ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

লাইফস্টাইল

দেশবরেণ্য দুই শিল্পীর মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার গল্প

বিপুল হাসান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩১ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০১১

আমাদের শিল্প-সংস্কৃতি অঙ্গনের বরেণ্য দুই ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু ও রাইসুল ইসলাম আসাদ। একজন শিল্পস্রষ্টা নেপথ্যের কারিগর, অন্যজন কৃতি অভিনেতা।

ছোটবেলা থেকে একই এলাকায় বড় হয়ে উঠেছেন। একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে একই সঙ্গে ঢাকা থিয়েটারের মাধ্যমে গ্র“পথিয়েটার আন্দোলনে পালন করে চলেছেন অগ্রণী ভূমিকা। স্বাধীনতা দিবস উপলে এই দুই বীর মুক্তিযোদ্ধা বাংলানিউজের আমন্ত্রণে বলেছেন মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার গল্প।

মিলিটারি আসলে হাতবোমা মেরে খতম করে দেব : নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু

ঢাকা শহরে আমি বড় হয়ে উঠেছি পল্টন এলাকায়। এটি সবসময়ই ছিল ঢাকার রাজনৈতিক আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল। ছেলেবেলায় চোখের সামনে দেখেছি স্বৈরশাসক আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলন। স্কুলে থাকতেই আমাদের মাথায় ঢুকে যায় যে, পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের শোষণ করছে, ন্যায়সঙ্গত অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর আমি ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি। তবে বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রশ্নে আমরা ছাত্রলীগ বা ছাত্র ইউনিয়ন ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করেছি। ৭০-এর নির্বাচনের পরও যখন আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে দেওয়া হলো না, তখন থেকেই অন্যসব বাঙালির মতো আমরাও ছিলাম বিুব্ধ। আমরা দলমত ভুলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ভাষণ যেমন শুনতাম, তেমনি শুনতাম মাওলানা ভাসানির ভাষণও। মুক্তিযুদ্ধে দলে দলে যোগ দেওয়ার পটভূমিটা গড়ে তুলেছিলেন আসলে সেই সময়ের রাজনীতিকরা। তারা জনগণকে বোঝাতে সমর্থ্য হয়েছিলেন যে, বাঙালিকে সব জায়গায় অবদমিত রাখা হচ্ছে।

এ দেশের মাটিতে নিজের মতো কও বেঁচে থাকার স্বপ্নই আমাদের আসলে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে প্রেরণা জোগায়। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষনের পর শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। পল্টন এলাকায় আমি, আসাদ, বেবী, জমি, ইমরান ও আরো অনেকে মিলে ব্যরিকেড গড়ে তোলার স্মৃতি এখনো চোখের সামনে ভাসে। রাস্তায় বড় বড় পাইপ আর গাছের গুঁড়ি ফেলে আমরা ব্যরিকেড গড়ে তুলেছিলাম। নিজেরাই কিছু হাতবোমা বানিয়ে গাছের গুড়ির আড়ালে বসে থাকতাম, কখন পাকিস্তানি সৈন্যরা আসে। মিলিটারি আসলে তাদের হাতবোমা মেরে খতম করে দেব, এই ছিল আমাদের উদ্দেশ্য। কিন্তু হাতবোমা মেরে কি মেলেটারি রুখে দেয়া যায় ?  আসলে মিলিটারিদের সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই ছিল না যে, হাত বোমা দিয়ে ওদের রুখে দেওয়া সম্ভব না। মিলিটারিদের সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকলেও এই আমরাই রণাঙ্গনে তাদের সাথে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনি।

আমাদের বাসা রাজারবাগ পুলিশ লাইনের কাছাকাছি। ৭১-এর ২৫ মার্চ সবার আগে মিলিটারিরা রাজারবাগে ধ্বংসলীলা চালায়। সে কি ভয়াবহ রাত, গুলি-গোলার আওয়াজে আমাদের বাড়ি থরথর করছিল। মনে হচ্ছিল এই বুঝি ট্যাংকের গোলা এসে আমাদের বাড়ি পড়লো। দুইদিন পর কারফিউ শিথিল হলে আমি বেরিয়ে পড়ি অজানা গন্তব্যে। প্রথমে জিঞ্জিরা যাই। কিন্তু সেখানেও মিলিটারি হামলার আশঙ্কায় বিক্রমপুরের দিকে চলে যেতে হয়। এর মধ্যে খবর পাই, চট্রগ্রামে সৈন্যরা নাকি লড়াই করছে। আমি তাদের সঙ্গে যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে পায়ে হেঁটে চৌদ্দগ্রাম-ফেনী হয়ে চট্রগ্রাম পৌঁছাই। কিন্তু ততোক্ষণে পাকিস্তানি মিলিটারিদের তোপের মুখে বিদ্রোহী সেনারা পিছু হটে আখাউড়া হয়ে আগরতলায় শেল্টার নেয়। আমি তাদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য আগরতলা পৌছাঁই। সেখানে মেজর খালেদ মোশারফ, মেজর হায়দার ও আরো অনেকের সঙ্গে আমার দেখা হয়। তারা আমাকে বলেন, ট্রেনিংয়ের সব ব্যবস্থা আমরা করছি। তুমি ঢাকায় গিয়ে লোকজন নিয়ে আসো। আমি তাদের নির্দেশ মতো কাজ করি।

পাকিস্তান বিদ্বেষ পরিণত হয় প্রচন্ড ঘৃণায় : রাইসুল ইসলাম আসাদ

ঢাকা শহরে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের জন্য স্বাধীনতার আগে জায়গা ছিল একটাই, পল্টন ময়দান। পল্টনে বড় হয়ে উঠেছি বলে এ এলাকার রাজনৈতিক হাওয়াটা উপো করা সম্ভব হয় নি। আমাদের পাড়ায় উঠতি বয়সীদের একটা কাব ছিল, নাম একতা বিতান। ঐ কাবে খেলাধূলার পাশাপাশি আমরা রাজনীতি নিয়ে তর্ক-বিতর্কেও মেতে থাকতাম। সে সময় রাজনীতিতে দুটি জনপ্রিয় কণ্ঠস্বর ছিল। একদিকে মাওলানা ভাসানী, অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। ভাসানী করেছেন মেহনতি মানুষের রাজনীতি আর বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ছিল জাতীয়তাবাদের। আপাতদৃষ্টিতে দুজনকে আলাদা রাজনীতি করতে দেখা গেলেও বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রশ্নে তারা ছিলেন এক। ভাসানী কখনোই বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ছিলেন না। তিনি সবসময় সহায়ক শক্তি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকেছেন। বঙ্গবন্ধু যেমন বলেছেন, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। তেমনি ভাসানীও পল্টনের জনসভায় বলেছিলেন, লাকুম দিনুকুম ওয়ালিয়াদিন।   তোমরা তোমাদের নিয়ে থাকো, আমরা আমাদের নিয়ে থাকি।

ছোটবেলা থেকেই আসলে আমাদের মাথায় ঢুকে যায় যে, পাকিস্তানি আর আমরা এক জাতি নই। ওদের ভাষা আলাদা, পোশাক আলাদা, খাবার আলাদা। ওরা সংখ্যায় কম হলেও সব সুযোগ-সুবিধা ওরাই নিচ্ছে। সেনাবাহিনীতে বাঙালি অফিসার কম, সরকারী সিভিল সার্ভিসে বাঙালি অফিসার কম। মেধা ও দতা থাকলেও সরকারী চাকরিতে একটা পর্যায়ের পরে বাঙালিদের প্রমোশন দেওয়া হয় না। আমাদের দেশের সোনালী আঁশ রপ্তানির টাকায় পশ্চিম পাকিস্তানে গড়ে তোলা হচ্ছে বড় বড় ভবন আর কারখানা-ইন্ড্রাষ্ট্রি। এই বৈষম্য আর শোষণ আমাদের তরুণ মনে তীব্র রেখাপাত করে।

২৫ মার্চের গণহত্যার পর আমাদের পাকিস্তান বিদ্বেষ পরিণত হয় প্রচন্ড ঘৃণায়। তাই স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হলে আমি সূযোগ খুঁজতে থাকি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার। ঢাকায় তরুণদের খুঁজে বের করে করে মেলে ফেলা হচ্ছে, কাজেই আমাকে পালাতে হলো।   এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পালিয়ে ছিলাম জিঞ্জিরায়, তারপর কিছুদিন বিক্রমপুর। পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে ঢাকায় ফিরি। ভাগ্য সু-প্রসন্ন, ঢাকায় ফিরেই বাচ্চু ভাইয়ের দেখা পেয়ে গেলাম। তিনি বললেন, সবকিছু ঠিকঠাক করা আছে। চলো ট্রেনিংয়ে চলো। আগরতলায় ট্রেনিং নিলাম। তারপর ঢাকা উত্তর সেকশনের হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলাম। মুক্তিযুদ্ধে বায়তুল মোকাররম মার্কেটের সামনে গাড়ি বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে পাকিস্তানি মিলিটারিদের ভ্যান উড়িয়ে দেওয়ার অপারেশনটি আমার মুক্তিযোদ্ধের একটি স্মরণীয় অভিজ্ঞতা।

বাংলাদেশ সময় ১৭১০, মার্চ ২৪, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।