দরবেশ বা শেখ নাকি এ দেশে আসেন...। (কাজী আবদুল ওদুদ: বাংলার মুসলমানের কথা, শাশ্বত বঙ্গ, ব্র্র্যাক প্রকাশনা, ১৯৮৩, পৃষ্ঠা-৯৬)
২. বাংলার মুসলমানের অতীত বলতে একটা দীর্ঘকালের ব্যাপার বোঝায় মুসলমানরা এ দেশে যখন থেকে এসেছে তখন থেকে ইংরেজি শাসনের সূচনা পর্যন্ত অর্থাৎ দ্বাদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত।
(কাজী আবদুল ওদুদ; ‘অতীতের সমাজ’, শাশ্বত বঙ্গ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা-৯৮)
কাজী আবদুল ওদুদের এ শাশ্বত বঙ্গ একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হিসেবে বাঙালি সমাজে প্রচলিত আছে। তিনি বাংলায় মুসলিমদের আগমনের বিষয়টি ‘অতি প্রাচীন’ বললেও একটি ‘নাকি’ শব্দ যুক্ত করে তা হালকা করে দিয়েছেন এবং সিদ্ধান্ত টেনেছেন এটা হবে ‘সেন-রাজত্বের শেষ ভাগে’ এবং ‘দ্বাদশ’ শতাব্দী থেকে। অর্থাৎ বখতিয়ার খলজিই তার সামনে আছেন।
এ পি জে আব্দুল কালামের অভিমত
বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালামও মনে করেন, ‘দশম শতাব্দীতে এসেছিল মুসলমানরা, পরে তারা স্থানীয় অধিবাসীদের ভেতর মিশে গিয়েছিল, আর এ উপমহাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছিল। এক সাম্রাজ্য হটিয়ে দিয়েছিল অন্য সাম্রাজ্যকে। ধর্মীয় বিজয় অভিযান অব্যাহত ছিল।
(দেখুন এ পি জে আব্দুল কালামের Wings of Fire, Universities Press, Hyderabad, India, 1999, P-23)
তার দাবি, মুসলিমরা এসেছিল ১০ম শতাব্দীর মধ্যে, তার আগে নয়। এসব ধারণা ও মত মোটামুটি একই রকমেরই।
ড. আহমদ শরীফের অনুমান
ড. আহমদ শরীফ বাংলা ভাষায় মুসলিম সাহিত্য রচনার প্রাচীন উপাদানের অন্যতম আবিষ্কারক ও গবেষক। বাংলায় মুসলিমদের আগমন সম্পর্কে তার ধারণাটি স্মর্তব্য:
মদিনা থেকে মুলতান অবধি ইসলামের প্রসার বলতে গেলে প্রায় অবাধেই ঘটেছিল। ...তুর্কি বিজয়ের আগেই এখানে আরব-ইরানি বেনেদের সঙ্গে দরবেশ-প্রচারকদের আগমন শুরু। ...অন্তত আট শতক থেকে আরবদের সঙ্গে বাঙলার বাণিজ্যিক সম্পর্ক শুরু হয়। ...Periplus in the Erytheon -এর আলোকে যাচাই করলে এ সম্পর্ক খ্রিস্টীয় প্রথম শতক অবধি পিছিয়ে দেওয়া সম্ভব। চট্টগ্রাম বন্দরে আরব বেনেরা বছরে কয়েক মাস থেকে যেত। ...আমাদের মনে হয় তখনো মুসলিম সমাজে সুফি মতবাদ প্রসার লাভ করেনি...। (আহমদ শরীফ : বাঙালি ও বাঙলা সাহিত্য, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা ১৯৭৮, পৃষ্ঠা-১০২-১০৩)
ড. আহমদ শরীফের এ ধারণায় বেশ কয়েকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে প্রথমত যে বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষণীয়, তা হলো, ‘তুর্কি বিজয়ের আগেই এখানে (মানে বাংলাদেশে লেখক) আরব-ইরানি বেনেদের সঙ্গে দরবেশ-প্রচারকদের আগমন শুরু। ’ এ মন্তব্য থেকে ইবনে বখতিয়ার খলজির আগমনের মাধ্যমেই ১২০৪ সাল থেকে বাংলায় মুসলিমদের প্রথম আগমনের এতকালের মিথটি বাতিল হয়ে যায়। একই সঙ্গে আহমদ শরীফের মুসলিম প্রবেশের কাল গণনাটিও গুরুত্বপূর্ণ। যদিও তিনি বলেছেন, ‘অন্তত আট শতক থেকে আরবদের সঙ্গে বাঙলার বাণিজ্যিক সম্পর্ক শুরু হয়’, তথাপি তার এ অনুমানও যথার্থ যে গ্রিক সাহিত্যের দলিল অনুযায়ী ‘এ সম্পর্ক খ্রিস্টীয় প্রথম শতক অবধি পিছিয়ে দেওয়া সম্ভব। ’ এ দালিলিক ধারণা থেকে সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব যে মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবদ্দশাতেই অথবা ওফাতের পরপরই (৬৩২ খ্রিস্টাব্দের আগে-পরি) বাংলাদেশে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে আরব মুসলিমরা প্রবেশ করেছিলেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৮২৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৭, ২০২১
আরবি