একটু নাক উঁচু স্বভাব তার ! গায়ে হলুদ কিংবা বিয়ে- এ জাতীয় যেনতেন স্টেজ শো-তে তিনি গান গাইতে পারেন না। তবে ভাল মানের প্রোগ্রামে রুচিশীল গান গাওয়ার সুযোগ থাকলে সেটা ছাড়েন না।
মানসম্মত গানের কাঙাল এ শিল্পী হচ্ছেন চট্টগ্রামের হৈমন্তী। ভারতের খ্যাতিমান শিল্পী হৈমন্তী শুক্লার নামের সঙ্গে শুধু মিল নয়, কণ্ঠের কারুকাজের সঙ্গেও আছে তার মিল। চট্টলার এই গানের পাখির পুরো নাম হৈমন্তী রক্ষিত মান।
হৈমন্তী তার নাক উঁচু স্বভাবের কথা অকপটে স্বীকার করেন নিজেই। বলেন, ‘যেনতেন প্রোগ্রামে বেশি গেয়ে হিট গায়িকা হতে চাইনা, ভাল গান গেয়ে ভাল শিল্পী হয়েই বাঁচতে চাই। ’
সম্প্রতি বাংলানিউজের চট্টগ্রাম ব্যুরো কার্যালয়ে এসেছিলেন হৈমন্তী। সঙ্গে ছিলেন স্বামী অসীম দাশ। হাসি, আড্ডায় বাংলানিউজের কাছে অকপটে তুলে ধরেন মনের অনেক কথা, প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মিল-অমিলের পাশাপাশি স্বপ্নগাঁথাও।
অকপটেই হৈমন্তী বলেন, ‘সস্তা প্রচার, প্রসার আর জনপ্রিয়তার লোভে আমি আবোল তাবোল সুরে, আজেবাজে কথার সস্তা গান করতে পারব না। এমন গান করব যাতে আমার সম্মান নষ্ট না হয়। মানুষ যেন গানগুলো মনে রাখে। ’
এই নাকউঁচু স্বভাবের কারণেই কি মাঝে মাঝে আড়ালে চলে যাওয়া? প্রশ্নটি শুনে হেসে উঠলেন হৈমন্তী। বললেন, ‘আসলে শুধু সেটা নয়, পড়ালেখা করছি, সংসার সামলাচ্ছি, গানও করছি। অনেক চ্যানেল থেকে গান করার অফার আসে, সময় মেলে না বলে ফিরিয়ে দিতে হয়। ’
‘আমাদের সঙ্গীত জগত তো ঢাকা কেন্দ্রীক। শুরু থেকে ঢাকায় স্থায়ী হতে পারিনি, সেটা আমাকে কিছুটা পিছিয়ে দিয়েছে’ - খানিকটা হতাশ কণ্ঠে এমন অভিব্যক্তি জানালেও নিজের অবস্থান নিয়ে শতভাগ সন্তুষ্ট হৈমন্তী। তিনি বলেন, ‘আমি নিয়মিত দেশে-বিদেশে স্টেজ শো করছি। সিনেমায় প্লে- ব্যাক করছি। অ্যালবাম বেরুচ্ছে। প্রতিষ্ঠা পেয়েছি, তবে রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে যাব এমন শিল্পী আমি হতে চাইনা। ’
কথায় কথায় প্রতিষ্ঠা পেতে দীর্ঘ সংগ্রামের কথাও জানালেন হৈমন্তী, আট বছর বয়সে গানে হাতেখড়ি চট্টগ্রামের সংগীতগুরু বাণী কুমার চৌধুরীর কাছে। এরপর একে একে শিখেছেন বাসুদেব ঘোষ, সোহরাব খান, ওস্তাদ নীরদ বরণ বড়–য়ার কাছে। এখনও নিয়মিত তালিম নিচ্ছেন ওস্তাদ স্বর্ণময় চক্রবর্ত্তীর কাছে।
আক্ষেপ করে বললেন, ‘নিয়মিত চর্চা, সাধনা আর স্টেজ শো করতে করতেই এতদূর এসেছি। আর এখন তো প্রতিষ্ঠা পেতে গান শিখতে হয় না। প্রতিষ্ঠিত কোন শিল্পীর জনপ্রিয় দুটো গান কোন রিয়্যালিটি শো-তে গাইতে পারলেই হিট !’
তবে এভাবে যারা উঠে আসে তাদের নামের পাশে ক্লোজ আপ, অমুক চ্যানেল, তমুক চ্যানেল আরও কত মার্কিং থাকে। যারা সাধনা করে প্রতিষ্ঠা পায় তাদের মার্কিং লাগেনা - হাল আমলে তথাকথিত জনপ্রিয়তার জোয়ারে ভাসা শিল্পীদের নিয়ে এমনই প্রতিক্রিয়া হৈমন্তীর।
নিজের শিল্পী হবার পেছনে মা-বাবার অবদান সবচেয়ে বেশি বলে মনে করেন হৈমন্তী। আর গানের জগতে প্রতিষ্ঠায় বেশি অবদান স্বামী অসীম দাশের।
হৈমন্তী বলেন, ‘মা-বাবা না চাইলে কখনো গান গাওয়া হত না। তবে বাবা সরকারী চাকুরে, মা সংসার আর ভাই বোনদের সামলাতেই ব্যস্ত। এজন্য সুযোগ থাকলেও বিয়ের আগে দেশে-বিদেশে অনেক জায়গায় গিয়ে স্টেজ শো করতে পারতাম না। আমার স্বামী সহযোগিতা নিয়ে পাশে না দাঁড়ালে আজ এতদূর আসতে পারতাম না। হয়ত বিয়ের পর আমার গানই বন্ধ হয়ে যেত। ’
‘সাজঘর’ ছবিতে ইমন সাহার সুরে গানে কণ্ঠ দেয়ার মাধ্যমে প্লেব্যাকে যাত্রা শুরু হৈমন্তীর। এরপর থেকে ১০টি চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। এ পর্যন্ত অ্যালবাম বের হয়েছে ১১টি। এর মধ্যে একটি অ্যালবাম জনপ্রিয় গায়ক আসিফ আকবরের সঙ্গে ডুয়েট।
আড্ডার পড়ন্তবেলায় কৈশোরের কথা তুলতে কোথায় যেন হারিয়ে যান হৈমন্তী। জানালা দিয়ে দূর আকাশে দৃষ্টি রেখে বলেন, ‘দুষ্টু ছিলাম, খুব দুষ্টু। মা-বাবার বকুনি ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। এখন অনেক শান্ত হয়ে গেছি। ’
কৈশোরের দুরন্ত হৈমন্তী এখনও সুযোগ পেলেই দুষ্টুমিতে মেতে উঠেন। সুযোগ পেলেই ছুটে যান গ্রামে। জলের শরীর ছুঁয়ে মিতালী গড়া কিংবা রোদ মেখে দূরন্তপনা এখনো চলে হৈমন্তীর।
চট্টলার গানের পাখির কাছে শেষ প্রশ্ন ছিল- বুকের মধ্যে অভিমান বেশি বলেই কি হৈমন্তীর ডাক নাম ‘মান’ ? সদা হাস্যোজ্জ্বল হৈমন্তীর সাবলীল উত্তর, না, না। আমার মধ্যে এতো মান-অভিমান নেই। আমি নিতান্তই সহজ-সাধারণ একটি মেয়ে। গানের মধ্যেই খুঁজে পাই নিজেকে।
হৈমন্তী রক্ষিত মান সবশেষে জানালেন, ভারতের জনপ্রিয় শিল্পী হৈমন্তী শুক্লার সঙ্গে মিলিয়ে পিসী নাম রেখেছিলেন হৈমন্তী, যেন তিনি পরিবারের সম্মান উর্দ্ধে নিয়ে যেতে পারেন।
শুধু পরিবার নয়, গান দিয়ে হৈমন্তী চট্টগ্রামের মুখ উজ্জ্বল করবেন, এমনই প্রত্যাশা তার গানের অগুনতি ভক্ত-শ্রোতার।
বাংলাদেশ সময় ১৬৩০, জুন ১৪, ২০১১