ঢাকা, শুক্রবার, ১ কার্তিক ১৪৩২, ১৭ অক্টোবর ২০২৫, ২৪ রবিউস সানি ১৪৪৭

আইন ও আদালত

যে কারণে হাসিনা-কামালের চরম দণ্ড চেয়েছে প্রসিকিউশন

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২:১১, অক্টোবর ১৬, ২০২৫
যে কারণে হাসিনা-কামালের চরম দণ্ড চেয়েছে প্রসিকিউশন জুলাই অভ্যুত্থানকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের চরম দণ্ড চেয়েছে প্রসিকিউশন।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানকালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের (প্রসিকিউশন) যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়েছে।

এতে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে প্রসিকিউশন শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের চরম দণ্ড চেয়েছে।

এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য দুই আসামির সম্পদ থেকে ক্ষতিপূরণ চেয়ে আবেদন করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ প্রসিকিউশনের পক্ষে পাঁচ দিনের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে এ তথ্য জানিয়েছেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।

আগামী সোমবার (২০ অক্টোবর) থেকে পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করবেন।

আদালতে প্রসিকিউশনের পক্ষে ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, গাজী এম এইচ তামীম, ফারুক আহাম্মদ, আবদুস সাত্তার পালোয়ান, তানভীর হাসান জোহা প্রমুখ।

আসামিদের পক্ষে ছিলেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন।

‘অপরাধের নিউক্লিয়াস শেখ হাসিনা’
তাজুল ইসলাম বলেন, তিনজন আসামির মধ্যে প্রধান আসামি ছিলেন শেখ হাসিনা, যিনি ছিলেন অপরাধের নিউক্লিয়াস। কারণ তাকে কেন্দ্র করে সমস্ত অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় একমাত্র লক্ষ্য ছিল—২০৪১ সাল পর্যন্ত তার, তার পরিবারের ও তার দলের শাসনক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করা; বাংলাদেশে যেন তার কোনো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ না থাকে; যারা তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, তাদের নির্মূল করা।

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, জুলাই-আগস্টে যখন কোটাবিরোধী আন্দোলন একটি যৌক্তিক দাবিতে সংঘটিত হতে শুরু করল—নিরস্ত্র, কোনো ধরনের হুমকি ছাড়া একটি সিভিলিয়ান আন্দোলন—সেটিকে দমন করার জন্য রাষ্ট্রের সব রিসোর্স ব্যবহার করা হয়; অর্থাৎ পুলিশ বাহিনী, বিজিবি, আনসার, গোয়েন্দা সংস্থা এবং কখনো কখনো সীমিত পরিসরে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল। যদিও সেনাবাহিনী সে হত্যাযজ্ঞে শামিল হয়নি।

তাজুল ইসলাম উল্লেখ করেন, হেলিকপ্টার, ড্রোন, এপিসি, মারণাস্ত্র ব্যবহার করে রাষ্ট্রযন্ত্র সম্পূর্ণভাবে যুক্ত হয়ে ১ হাজার ৪০০ মানুষকে হত্যা করে, হাজার হাজার মানুষকে আহত করে। এই মানবতাবিরোধী অপরাধের মূল লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগকে চিরস্থায়ীভাবে ক্ষমতায় রাখা। এটি ছিল রাজনৈতিকভাবে টার্গেটেড অপরাধ। কমান্ড স্ট্রাকচারের শীর্ষে বসে শেখ হাসিনা নিজেই এসব অপরাধ সংঘটনের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তার কথোপকথন, টেলিফোনিক নির্দেশনাসহ প্রমাণে তার জিঘাংসার মনোভাব স্পষ্ট।

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, তিনি (শেখ হাসিনা) ছাত্রদের প্রতিবাদকারীদের রাজাকার আখ্যা দিয়ে বলেছেন—‘যেহেতু এরা রাজাকার, তাদের রাজাকারদের মতো ফাঁসি দেওয়া হবে’। তিনি ইংল্যান্ডে ছাত্র আন্দোলনকারীদের হত্যার উদাহরণ টেনে বলেন—‘আমরাও এদের হত্যা করব’। এরপর মারণাস্ত্র ব্যবহার করে ওপর থেকে হেলিকপ্টার দিয়ে ক্লিয়ার করা—অর্থাৎ নির্মূলের নির্দেশ দেওয়া হয়। বোমাবর্ষণ ও প্যারাট্রুপার নামানোর কথাও বলা হয়। এমনকি হাসপাতালগুলোতে গিয়ে আহতদের চিকিৎসা না দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল—যা তার জিঘাংসার মনোভাবের প্রমাণ।

তাজুল ইসলাম বলেন, তিনি যেহেতু সব অপরাধীদের প্রাণভোমরা ছিলেন, তাকে চরম দণ্ড দেওয়া আইনি ও ন্যায্য। অন্তত প্রত্যেকটি হত্যার দায়ে যদি একবার করে মৃত্যুদণ্ড হয়, তাহলে ১ হাজার ৪০০ মানুষ হত্যার দায়ে ১ হাজার ৪০০ বার মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। যেহেতু তা মানবিকভাবে সম্ভব নয়, অন্তত একবার চরম দণ্ড না দেওয়া হলে তা অবিচার হবে।

‘অপরাধের কমান্ড স্ট্রাকচারে দ্বিতীয় ছিলেন আসাদুজ্জামান খান কামাল’
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিষয়ে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, দ্বিতীয় আসামি আসাদুজ্জামান খান কামাল ‘গ্যাং অব ফোর’-এর সদস্য ছিলেন। তার বাসায় বসে এ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করা হয়। তিনি নিজে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে পরিদর্শন করেছেন, সঠিকভাবে হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করতে।

‘তার ব্যাপারেও কোনো রকম অনুকম্পা দেখানোর সুযোগ নেই। কমান্ড স্ট্রাকচারে তিনি দ্বিতীয় অবস্থানে ছিলেন। তার ব্যাপারে চরম দণ্ড দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে’, বলেন তাজুল ইসলাম।

সাবেক আইজিপির বিষয় আদালতের ওপর
সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের বিষয়ে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, তিনি রাজসাক্ষীর ভূমিকা রেখেছেন। আইন অনুযায়ী আদালতকে তথ্য দিয়ে সত্য উদঘাটনে সহায়তা করেছেন। তার ব্যাপারে আদালত যে দৃষ্টিভঙ্গি নেবে, সেটি আদালতের বিষয়।

ক্ষতিপূরণ
ক্ষতিপূরণের বিষয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, যারা শহীদ হয়েছেন তারা ছিলেন পরিবারের আলোর প্রদীপ, ভবিষ্যতে পরিবারের দায়িত্ব নিতেন। তাই তাদের ক্ষতিপূরণের জন্য আসামিদের সম্পদ থেকে অর্থ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত। যারা চোখ, হাত বা পা হারিয়েছেন, তাদেরও ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত বলে আদালতের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে।

গত ১১ অক্টোবর প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামীম জানান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। আইন অনুযায়ী প্রথমে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করবে প্রসিকিউশন, এরপর রাষ্ট্রনিযুক্ত ডিফেন্স আইনজীবীর যুক্তিতর্ক হবে। এটি ট্রাইব্যুনালে একটি মামলার সর্বশেষ ধাপ। যুক্তিতর্ক শেষে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হবে।

এ মামলায় শেখ হাসিনার পাশাপাশি বাকি দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। এর মধ্যে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন দোষ স্বীকার করে এই মামলায় রাজসাক্ষী হয়ে জবানবন্দি দিয়েছেন।

এ মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন তদন্ত সংস্থার উপপরিচালক মো. জানে আলম খান। পরে তদন্ত করেন উপপরিচালক মো. আলমগীর। সার্বিক সহযোগিতা করেন বিশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা তানভীর হাসান জোহা। এ ঘটনায় তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর গত ১২ মে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। পরে ৩১ মে সম্পূরক অভিযোগ দেওয়া হয়। ১ জুন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়।

গত ১০ জুলাই এ মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।

ইএস/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

আইন ও আদালত এর সর্বশেষ