ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

লাইফস্টাইল

বাঙালি মুসলমানের সাথে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক

ফেরদৌস মাহমুদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭০৩ ঘণ্টা, জুন ২১, ২০১০

রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এক মস্ত অভিযোগ হলো, তাঁর সাহিত্যে মুসলমানদের বিষয়ে কথা খুব বেশি নেই। যা আছে তাও খুব স্বচ্ছ নয়।

রবীন্দ্রনাথ যেভাবে যীশু খ্রিস্ট বা গৌতম বুদ্ধকে নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন, সেরকম উচ্ছ্বাস কখনই প্রকাশ করেননি হজরত মুহম্মদ [সা.] সম্পর্কে। যদিও সাহিত্যের বিবেচনা অন্যরকম, আর লেখকেরও কোনো বিষয়ে বলা-না-বলার স্বাধীনতা রয়েছে। কিন্তু ব্যক্তিটি যেহেতু রবীন্দ্রনাথ, যিনি সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, চিত্রকলা কিংবা সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি থেকে শুরু করে স্বদেশ ও পৃথিবীর প্রায় সমস্ত বিষয় নিয়েই কোনো না কোনো সময় ভেবেছেনÑ তাই একটা কৌতূহল থেকেই যায় মুসলমানদের সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিল কিংবা বাঙালি মুসলিম লেখক-সাহিত্যিকদের সাথে তার সম্পর্কই বা ছিল কেমন।

আমরা রবীন্দ্রনাথের জীবন-যাপনের দিকে তাকালে দেখব যে, জমিদারি কর্মকা- করতে তাঁকে আসতে হয়েছিল পূর্ববঙ্গে এবং মিশতে হয়েছিল এখানকার মুসলমান প্রজাদের সাথে। এখানকার আলোহাওয়ায় ঘোরাফেরা করে তিনি লিখেছেন অনেক গল্প, কবিতা, গান ও চিঠি। হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্বকে সামনে রেখে ধর্মের নামে ভারতবর্ষকে খন্ডিত করার চেষ্টাকে তিনি স্বাভাবিকভাবে নেননি। মেনে নিতে পারেননি বঙ্গভঙ্গের বিষয়কে। এসব নিয়ে তিনি পত্রিকায় বিবৃতি দিয়েছেন, প্রবন্ধ লিখেছেন এবং বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে যোগও দিয়েছিলেন।
এসব বিষয় নিয়ে সম্প্রতি ভূঁইয়া ইকবালের সম্পাদনায় বের হয়েছে ‘রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ’ বইটি। বইটির ভূমিকা লিখেছেন  অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। পাঠকের সুবিধার জন্য বইটিকে মোট দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম ভাগে রয়েছে মুসলমান প্রসঙ্গে এবং মুসলমান-সম্পাদিত সাময়িকপত্রে প্রকাশিত কবির বিভিন্ন লেখা। এখানে শুরুতেই পাওয়া যাবে মুসলমানদের উৎসর্গীকৃত কবিতা, শোক-কবিতা, সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব ও সম্প্রীতি বিষয়ে কবিতা ও কয়েকটি অটোগ্রাফ কবিতা।

কবি বিভিন্ন সময়ে সওগাত, মোসলেম-ভারত, নওরোজ, মোয়াজ্জিন, মোহাম্মদী, বুলবুল ও প্রবাসীসহ মুসলমান সম্পাদিত অনেক পত্রিকায় লেখালেখি করেছেন। এই সূত্রে তাঁর সাথে ওই সময়ের অনেক তরুণ বিখ্যাত মুসলমান কবি-সাহিত্যিক ও সম্পাদকদের সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও সম্পর্ক তৈরি হয়। তিনি মুসলমান-সম্পাদিত নতুন পত্রিকা প্রকাশ উপলক্ষে আশীর্বাণী-কবিতাও লিখেছিলেন, ওইসব আশীর্বাণী কবিতাও এখানে সংকলিত হয়েছে। যেমনÑ ১৯২২ ও ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ কাজী নজরুল ইসলামের ধূমকেতু ও লাঙল পত্রিকায় বহুল প্রচারিত দুটি কবিতা লিখেছিলেন। এর মধ্যে ধূমকেতুর জন্য লিখেছিলেন।

কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু

আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু,
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু দুর্দ্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয়-কেতন!
অলক্ষণের তিলক রেখা
রাতের ভালে হোক্ না  লেখা,
জাগিয়ে দেরে চমক্ মেরে’
আছে যারা অর্দ্ধচেতন!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপন্যাস ও নাটকের ‘প্লট’ দিয়েছিলেন জসীমউদ্দীন ও বন্দে আলী মিয়াকে। কাজী নজরুল ইসলামকে উৎসর্গ করেছেন বসন্ত নাটিকা এবং নজরুল কারাগারে অনশনকালে উদ্বিগ্ন রবীন্দ্রনাথ তাঁর অনশন ভাঙ্গাবার জন্য টেলিগ্রাম করেছিলেন। এছাড়া তিনি কাজী নজরুল ইসলাম ও জসীমউদ্দীনকে শান্তিনিকেতনের কাজে যোগ দিতেও আহ্বান জানিয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের সাথে চিঠিপত্রে যোগাযোগ ছিল অনেক মুসলমান কবি-লেখকের। রবীন্দ্রনাথ চিঠি লিখেছেন কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, স্যার আজিজুল হক, আবুল ফজল, কাজী আবদুল ওদুদ, বন্দে আলী মিয়াসহ খ্যাত-অখ্যাত অনেকের কাছেই, ওই চিঠিগুলিও বইয়ের প্রথমভাগে সংকলিত হয়েছে। চিঠিগুলি পাঠ করলে টের পাওয়া যায় বাংলা ভাষায় আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার, আঞ্চলিক/উপভাষার প্রয়োগ সম্পর্কে কবির চিন্তা। স্পষ্ট হয়ে ওঠে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যকার সাম্প্রদায়িক সমস্যা, দ্বন্দ্ব ও সম্প্রীতি সম্পর্কে কবির উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরবাড়ির ভারতী পত্রিকায় কায়কোবাদের কুসুমকানন কাব্য সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করেছেন; প্রকাশ করেছেন মীর মশাররফ হোসেনের  গো-জীবন, উদাসীন পথিকের মনের কথা ও বিষাদ সিন্ধুর সংক্ষিপ্ত সমালোচনা। এছাড়া তিনি কয়েকজন মুসলিম লেখকের বইয়ের উপর প্রবন্ধ ও ভূমিকা লিখেছিলেন। এসব লেখাও এখানে সংকলিত হয়েছে।

হজরত মোহাম্মদ [সা.]-এর জন্মদিন উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ একবার বাণী পাঠিয়েছিলেন স্যার আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দীকে। ২৫ জুন ১৯৩৪ বাণীটি প্রচারিত হয় আকাশবাণীতে। এটিও আছে এখানে।

এখানে সংকলিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের দেয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে অভিভাষণ, শেখ সাদীর সমাধিতে ভাষণ, তেহরানে জনসভায় বক্তৃতা, বাগদাদে বক্তৃতা, কামাল আতাতুর্কের মৃত্যুতে বিশ্বভারতীতে দেয়া ভাষণ এবং প্রগতি লেখক সম্মেলনে প্রেরিত লিখিত-ভাষণ। এছাড়া আছে জালিনওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের প্রথম বার্ষিক স্মরণসভায় প্রেরিত ভাষণের বাংলা অনুবাদ ও মূল ইংরেজি ভাষণসহ বিভিন্ন উপলক্ষে দেয়া মুসলমানদের সাথে সম্পর্কিত কবির বিবৃতি, প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবাদ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রবন্ধের দিকে তাকালে প্রায় ৩০টিরও বেশি প্রবন্ধ পাওয়া যাবে যেখানে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক বিষয়ে তাঁর কোনো না কোনো বক্তব্য পাওয়া যাবে। ওই সব প্রবন্ধ থেকে কয়েকটি প্রবন্ধ সম্পূর্ণ, আবার কোনো কোনোটার অংশবিশেষ এখানে সংকলিত হয়েছে।
বইটির দ্বিতীয় ভাগে আছে রবীন্দ্রনাথের সাথে মুসলমান শিক্ষিত মধ্য ও উচ্চবিত্ত সম্প্রদায়ের যোগাযোগের তথ্য। এখানে রবীন্দ্রনাথকে লেখা কবিতাগুচ্ছ, তার সম্পর্কে মুসলমানদের  মনোভাব ও প্রতিক্রিয়া এবং তাঁকে লেখা বিভিন্ন চিঠি রয়েছে। রয়েছে কবির সান্নিধ্যে আসা জসীমউদ্দীন, আবুল ফজল, সৈয়দ মুজতবা আলী, বন্দে আলী মিয়া, সুফিয়া কামাল, বিজ্ঞানী কুদরত-ই-খুদা, আবদুল কাদির, কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হোসেনসহ বিভিন্ন মুসলমান লেখক ও ব্যক্তিদের স্মৃতিচারণমূলক লেখা।

এখানে সংকলিত রবীন্দ্রনাথকে লেখা বিভিন্ন চিঠি ও স্মৃতিচারণ পাঠ করলে জানা যায় কবির সঙ্গে তাদের পারস্পরিক যোগাযোগ ও সম্পর্কের কথা। রবীন্দ্রনাথের কাছে কেউ গিয়েছিলেন ব্যক্তিগত সমস্যার সমাধানে সাহায্য, সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে সহযোগিতা, রচিত গ্রন্থাবলি সম্পর্কে কবির মতামত ও গ্রন্থ প্রকাশে কবির সহযোগিতা লাভের জন্য। কেউ আবার গিয়েছিলেন কবির স্নেহাশীর্বাদ  ও স্বাক্ষর লাভের জন্য।
অবাক ব্যাপার হলো, এ বইটি পাঠ করলে পাঠক লক্ষ করবেনÑ সাড়ে পাঁচ বছর বয়সী মামুন, স্কুলছাত্রী জেব-উন-নেসা, মাদ্রাসাছাত্রী আমিনা মোজহার, স্কুলছাত্র ফেরদৌস খান থেকে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, আগা খান, তৎকালীন ইরানের বাদশাহ, এ কে ফজলুল হকসহ সমাজের নানা স্তরের মুসলমানের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ও যোগাযোগ ছিল।

‘রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ’ লেখকের দীর্ঘ পরিশ্রমের কাজ। ৪৪৮ পৃষ্ঠার এই বইটি রবীন্দ্রনাথের চিন্তাজগৎকে নতুনভাবে দেখতে যেমন সহায়তা করবে, তেমনি অনেক জিজ্ঞাসার জবাবও খুব সহজেই পেয়ে যাবেন, যেগুলো নিয়ে রয়েছে আমাদের জিজ্ঞাসা ও কৌতূহল।

রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ
ভূঁইয়া ইকবাল
প্রকাশক :  প্রথমা
প্রচ্ছদ : জয়নুল আবেদিনের স্কেচ অবলম্বনে কাইয়ুম চৌধুরী
প্রকাশকাল : মে ২০১০
মূল্য : ৫০০ টাকা

বাংলাদেশের স্থানীয় সময়: ১৩০০ ঘণ্টা, জুন ২১, ২০১০
এসকেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।