ঢাকা, সোমবার, ২৭ আশ্বিন ১৪৩২, ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ২০ রবিউস সানি ১৪৪৭

আইন ও আদালত

সালমান বলেছিলেন, ‘টিভির সম্প্রচারও বন্ধ করে দাও আমরা ক্র্যাকডাউনে যাব’

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:২৫, অক্টোবর ১২, ২০২৫
সালমান বলেছিলেন, ‘টিভির সম্প্রচারও বন্ধ করে দাও আমরা ক্র্যাকডাউনে যাব’ দেশ থেকে উৎপাটিত ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধানমন্ত্রী পদে থাকা হাসিনার উপদেষ্টা ছিলেন সালমান এফ রহমান

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের ঘটনায় ক্ষমতা থেকে উৎপাটিত ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার যুক্তিতর্ক শুরু হয়েছে। এটি সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।

এ সম্প্রচারের এক পর্যায়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক পেজে সাইবার হামলার কথা জানান চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।

রোববার (১২ নভেম্বর) বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ প্রথম দিনের মতো যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। এদিন তিনি জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট বর্ণনা দেন। যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ না হওয়ায় সোমবার আবারও দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল।

এ মামলায় শেখ হাসিনার পাশাপাশি অন্য দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এর মধ্যে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন দোষ স্বীকার করে এই মামলায় রাজসাক্ষী হয়ে জবানবন্দি দিয়েছেন। শনিবারও তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।

যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময় চিফ প্রসিকিউটরকে সহায়তা করেন প্রসিকিউটর গাজী এম. এইচ. তামীম। এ সময় প্রসিকিউশন পক্ষে উপস্থিত ছিলেন মো. মিজানুল ইসলাম, আবদুস সোবহান তরফদার, বি. এম. সুলতান মাহমুদ, আবদুস সাত্তার পালোয়ান প্রমুখ। অন্যদিকে আসামিপক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন উপস্থিত ছিলেন।

২০১০ সাল থেকে ট্রাইব্যুনালে মোট ৫৬ রায়
যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের শুরুতে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল আইনের অধীনে মানবতাবিরোধী অপরাধের এই বিচার হচ্ছে। এই আইনটি সংবিধান কর্তৃক সুরক্ষিত, আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। এই আইনের অধীনে এর আগে দুই ট্রাইব্যুনালে ৫৬টি রায় হয়েছে।

তিনি বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে—এর বিচার করার ক্ষমতা এই ট্রাইব্যুনালের রয়েছে। ওই সময় দেশে হাসিনার রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় ছিল। আওয়ামী লীগের কর্মপদ্ধতি ও মানসিকতা (মাইন্ডসেট) এই ট্রাইব্যুনালের সামনে আমরা উপস্থাপন করেছি।

রক্ষীবাহিনী থেকে আয়নাঘর
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, শেখ মুজিবের আমলে রক্ষীবাহিনী দিয়ে নাগরিকদের রাতে তুলে নিয়ে নির্যাতন করা হতো। সেই কাজটি হাসিনার আমলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী করেছে গত ১৫ বছরে ‘আয়নাঘর’ বানিয়ে। এ সংক্রান্ত ডকুমেন্টারি আমরা ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করেছি।

১/১১-এর সেনা শাসনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, দাবি আদায়ের নামে আওয়ামী লীগ ‘লগি-বৈঠা’ দিয়ে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করে দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সেনা-সমর্থিত শাসন এনেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসেন।

বিডিআর হত্যাকাণ্ড
বিডিআর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, বিদেশি রাষ্ট্রের আধিপত্য বিস্তারের পথে বাধা ছিল দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী। তাই পিলখানা হত্যার মাধ্যমে সেনাবাহিনীর মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়। এটা ছিল শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদ কায়েমের প্রথম পদক্ষেপ। পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করেন বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক, যাতে ইচ্ছামতো নির্বাচন করা যায়। দ্বিতীয় ধাপে শুরু হয় জুডিশিয়াল কিলিংয়ের মাধ্যমে আইন পরিবর্তন করে ফাঁসি দেওয়া হয়।

হাসিনাকে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি বলেছিলেন, ‘আপনি (একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের) বিচার করেন। ’ হাসিনা জবাব দেন, ‘বিচার করার জন্য প্রমাণ কোথায় খুঁজে পাব?’ প্রধান বিচারপতি তখন বলেন, ‘প্রমাণের ব্যবস্থা আমি করব। ’

এ সময় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বলেন, বিচারকরা যা কিছু করবেন, তার একটা নিয়ন্ত্রণ বা জবাবদিহিতা থাকা দরকার। জবাবে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, এ ধরনের একটি কাউন্সিল আছে—সেটি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। তখন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বলেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের একজন সদস্যও যদি আইন ভঙ্গ করেন, তবে তখন কী হবে?

ক্রসফায়ারের নির্মমতা
ক্রসফায়ারের নির্মমতা বর্ণনা করতে গিয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, মিরপুরে একজনকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করা হয়; তার মাথায় ঝাঁকড়া চুল ছিল। চুলে আগুন লেগে যায়। এ সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা হো-হো করে হাসছিল। আমরা তদন্তের সময় একজনকে প্রশ্ন করেছিলাম— মাথায় কেন গুলি করা হয়? তারা উত্তর দেয়, ‘মাথায় গুলি না করলে মরতে দেরি হয়। ’ এখান থেকেই ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্রদের পাখির মতো গুলি করার কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। ট্রাইব্যুনালের উদ্দেশ্যে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, আমরা বোঝাতে চাই— এই ঘটনা হঠাৎ করে হয়নি, এটি দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ও প্র্যাকটিস।

প্রকৃত গুমের সংখ্যা ৬ হাজারেরও বেশি
যুক্তিতর্কে গুমের বিষয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, তখন পুলিশ গুমের মামলা নিতে চাইত না। হাইকোর্ট বলতেন, ‘গুমের অভিযোগ পুলিশ তো স্বীকার করছে না। ’ শাপলা চত্বর হত্যাকাণ্ড ছিল বিরোধীদের রাজনৈতিক আওয়াজ বন্ধ করার প্রক্রিয়া। শাহবাগ ছিল সরকারের তৈরি করা মব। এ বিষয়ে হাসিনা সংসদে বলেছিলেন, ‘আমার মনটা শাহবাগে পড়ে থাকে। ’

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, অনেক ভিকটিম পরিবার মনে করত, গুমের অভিযোগ করলে পরবর্তীতে তাদের সমস্যা হবে— নিপীড়নের খড়্গ নেমে আসবে, পরিবারের অন্য সদস্যরাও নির্যাতনের শিকার হবেন। পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে গুমের ঘটনায় এ কারণে এখনো অনেক অভিযোগ আসেনি। গুমে অভিযুক্তরা এখনো চাকরিতে বহাল আছে, ফলে ভিকটিমরা আস্থা পাচ্ছেন না, মামলা করার সাহসও পাচ্ছেন না। প্রকৃত গুমের সংখ্যা ৬ হাজারেরও বেশি, ফেরত না আসার সংখ্যা ১ হাজারেরও বেশি। গুমের ঘটনায় গুম কমিশনে ১৮০০ অভিযোগ জমা পড়েছে। অভিযোগ জমা না পড়ার সংখ্যা আরও তিনগুণ বলে জানিয়েছে গুম কমিশন।

আদালতের নিজস্ব কোনো স্বাধীনতা ছিল না
বিচার বিভাগের বিষয়ে যুক্তিতর্কে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, বিচারক নিয়োগে মেধা ও যোগ্যতা বিবেচনা না করে দলীয় বিবেচনায় বিচারক নিয়োগ করা হয়েছে। খুনের মামলার আসামি, সুপ্রিম কোর্টে হামলায় জড়িত ব্যক্তিকেও বিচারক করা হয়েছে। এই বিচারকরা সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী যখন যে রকম রায় দেওয়ার দরকার, সে রকম রায় দিয়ে ১৫ বছর ধরে স্বৈরশাসন টিকিয়ে রেখেছেন।

তিনি বলেন, আদালতকে ব্যবহার করে বিরোধী দল ও মত দমন এবং ফ্যাসিবাদ কায়েম করা হয়েছে। এই ট্রাইব্যুনালকে ব্যবহার করে একসময় অতিবৃদ্ধ লোককেও আসামি করা হত, জামিন দেওয়া হত না। আদালতের নিজস্ব কোনো স্বাধীনতা ছিল না।

গ্যাং অব ফোর
মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় বৈঠক হতো। সেই বৈঠকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে কোথায় কোথায় মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হবে। সেখানে প্রটোকলের বাইরেও অনেকে উপস্থিত থাকতেন। সেখানে হেলিকপ্টার ব্যবহারের আলোচনাও হয়। ওবায়দুল কাদের, আনিসুল হক, আসাদুজ্জামান কামাল ও সালমান এফ রহমানের সমন্বয়ে ‘গ্যাং অব ফোর’ এই সিদ্ধান্ত নেয়।

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, সালমান এফ রহমান প্রতিমন্ত্রী পলককে বলেছিলেন, ‘ইন্টারনেট তো বন্ধ করেছই, টিভির সম্প্রচারও বন্ধ করে দাও, আমরা ক্র্যাকডাউনে যাব। ’ ৫ আগস্ট যদি হাসিনার সরকার পতন না হতো, ৬ আগস্ট বাংলাদেশে আমরা যে কত মানুষের লাশ দেখতাম, তা কল্পনাও করা যায় না। কারণ সালমান এফ রহমান বারবার উসকানি দিচ্ছিলেন। হাসিনা ও শেখ তাপসের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে আমরা লেথাল উইপন ব্যবহারের বিষয়টি ট্রাইব্যুনালে শুনিয়েছি। হাসিনা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেছিলেন সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে।

ইএস/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আইন ও আদালত এর সর্বশেষ