ঢাকা: ছয় বছর আগে ফ্যাশন সচেতন এক নারী উদ্যোক্তার হাত ধরে দেশের বাজারে আবির্ভাব ঘটে ‘সারা’ লাইফস্টাইল লিমিটেডের। যাত্রা শুরুর পর থেকেই প্রতিষ্ঠানটি স্বল্প মূল্যে ক্রেতাদের হাতে তুলে দিচ্ছে মানসম্মত পোশাক।
একসময় শুধু রাজধানীতে আউটলেট থাকলেও এখন ঢাকার বাইরে ছয়টি জেলায় মিলছে সারার বাহারি পণ্য। অনলাইনের মাধ্যমেও সারাদেশে ক্রেতার কাছে নিজেদের পণ্য পৌঁছে দিচ্ছে এই ফ্যাশন হাউস। পশ্চিমা ধাঁচে দেশীয় পোশাক এনে সারার সাব-ব্র্যান্ড ‘ঢেউ’ তরুণ-তরুণীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
যার হাত ধরে ‘সারা’র যাত্রা শুরু, তিনি প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক শরীফুন রেবা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াশুনা করা এবং সাংবাদিকতায় কর্মজীবন শুরু করা রেবা অল্প সময়ে ‘সারা’কে নিয়ে গেছেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। ‘সারা’র এমন জনপ্রিয়তার কারণ, বর্তমান পরিস্থিতি, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সুব্রত চন্দ।
বাংলানিউজ: আপনি সাংবাদিকতায় পড়াশুনা করেছেন, কর্মজীবনও শুরু করেছেন সাংবাদিকতায়। তারপর মাঝে কয়েক বছরের কর্মজীবনে বিরতি দিয়ে নিয়ে এলেন দেশীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড ‘সারা’ লাইফস্টাইল লিমিটেড। এই উদ্যোগের ভাবনা এল কীভাবে?
শরীফুন রেবা: দেশের জন্য কিছু করার আকাঙ্ক্ষা থেকে, দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে তাদের জন্য সারা লাইফস্টাইল নিয়ে আসা। যাতে সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। তবে এটা তাৎক্ষণিকভাবে নিয়ে আসা হয়নি। অনেক চিন্তা-ভাবনা, গবেষণা ও পরিকল্পনা করে ২০১৮ সালের মে মাসে সারার যাত্রা শুরু করি।
বাংলানিউজ: সারার যাত্রা শুরুর প্রায় দুই বছরের মাথায় বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারি দেখা দেয়। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়ে। বিশেষ করে দেশের পোশাক শিল্প বড় ধাক্কার সম্মুখীন হয়। সেই ধাক্কা কীভাবে কাটিয়ে উঠলেন?
শরীফুন রেবা: করোনার কারণে তো অবশ্যই ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। যাত্রা শুরুর পর আমাদের সবকিছুই ভালোভাবে চললেও দুই বছরের মাথায় করোনা শুরু হয়। এ সময় বিশ্বব্যাপী ব্যবসা, দৈনন্দিন জীবন সবকিছুতেই একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সারাও এর ব্যতিক্রম নয়। সেই নেতিবাচক প্রভাব আমরা এখনো পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারিনি। তবে এখন আমরা মোটামুটি স্থিতিশীল পর্যায়ে আছি। করোনার সময়ও আমরা কাজ করেছি। আমাদের ডিজাইনাররা ডিজাইন করেছেন, অনলাইনে পণ্য বিক্রি করেছি। তখন সাময়িক বিরূপ প্রভাব পড়লেও সারা বন্ধ করে দেওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। বরং, সে সময় আমরা মাস্ক, পিপিই নিয়ে এসেছিলাম। কোনো ধরনের লাভ ছাড়াই শুধু উৎপাদন খরচে আমরা সেগুলো ক্রেতাদের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। এমনকি সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে বিভিন্ন সম্মুখ সারির যোদ্ধাদের আমরা ১৭-১৮ হাজার পিপিই ও মাস্ক বিনামূল্যে দিয়েছিলাম। করোনার সময় আমাদের মাস্ক-পিপিই খুব জনপ্রিয় ছিল। পোশাক বিক্রি তেমন না হলেও আমরা মাস্ক-পিপিই তৈরি নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম।
বাংলানিউজ: বর্তমানে রাজধানী ঢাকায় আটটি এবং রাজধানীর বাইরে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছয়টিসহ সারার মোট ১৪টি আউটলেট রয়েছে। আরো শোরুম বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে?
শরীফুন রেবা: আমাদের ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে মোট ১৪টি স্টোর আছে। কয়েক মাসের মধ্যে খুলনায় আমরা আরেকটি স্টোর চালু করবো। আপাতত এই বছর ঢাকার বাইরে আরো তিন-চারটি আউটলেট নিয়ে আসার পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। দেশের বাইরেও সারাকে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা আমাদের আছে। তবে এর জন্য আমরা আরেকটু সময় নিতে চাই। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে একটি পণ্য নিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক পরিকল্পনা দরকার। সে জন্য আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি।
বাংলানিউজ: যাত্রা শুরুর কয়েক বছরের মাথায় সারা ক্রেতাদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে, এই জনপ্রিয়তার কারণ কী?
শরীফুন রেবা: জনপ্রিয়তার একটি প্রধান কারণ হচ্ছে কম মূল্যে ক্রেতাদের হাতে ভালো মানের পণ্য তুলে দিতে পারা। সারার যাত্রার শুরু থেকে আমাদের লক্ষ্য ছিল, ভালো পণ্য যেন কম মূল্যে আমরা ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারি। যাতে ক্রেতারা সন্তুষ্ট থাকে। কিন্তু পণ্যের দাম কমালেও গুণগত মানে আমরা কোনো ছাড় দেইনি।
বাংলানিউজ: দেশের বাজারে সারার ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকার পরও সাব-ব্র্যান্ড ‘ঢেউ’ নিয়ে এল কেন?
শরীফুন রেবা: সারা এবং ঢেউ একই। এখন ক্রেতারা দেশীয় পোশাকের মাধ্যমে পাশ্চাত্যের পোশাকের আমেজ নিতে চায়। তাই আমরা যেহেতু পোশাক তৈরি করেছিই, সেহেতু চিন্তা করলাম পাশ্চাত্যের ধরনটাকে কাস্টমাইজ করে দেশীয় স্টাইলে কিছু করা যায় কিনা? সেই চিন্তা থেকেই ওয়েস্টার্ন ফ্যাশন ব্র্যান্ড ঢেউ নিয়ে আসা। আপাতত ঢেউ ছাড়া আমাদের আর কোনো সাব-ব্র্যান্ড নিয়ে আসার পরিকল্পনা নেই।
বাংলানিউজ: সারা এবং ঢেউয়ের পোশাক ডিজাইনের ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলো মাথায় রাখা হয়?
শরীফুন রেবা: সারা এবং ঢেউয়ের পোশাক ডিজাইনের ক্ষেত্রে আমরা ট্রেন্ডকে প্রাধান্য দিই। ট্রেন্ড কি ডিমান্ড করছে সেটি দেখা হয়। ট্রেন্ড প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হয়। এই ঈদে যেই ট্রেন্ড থাকে পরের ঈদে সেটি থাকে না। আমাদের ডিজাইনাররা পোশাক ডিজাইনের ক্ষেত্রে প্রথম নোটিশ করে ট্রেন্ড কোন দিকে। তারপর সেই অনুযায়ী আমরা পোশাকটা ডিজাইন করার চেষ্টা করি। সারার পণ্য সবার জন্য। সব বয়সী মানুষই আমাদের ক্রেতা। এবং তারা আমাদের পণ্য পেয়ে মোটামুটি খুশিই আছে। তারপরও আমরা আমাদের আউটলেটগুলোতে ক্রেতাদের মতামত দেওয়ার ব্যবস্থা রেখেছি। ক্রেতাদের মতামতকে আমরা প্রাধান্য দিয়ে সেটি নিয়ে কাজ করি। আমাদের আগে কটন শাড়ি ছিল না। যারা শাড়ি পরতে পছন্দ করেন, তাদের চাহিদা ছিল কটন শাড়ির। সেটি মাথায় রেখে এবার আমাদের আউটলেটগুলোতে কটন শাড়ি নিয়ে এসেছি।
বাংলানিউজ: পরিবেশ রক্ষায় সারা কতটুক চিন্তা করে?
শরীফুন রেবা: আমরা ক্রেতাদের চাহিদার কথা যেমন মাথায় রাখি, তেমনি পরিবেশের বিষয়টিও বিবেচনা করি। আমরা আগে কাপড়ের শপিং ব্যাগ ব্যবহার করতাম, সেটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। তাই আমরা এখন বায়োডিগ্রেবল পলির শপিংব্যাগ নিয়ে এসেছি। এই পলি ৬ মাস থেকে এক বছরের মধ্যে মাটিতে মিশে যায়। যা, পরিবেশের ক্ষতি করছে না। দেশের বাইরেও পণ্য বহনে এই ধরনের পলির শপিং ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। এছাড়া আমরা আমাদের পোশাকে যে সুতো, রং ও ফেব্রিক্স ব্যবহার করি, সেগুলো আমাদের ল্যাবে পরীক্ষা করে দেখা হয় যে, এগুলো মানব শরীর ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কিনা? পরীক্ষায় শতভাগ ইতিবাচক ফলাফল আসার পরই সেগুলো ব্যবহার করা হয়।
বাংলানিউজ: ক্রেতাদের কাছে সারার শীতের পোশাকের ব্যাপক প্রশংসা রয়েছে। অন্যান্য পোশাকেরও জনপ্রিয়তা কম নয়। পরিধানের পোশাক ছাড়া সারায় আর কি ধরনের পণ্য পাওয়া যাচ্ছে?
শরীফুন রেবা: আমরা পোশাকের পাশাপাশি লেদারের কিছু পণ্য, যেমন- ব্যাগ, বেল্ট, ওয়ালেট ক্রেতাদের জন্য এরই মধ্যে নিয়ে এসেছি। সামনে আমাদের আরো পণ্য নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে। আমরা সেগুলো নিয়ে কাজ করছি।
বাংলানিউজ: সমপর্যায়ের অন্যান্য ব্র্যান্ডের পোশাকের তুলনায় সারার পণ্য অনেকটাই ক্রেতার নাগালে থাকে। এটি কীভাবে সম্ভব?
শরীফুন রেবা: শুরু থেকেই আমাদের লক্ষ্য ছিল ভালো ও মানসম্মত পণ্য আমরা কম মূল্যে ক্রেতাদের কাছে দেবো। সেভাবেই আমরা কাজ করছি। আমরা আমাদের পণ্যের মূল্য সব সময় কম রাখার চেষ্টা করি। এবারের ঈদেও ক্রেতাদের কথা চিন্তা করে কম দামে পণ্য দেওয়ার পরিকল্পনা আমরা করেছি। যার অংশ হিসেবে কোরবানির ঈদ পর্যন্ত সবগুলো আউটলেটে নতুন-পুরাতন সব পণ্যে আমরা ৩০ শতাংশ ছাড়া দেবো। ক্রেতাদের সারার প্রতি আকৃষ্ট করতে এবং সারার পণ্য সবার কাছে পৌঁছে দিতেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বাংলানিউজ: অনেকেই এখন অনলাইনে কেনাকাটায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। সারারও অনলাইন মার্কেট প্লেস রয়েছে। এর ব্যাপ্তি আর বাড়ানো হবে কিনা?
শরীফুন রেবা: বিশ্বব্যাপী অনলাইন কেনাকাটা খুবই জনপ্রিয়। আমাদেরও অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালু আছে। সেখানে ক্রেতাদের ভালো সাড়াও পাচ্ছি। কারণ, আমরা ঢাকার ভেতরে ডেলিভারি চার্জ ছাড়াই ক্যাশ-অন ডেলিভারি দিচ্ছি। ঢাকার বাইরে কিছু চার্জ রাখা হচ্ছে। তবে আমাদের অনলাইন সার্ভিসে ক্রেতারা খুশি। আমরা বাইরের দেশগুলোর অনলাইন মার্কেটকে অনুসরণ করে আমাদের প্ল্যাটফর্মকে আরো উন্নত করার চেষ্টা করছি। এখনও আমরা সারার অনলাইন প্ল্যাটফর্মকে যেভাবে চালাচ্ছি সেটাও মানুষের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়। কারণ, আমাদের অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সারার পণ্যের পাশাপাশি অন্যান্য ব্র্যান্ডের পণ্যও পাওয়া যায়। আমরা আমাদের অনলাইন মার্কেট প্লেইসকে অ্যামাজন, আলিবাবার মতো বড় করার কাজ করছি।
বাংলানিউজ: দেশের বাজারে সারার প্রতিযোগী কারা? তাদের সঙ্গে সারার পার্থক্য কোথায়? আপনি সেই প্রতিযোগিতা কীভাবে দেখেন?
শরীফুন রেবা: আমরা কাউকে প্রতিযোগী মনে করি না। আমাদের কি করা উচিত, আমরা কি ভাবি, আমাদের কতটুক সামাজিক দায়বদ্ধতা, আমরা ক্রেতাদের কতটুকু খুশি করতে পারছি, ক্রেতারা আমাদের কাছ থেকে কি চায়- এগুলোই আমাদের মূল লক্ষ্য। এখানে কাউকে প্রতিযোগী ভাবার কিছু নেই। আমাদের দরকার, আমরা কাজ করবো, সৎ থাকবো। সৎ থেকে যতটুকু কাজ করা যায়, সেটাই আমাদের টার্গেট।
বাংলানিউজ: দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সারা কেমন ভূমিকা রাখছে, বিশেষ করে নারীদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে?
শরীফুন রেবা: নারী-পুরুষ সবাই আমরা একসঙ্গে কাজ করি। আমাদের ডিজাইনার প্রায় সবাই নারী। আমাদের অনেক নারী সহকর্মী আছেন। নারীদের মাতৃত্বকালীন ছুটিসহ যেসব সুযোগ-সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন আমরা সবই দিয়ে থাকি।
বাংলানিউজ: শীত মার্কেটে সারার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। আসন্ন শীতে সারা এবং ঢেউ ক্রেতাদের জন্য কী নতুনত্ব নিয়ে আসছে।
শরীফুন রেবা: শীত আসতে তো এখনো বেশ কয়েক মাস বাকি আছে। তারপরও আমরা এবার ঢাকার বাইরে একটু ভারি জ্যাকেট রাখার পরিকল্পনা রেখেছি। কারণ ঢাকার বাইরে শীত বেশি পড়ে। এছাড়া আরো নতুন কি করা যায়, তা নিয়ে পরিকল্পনা করছি। তবে প্রতি বছরই আমরা শীতে নতুন নতুন ডিজাইনের, নানা রঙের শীতের পোশাক থাকে। প্রায় এক-দেড়শ স্টাইলের জ্যাকেট থাকে। কালার ভেরিয়েশন থাকে ৩০০-৪০০ রকমের। ডেনিমের কুর্তি, শাল থাকে। আশা করি, এবারও আমরা এসবের পাশাপাশি নতুন কিছু নিয়ে আসবো।
বাংলানিউজ: নিজের হাতে গড়া ফ্যাশন ব্র্যান্ড সারাকে কোথায় নিয়ে যেতে চান বা কোথায় দেখতে চান?
শরীফুন রেবা: সারাকে আরো বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চাই। দেশের প্রতিটি জেলায় সারাকে নিয়ে যেতে চাই।
বাংলাদেশ সময়: ১০৪০ ঘণ্টা, জুন ৪, ২০২৪
এসসি/এসআইএস