ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

লাইফস্টাইল

ক্যামেরা যেন তুলি

রক্তিম দাশ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১০

সম্প্রতি ভারত ও বাংলাদেশে মুক্তি পেয়েছে লালন ফকিরের জীবন নিয়ে গৌতম ঘোষের ছবি ‘মনের মানুষ’। ছবিটি দেখে তার অনুভূতির কথা লিখেছেন বাংলানিউজের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট রক্তিম দাশ।



শুধু জল আর জল। লং শটে দেখা যাচ্ছে একটা ভেলা ভেসে আসছে। ক্যামেরা যখন কোজ অ্যাঙ্গেলে, তখন দর্শক দেখতে পেল মশারির ভেতরে এক অস্পষ্ট এক মৃতপ্রায় দেহ। বহু দূরে নদীর দিগন্তরেখায় সূর্য অস্ত যাচ্ছে। গৌতম ঘোষের ‘মনের মানুষ’ ছবির এটাই প্রথম দৃশ্য।

এটা কি সিনেমা, না কবিতা? এই কথাটাই মনে ঘুরছিল। টানা আড়াই ঘণ্টা তার ‘লালন’ আমাদের নিয়ে গেল অন্য এক জগতে। যে জগতে স্থান-কাল-পাত্র-জাত-দেশ সব একাকার হয়ে গেছে।

সুনীল গাঙ্গুলির ‘মনের মানুষ’ লেখা হয়েছিল লালন ফকিরের জীবন নিয়ে। সেই কাহিনী থেকে লালনের জীবনকে ক্যামেরায় এঁকেছেন গৌতম। লালনের সংসার জীবন, ফকিরের জীবন আর অবশ্যই এক জাতধর্ম বিহীন মানবসংসার গড়ার চেষ্টা সবই উঠে এসেছে ছবিটিতে।

আর আছে গান। গল্প আসে, গল্প যায়। লালন গানে গানে গেঁথে চলেন মালা। পুরো গান ব্যবহার না করে অসংখ্য গানের টুকরো অংশ ব্যবহার করেছেন পরিচালক। ‘মিলন হবে কতদিনে’, ‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে’ কিংবা ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়’ গানগুলি এমনিতেই জনপ্রিয়। সেই গানের পাশাপাশি দু-একটি গানে গৌতম সুর দিয়েছেন সেগুলিও যথাযথ। লালনের গানের পাশে সমান তালে মিশে গেছে গানগুলি।

গৌতমের হাতে ক্যামেরা তুলি হয়ে চিত্রায়িত করেছে অন্ধকারে বউকে নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে লালনের ঘুরে বেড়ানো, লালনের আখড়া, নদীর জলে চাঁদের প্রতিচ্ছবি, আবার তার মাঝেই শিলাইদহের পদ্মায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে বোটে সওয়ার হয়ে বৃদ্ধ লালনের পোর্ট্রটে আঁকার ফাঁকে ফাঁকে ফাশব্যাকে চলে যাওয়া।

বাংলাদেশের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অসাধারণ ব্যবহার করেছেন পরিচালক। কালু চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরীর দুর্দান্ত অভিনয় অনেক দিন মনে রাখবেন দর্শক। কালু যখন চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘আমি যখন ক্ষেপি তখন বৃক্ষরে ভাবি তৃণ/আর ঘাসের ডগায় একবিন্দু পানি দেখলি মনে হয় আসমানের তারা/আমারে হিন্দু মুসলমান দুজনেই পিটায়’-- আমাদের শরীরে, মনে তখন শিহরণ জাগে।

অভিনয় ভাল লেগেছে প্রিয়াংশু চট্টোপাধ্যায়, রাইসুল ইসলাম আসাদ, গুলশান, সৈয়দ হাসান ইমাম, তাথৈ ব্যানার্জি ও চম্পার। নিরাশ করেছেন পাওলি দাম। তার কথা বলার সময় তাকানো দেখে মনে হয়েছে আধুনিক নারী। বাউল জীবনে তিনি একবারের জন্য ঢুকতে পারলেন না।

আর এই নিষ্ঠাতেই একজনই সবাইকে ছাপিয়ে সত্যিই হয়ে উঠেছেন লালন। কেন তিনি প্রসেনজিৎ, কেন তিনি টলিউডের একাই ইন্ডাস্ট্রি, তা আরও একবার প্রমাণ করলেন তিনি। লালন কী রকম ছিলেন, তার হাঁটা চলা, রাগ, অভিমান, গান গাওয়ার ধরন কিছুই জানা যায় না। শুধু বোটে বসে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর যে ছবিটি এঁকেছিলেন তাকে চেনার জন্য আমাদের সেটাই সম্বল। অথচ কী অসামান্য দক্ষতায় প্রসেনজিৎ তার অনুভূতিকে আর অধ্যবসায়কে অবলম্বন করে লালনময় হয়ে উঠেছেন। বাউল জীবনে মধ্যে পুরো মাত্রায় ঢুকে না গেলে এই অভিনয় সম্ভব নয়। তাকে দেখে মনে হয়, লালন বোধহয় এমনই ছিলেন।

একই সঙ্গে যৌবন এবং বার্ধক্যের লালনকে কী অনায়াস ভঙ্গিতে উপস্থাপন করেছেন প্রসেনজিৎ। শেষ দৃশ্যে জাত ফকিরের মতো গেয়ে উঠেছেন, ‘মিলন হবে কতদিনে, আমার মনের মানুষের সনে’। সেলুলয়েডের পর্দায় লালনকে দেখে মনে হচ্ছে ইনি আমার কতদিনের চেনা। আর এখানেই সার্থক প্রসেনজিৎ।

ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনায় ‘মনের মানুষ’ মুক্তি পাওয়ার আগেই পেয়ে গেছিল ভারতের চলচ্চিত্র উৎসবের সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার ‘স্বর্ণময়ূর’। হয়তো আরও অনেক পুরস্কার গৌতম ঘোষের জন্য অপেক্ষা করছে ছবিটিকে ঘিরে। রক্তেমাংসে গড়া ঊনবিংশ শতকের লালনকে প্রত্যক্ষ করার জন্য গৌতম ঘোষকে চলচ্চিত্রপ্রেমীরা মনে রাখবেন বহুকাল, এমন প্রত্যাশা অমূলক মনে হয় না একটুও।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।