হবিগঞ্জ: বালুমহাল ইজারার শর্ত অমান্য করে নদীর তীর ও বাঁধের গোড়া থেকে অবাধে বালু উত্তোলন করায় হবিগঞ্জ শহর পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এমনকি বর্ষায় বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যেতে পারে বিস্তীর্ণ বোরো ফসলের মাঠ।
এদিকে, বালুমহাল ইজারার শর্ত ভেঙে ভারী যানবাহন নামিয়ে এভাবে নদীর অবকাঠামো বিনষ্ট করলেও প্রশাসন নীরব ভূমিকায় রয়েছে। গত ১৬ বছরেও খোয়াই নদীর বালু উত্তোলন থামেনি।
পরিবেশবিদদের ভাষ্য, অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের ফলে খোয়াই নদী অবকাঠামোগত ভারসাম্য হারিয়েছে। এজন্য প্রতিবারই বর্ষা মৌসুমে আগ্রাসী রূপ ধারণ করে হবিগঞ্জ শহর তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।
ইঞ্জিনচালিত ভারী যানবাহন বা ড্রেজার মেশিন বসিয়ে নদী থেকে বালু উত্তোলনের বিধান নেই। বালু উত্তোলনের কথা না নদীর তীর থেকেও। আইন অনুযায়ী কোদাল ও বেলচা দিয়ে নদীর মাঝ থেকে বালু উত্তোলন করা যাবে।
কিন্তু হবিগঞ্জ শহরের মশাজান ব্রিজ থেকে জালালাবাদ এলাকা পর্যন্ত খোয়াই নদীর কয়েক কিলোমিটার অঞ্চলজুড়ে অর্ধশতাধিক ড্রেজার মেশিন বসিয়ে রাখা হয়েছে। এছাড়া নদীতে গাড়ি নামিয়ে কেটে নেওয়া হচ্ছে নদীর দুই তীর ও বাঁধের গোড়া। চর জেগে ওঠা স্থানগুলোতে ছোটখাটো পুকুর আকারের অসংখ্য গর্ত তৈরি হয়েছে।
মঙ্গলবার (২৪ ডিসেম্বর) বিকেলে যশেরআব্দা এলাকায় খোয়াই নদীতে ৫০০ ফুটের ভেতরে ৪টি ড্রেজার মেশিন বসিয়ে রাখতে দেখা গেছে। নদীর বাধ কেটে মাটির নিচ দিয়ে বালু নেওয়ার পাইপ প্রবেশ করানো হয়েছে লোকালয়ের ভেতরে। ড্রেজারগুলোর পাশেই নদীর দুপারে ৬টি ট্রাক্টর নামিয়ে বাঁধের গোড়ার মাটি কেটে নিয়ে যেতে দেখা যায়।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে স্থানীয় এক চা-বিক্রেতা বাংলানিউজকে জানান, প্রতিদিন এভাবে শত শত গাড়ি মাটি নদীর ভেতর থেকে নেওয়া হয়। জেগে ওঠা চরগুলো থেকে রাতদিন মাটি নেওয়ায় পুকুরের মত অসংখ্য গর্ত তৈরি হয়েছে।
এদিকে, মাটি ও বালুবোঝাই ভারী ট্রাক্টরগুলো শহররক্ষা বাঁধের ওপর দিয়ে চলাচল করায় যান চলাচলের সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নদী থেকে বাঁধের ওপর শক্তিশালী ট্রাক্টর তোলায় স্থানে স্থানে সড়ক ধসে গেছে। কিছু জায়গায় ১৮ ফুট প্রশস্তের বাধ ধসে ৬ ফুটে পরিণত হয়েছে।
অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনে জড়িত ট্রাক্টর ও ড্রেজার চালকদের সঙ্গে কথা হলে উত্তোলনকারী কর্তৃপক্ষের নাম জানাতে অস্বীকৃতি জানান তারা। জরুরি কাজ আছে জানিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন কয়েকজন।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি বলেন, দিন ও রাতে সমানতালে নদী থেকে মাটি ও বালু নেওয়া হচ্ছে। অনেক সময় ড্রেজার মেশিন দিনে বন্ধ রেখে সন্ধ্যা থেকে ভোররাত পর্যন্ত চালানো হয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায়, সাত বছর আগে ২০১৭ সালে ভারতের পাহাড়ি ঢলে খোয়াই নদীর পানি বিপদসীমার ২৮২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। তখনও হবিগঞ্জ শহর এতটা তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় পড়েনি; যতটা শঙ্কায় পড়েছে ২০২৪ সালে বিপদসীমার মাত্র ১৯৫ সেন্টিমিটারে পানি ওঠার পর।
অবাধে বালু ও মাটি উত্তোলনের ফলে এই ৭ বছরে নদীর তলদেশের অবকাঠামো এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে— নদীতে পানির ধারণক্ষমতা কমে গেছে। এ কারণে আগের তুলনায় ৮৭ সেন্টিমিটার কম পানি হলেও নদী ফুলে-ফেঁপে ওঠে এবং শহররক্ষা বাধ ধসে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দেয়। গত প্রায় ৫ বছর ধরে বর্ষা মৌসুম এলেই বাঁধের শতাধিক স্থান নড়বড়ে হয়ে হবিগঞ্জ শহর ও বিস্তীর্ণ বোরো ফসলের মাঠ তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দেয়।
এ ব্যাপারে খোয়াই রিভার ওয়াটারকিপার তোফাজ্জল সোহেল বলেন, মানুষের অব্যাহত নির্যাতনে খোয়াই নদীর তলদেশে অবকাঠামোগত পরিবর্তন পানির ধারণক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে। বালু ও মাটি উত্তোলন করে খোয়াই নদীকে এমন অবস্থায় নেওয়া হয়েছে যে— বর্ষা এলেই শহর তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় ঘুম হারাম হয়ে যায় এলাকাবাসী। ষোল বছরেও বালু উত্তোলন থামেনি। নদীতে প্রাণ-প্রকৃতির সিংহভাগ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তারপরও প্রশাসনের নীরব থাকা দুঃখজনক।
যোগাযোগ করা হলে হবিগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) প্রিয়াংকা পাল বাংলানিউজকে জানান, হবিগঞ্জ সদর অংশে একটিই বালুমহাল ইজারা দেওয়া। ফারুক নামে এক ব্যক্তি ইজারাদার।
এদিকে, ইজারার শর্ত ভঙ্গ করে অবাধে বালু ও মাটি উত্তোলনের ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,‘এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬,২০২৪
এসএএইচ