আজ সকালে
তোমাকে বিয়া করতে অইবো..
-আজকের দিনের মধ্যেই..
-কোন কথা নয়, চলো আমাদের লগে।
তিনজন মুরুব্বীর এমন অবান্তর কথা শুনে আমি চমকে গেলাম।
আমি জীবনে হয়তো এমন রসহীন-কমান্ডিং কথা কোনদিন শুনিনি। আমি মুরুব্বীদের চিনি ও জানি। এদের একজন পাশের গ্রামের হাছেন মুনশি, বাকি দু`জন একই গ্রামের মাতব্বর ছোরহাব ও মালেক। এই তিনজন যে কেমন সে আমার ভালোভাবেই জানা আছে। কোনদিন আমার সঙ্গে তারা খারাপ ব্যবহার করেনি। সুযোগের সৎ ব্যবহারও করেনি। কিন্তু আজ কেন এ তারা আমাদের বাড়িতে উপস্থিত হয়েছে! এমন অনাবিল কোকিলডাকা মর্নিং আওয়ারে আমি এমন বিব্রতকর পরিস্থিতির ফেস টু ফেস হবো তা ভাবতেও পারিনি।
কেবলমাত্র নাস্তা করে বন্ধু মুকুলের সঙ্গে দেখা করতে যাবো। ঠিক ওই মূহুর্তে ওদেরই গ্রামের ওই তিন মুরুব্বী আমার সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো রিলিজ করেছে। আমি চশমাটি না পড়ে হাতে রেখেই মুরুব্বীদের প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে তাদের সালাম দিলাম। বললাম কেমন আছেন আপনারা? আমার কথা আর শেষ হলো না ছোরহাব মাতব্বরের হুমকিতে। সালাম টালামের দরকার নাই। বিয়া করবা কিনা কও? আমি তাদের মতলব বোঝার চেষ্টা করতে লাগলাম। অবাক হলাম। বললাম, বিয়ে! এ কী বলছেন আপনারা? আর এমন করেই বা কেন বলছেন। আমি তো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা। এবারো তাই, কথা শেষ হতে না হতেই সতীর্থ মালেক মাতব্বরও গর্জে উঠলো। এ্যাঁ! পোলায় দেহি কিছুই জানে না, দেইখা মনে হয় আকাশ থেইকা পড়লো। বলি এ অ্যাকটিংয়ের উস্তাদ কে? সঙ্গে সঙ্গে ছোরহাব মাতব্বরও বলে উঠলো, রাইতের বেলায় বাকুম বাকুম খেলবা, সাধের ময়ুরীরে নিয়া চুংগ্যা ফুঁকতে পারবা, বিয়া করতে পারবা না? এইডা তো হইতে পারে না।
ইতিমধ্যে আমার আলমগীর ভাইয়া ও ভাবী উত্তেজনাপূর্ণ কথোপকথন শুনে ঘর থেকে বেড়িয়ে এসেছে। আলমগীর ভাইয়া ঘরের বারান্দায় এসে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। ভাইয়া বললো, কি ব্যাপার বলুন তো মুনশি সাহেব? এই সকালে আপনারা? এবারেই প্রথম হাছেন মুনশি তার কোকিল কন্ঠি কন্ঠ শোনালেন।
আলম সাহেব, আমি আর কি কইমু। লজ্জা শরমের কতা। দুনইয়ায় গজব পড়বো। কথাগুলো পান চিবুতে চিবুতে বলে ডান দিকে দুই কদম গিয়ে ফের পেছন দিকে দুই কদম গিয়ে পানের পিক ফেললো। এটা ইতোমধ্যে তার শ্রী বাড়ি গ্রামের ইয়াং জেনারেশনদের মধ্যে ‘মুনশি স্টাইল’ নামে খ্যাতি পেয়েছে।
তাছাড়া ‘দুনইয়ায় গজব পড়বো’ উক্তিটিও কিশোরপ্রিয় হয়ে পড়েছে। ভাইয়া মুনশির কথার মাথামুণ্ডু বুঝতে পারলেন না। মাথা চুলকাতে চুলকাতে মুনশিকে বললেন, মুনশি সাহেব, কি এমন কথা, লজ্জা-শরমে বলতেও পারবেন না? হাছেন মুনশি পানের পিক ফেলে এক কদম সামনের দিকে এগিয়ে এসে ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে আবারও বললো, দুনইয়ায় গজব পড়বো, আপনেকে কি আর কইমু আলম ছাহেব। আপনের ছোডো ভাইডা একখান অকাম কইরা ফালাইছে। গত রাইতে হে আমগো গিরামের ইয়াহিয়ার মাইয়ার লগে অকাম কইরা পলাইয়া আইছে। কথাগুলো শুনে তো আমি অবাক! রাগে ক্ষোভে গর্জে উঠলাম। শাট আপ, মুখ সামলে কথা বলবেন মুনশি। ব্লাক মেইল করার চেষ্টা করবেন না। ফের কথা ছাড়লে মুখে স্ট্যাপলার মেরে দেবো। ভাবী আমার কাছেই ছিল। আমাকে রাগতে দেখে টেনে ভেতরে নিয়ে গেলো। ভাইয়া মাতব্বরদের কথার মধ্যে যে রহস্য আছে বুঝতে পেরে তাদের ঘরের ভিতরে নিয়ে এলো। মাতব্বরদের কাছ থেকে যা শুনলো তাতে আমার অবস্থা আটাশ। আমি নাকি ইয়াহিয়া আহমেদের মেয়ে শিমুর রুমে ঢুকে তাকে নষ্ট করে পালিয়েছি।
তাও নাকি আবার ছোরহাব মাতব্বর দেখেছে। সবচেয়ে বড় কথা মেয়েটিও নাকি স্বীকার করেছে। এখন আমাকে তারা শিমুকে বিয়ে করতে বলছে। নচেত তারা এলাকায় বিচার ডাকবে। ভাইয়া তাদের কথা শুনে বিয়ের পাকাপাকি কথা দিয়ে দিলো। আমার কাছে কিছু শুনতেও চাইলেন না। ঘটনাটা কি সত্যি নাকি মিথ্যা কিছুই জানলেন না। আমি এখন কি করবো? কোন কিছু ভাবতেও পারছিনা। চিন্তা করছি মুকুলের কথা। মুকুল কি ভাববে? ছি! ছি! সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে মুখ দেখাবো কি করে? ওরই তো বোন শিমু। ভাইয়া মাতব্বরদের বিদায় দিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। আমি বসে ছিলাম ভাবীর কাছে খাটের উপর। উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, ভাইয়া তুমি অন্তত বিশ্বাস করো। তোমার ছোট ভাই এমন কাজ করতে পারে না।
আমি আরও বলতে চাচ্ছিলাম। আমাকে থামিয়ে দিয়ে ভাইয়া আমাকে কাছে টেনে নিলো। বললো, আমি জানি রে, আমি জানি। আমার ছোট ভাই এ কাজ করতে পারে না। এটা অসম্ভব। আমি ভাইয়ার কাছ থেকে একটু দুরে সরে এসে বললাম। কিন্তু তুমি যে কথা দিয়ে দিলে বিয়ের। ভাইয়া আমাকে আবারো কাছে টেনে নিয়ে খাটের উপর বসলো। আমাকেও পাশে বসালো। আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করলো আমাদের পরিবারের মান সম্মানের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের বর্তমান সিচুয়েশন, লোকদের সেন্টিমেন্ট । তাছাড়া এও বললো শিমু মেয়েটা তো বেশ ভালোই। স্মার্ট, ছাত্রী ভালো। হয়তো সেও কোন পরিবেশের শিকার। কিন্তু আমি বুঝতে নারাজ হলাম। ভাইয়া আমাকে বোঝানোর দায়িত্বটা ভাবীর ওপর দিয়ে সে ইয়াহিয়া আহমেদের বাড়ির দিকে রওয়ানা হলো।
গত রাতে
-কে, কে, কে ওখানে?
সিডি প্লেয়ারের সাউন্ড লো করে পরবর্তী শব্দ শোনার অপেক্ষায় থাকলো। হঠাৎ এমন শব্দ হবে শিমু প্রস্তুত ছিলো না। শব্দের সঙ্গে সঙ্গে হৃদয় মনিটরের গ্লাসটা যেন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো। দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকালো। না, এসময় তো আব্বু, আম্মুদের আসার কথা নয়। সবে মাত্র রাত সাড়ে ৮টা। বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হবে তবেই তো আসবেন। কিন্তু এ কিসের শব্দ? শিমুর ভাবনা শেষ হতে না হতেই আবারও সেই একই শব্দ, দরজা খোলার শব্দ। শিমু এবার একটু জড়োসড়ো হয়ে জানতে চাইলো, কে, কে, কে ওখানে? কথা বলছেন না কেন? কোন সাড়া শব্দ নেই। বাড়িটি সম্পূর্ণ ফাঁকা থাকার কথা একমাত্র শিমু ছাড়া। শিমুর আব্বু আম্মু আর ভাই পাশের গ্রামে বিয়ের অনুষ্ঠানে গেছে। শিমুকে নেওয়া হয়নি। উঠতি বয়সের মেয়েদের নিয়ে বিয়ে বাড়িতে যাওয়াটা ইয়াহিয়া আহমেদ পছন্দ করেন না।
ইদানিং বখাটে ছেলেদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাবা মার সামনে মেয়েদের টিজ করতে তারা দ্বিধা করে না। বাড়িতে কেউ নেই দেখে শিমুর মনে এক অজানা যাদুর ছোঁয়ার অনুভব হলো। রোবটের মতো ড্রেসিং টেবিলের সামনে মনের মত করে সাজতে লাগলো। ফিরোজা রঙের রাজশাহী সিল্ক শাড়ি, সাদা ব্লাউজ, কপালে ভেলভেটের গোল ফিরোজা রঙের টিপ আর মাথায় টগরের থোঁকা। নিজেই নিজেকে বিশ্বাস করছে না। ড্রেসিং টেবিলে ওটা কার প্রতিবিম্ব! ওকি শিমু! ওতো অনেক বড় হয়ে গেছেরে! বিস্ময়ের ঘোর যেন শিমুর কাটছিল না। কি যে অসাধারণ সুন্দর, এ যেন এক অপরিচিতা ইসমত আরা শিমু। সিডি প্লেয়ারে কানিজ সুবর্ণার গানের তালে তালে নিজেকে হারিয়ে নিতে চাইলো এক অজানা রাজ্যে, এক অজানা স্বপ্নের মানুষের কাছে। ঠিক এমন সময় হলো একটা শব্দ, অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দ, সেই শব্দটা। হঠাৎ ওর রুমের দরজাটা খুলে গেলো। গামছা দিয়ে মুখ ঢাকা একজন আগন্তুক প্রবেশ করে বললো, ম্যাঁয় কেকে হুঁ। কেকে হু মানে? শিমু ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে জানতে চাইলো। আগন্তুক তার মুখের ওপর থেকে গামছা সরিয়ে ফেলে বললো। ম্যাঁয় কামরুল হাসান কবির হুঁ। কী চিনতে পেরেছো? শিমু তাকে ঠিকই চিনলো কিন্তু এতো রাতে তার রুমে সে কেন এলো। তার মতলবটাই বা কি? শিমু খুব ভয় পেলো। কোনো রকমে সাহস সঞ্চার করে বললো, আপনি চলে যান বলছি, কাছে আসার চেষ্টা করবেন না। আমি চিৎকার করবো। কিন্তু কেকে শিমুর কথা শুনতে নারাজ। সে হিন্দি সিনেমার এন্টি হিরোর মতো বলতে লাগলো, তুমহে কিস্ বাত কি চিন্তা হ্যায়? ইসমে ডরনে কি কোই বাত নেহী। তুম ফিজুল পেরেশান হো রহে হো। ঘাবরাও মাত। আই লাভ ইউ শিমু, আই লাভ ইউ। মুঝে তুম পার ভরসা হ্যায়। কামরুল হাসান কবির সংক্ষেপে কেকে শিমুদের গ্রামেরই এক ছেলে। এসএসসিতে হাট্রিক করে রাজনীতিতে ঢুকেছে। বাজার ক্লাবের সদস্য হয়েছে। সেখানে বসে বন্ধুদের নিয়ে স্যাটেলাইট চ্যানেল দেখে। রাস্তাঘাটে মেয়েদের টিজ করে। নেশা করে। শিমুর কাছে কেকের একথা নতুন নয়। শিমুকে কেকে রাস্তায় যখনই পেয়েছে এই একই ডায়লগ শুনিয়েছে। শিমু কেকের কথা শুনে রেগে গেলো। বললো, খবরদার এই সব সিনেমার ডায়লগ আর আমারে দিবেন না। যান বলছি, এক্ষুনি চলে যান। হঠাৎ কেকে অন্যরকম হয়ে গেল। বললো, তো ঠিক হ্যায়, দেখি তুমহে তেজ কতো। কেকে শিমুর দিকে ক্রমেই অগ্রসর হচ্ছে। হঠাৎ শিমু দরজার দিকে সরে গেলো। কেকে একলাফে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। অসহায় শিশুর মতো মেয়েটা উপায়ন্তর না দেখে চিৎকার শুরু করলো। কেকে আদরের সুরে বলে উঠলো, কই ডর নেহি, ম্যায় ঠিক করদুংগা। শিমু কাঁপা কন্ঠে কেকে কে বললো, প্লিজ কবির ভাই, আমাকে নষ্ট করবেন না। প্লিজ। কে শোনে কার কথা। শিমুর ওপর কবির ঝাঁপিয়ে পড়লো। শিমু আপ্রাণ চেষ্টা করে কেকের মুখ থেকে ওর মুখ সরিয়ে ফেললো। শিমুর বমির দশা। বাইরে কথার আওয়াজ শুনতে পেয়ে সুচতুর কেকে পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গেলো। অবশ্য ছোরহাব ও মালেক এ নিশাচর মাতব্বর যুগল কেকের পেছন পিঠ দেখে ফেলে। কিন্তু পিছে ধাওয়া করে কাজ হয়নি। এক দৌড়ে কেকে পালিয়েছে। হাছেন মুনশিও ছিলেন। মুনশি শিমুকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। ভালোভাবে দেখে বলে উঠলেন, দুনইয়ায় গজব পড়বো। তারা তিনজনে শলাপরামর্শ করতে লাগলো। বিচার বসাতে হবে। তার আগে জিগাও মাইয়াডাকে যে পোলাডা কেডায়। ইতোমধ্যে বিয়েবাড়ি থেকে শিমুর আব্বু, আম্মু ও ভাইয়া চলে এসেছে। মাতব্বরদের কথা শুনে তো তারা অবাক। শিমুর মা দৌঁড়ে মেয়ের রুমে গিয়ে দেখে শিমু জড়োসড়ো হয়ে খাটের উপর বসে আছে। মুখে লিপস্টিকের মাখামাখি। গোলাপের মতো মুখটি ফ্যাকাসে হয়ে গেছে যেন। লজ্জা, শোকে, রাগে, অপমানে শিমু নির্বাক হয়ে গেছে। পাথরের মতো বসে রয়েছে। হরিণির মতো দুনয়ন পলকহীন, অশ্রুমালা মাঝে মধ্যে গড়িয়ে পড়ছে। যেন প্রদর্শনীর কোন বস্তু মাতব্বরেরা দুনয়ন ভরে দেখছে। মুকুল শিমুর কাছে গেল। ঠোটের লিপস্টিক সারা মুখে ছড়ানো দেখে মুকুলেরও লজ্জা লাগলো। মাতব্বরদের শিমুর রুম থেকে সরিয়ে শিমুর মুখটি তোয়ালে দিয়ে পরিস্কার করে বললো। বোন আমার, কি হয়েছে সব খুলে বল আমাকে? কিন্তু শিমু একদম চুপ। শিমুর আব্বু আম্মু কি করবে কি বলবে বুঝতে পারছে না। মাতব্বরদের একটাই কথা হেই পোলাডা কেডা, মাইয়ার কাছে জিগাও। তার বিচার অইবো। মুকুল শিমুর পাশে ফ্লরে হাটু গেড়ে বসে আদরের বোনটিকে প্রশ্ন করছে। শিমুর কান্না ছাড়া আর কোনো ভাষা নেই। ঘেমে একাকার হয়ে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে গোলাপে শিশির জমেছে। সারা মুখে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম যেন কামড়ে আছে, সরতে চাচ্ছে না। শিমুর মা তার কাপড়ের আঁচল দিয়ে গোলাপ থেকে শিশির কণা সড়াতে চেষ্টা করলেন। গোলাপ যেন একটু নড়ে গেলো, পাপরি খুলে যাবার দশা। একমাত্র বড় ভাই ও আব্বুর ফেস টু ফেস হয়ে শিমু একসময় মুখ খুললো। আর সঙ্গে সঙ্গে মুকুল দাঁড়িয়ে গেলো। একটু দুরে গিয়ে বললো। শিমু! এ কী বলছিসরে তুই? তোর মাথা ঠিক আছে তো? শিমুর গলা শুকিয়ে আসছে। তবুও ভাইয়ার কথার জবাব দিতে লাগলো। মুকুল বিশ্বাস করতে রাজি নয়। মুকুলের সঙ্গেই যে সে পড়ে। ভার্সিটির ইয়ারমেট।
আজ রাতে
ভাইয়ার সাথে বোকা বোকা ভাব নিয়ে বর সেজে চললাম বিয়ে করতে। আমার কাছে মনে হচ্ছে হয়তো স্বপ্ন দেখছি আমি। বরযাত্রী হিসেবে আমার সঙ্গে আছে মাত্র চার জন প্রতিবেশি। আত্মীয় স্বজনের মধ্যে শুধু একজন দুলাভাই। বিয়েতে কোনক্রমেই রাজি হতাম না। শুধু ভাইয়ার কথা রাখতে গিয়ে আমি বন্ধুর বোনকে বিয়ে করতে যাচ্ছি। তা স্বাভাবিকভাবে হলেও একটা কথা ছিল। আমাদের এগিয়ে নিতে ইয়াহিয়া আহমেদ নিজেই এলেন। বাড়ি দেখে মনে হচ্ছে না বিয়ে বাড়ি। তারপরও লোকজনের একটু ছুটোছুটি বেশি। দেখলাম মুকুলকে। আই ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করলাম। বোঝালাম, বন্ধু, একটু শান্ত হ, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার বিয়ে হয়ে গেলো। মুকুলই প্রথমে আমার কাছে এলো। আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। বুঝলাম আমাকে জড়িয়ে ধরার পরই ও অনেকটা হালকা হলো। চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে। আমার ভাবী আমাকে নিয়ে গেলো শিমুর কাছে। দরজা দিয়ে ঢোকার সময় অসাবধানতার কারনে কপালে পেলাম ব্যথা। আহ্ শব্দ মুখ দিয়ে বেড়ুনোর সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্য করলাম শিমু হকচকিয়ে আমার দিকে তাকালো। বুঝতে চেষ্টা করলাম, শিমুর এই তাকানোর মধ্যে কি লুকিয়ে আছে। দেখলাম শিমু মেরুন রঙের ওড়না জড়িয়ে বসে আসে। ওর পাশে ওর দুই কাজিন বসা মাত্র। ভাবী আমাকে নিয়ে ওর পাশে বসালো। মুকুল এতক্ষণে ক্যামেরা নিয়ে কয়েক কপি ছবি তললো। আমার আর শিমুর কাছে এসে শিমুর ওড়নার একটা অংশ ঠিক করে আমার হাত ধরলো। কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না। আমার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে চলে গেলো। আমিও কেমন যার সঙ্গে ক্যাম্পাসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতাম আর তার সঙ্গে এখন কথা বলতে পারলাম না। ভাবী শিমু আর আমাকে বিবাহিত জীবন সম্পর্কে নানা রকম জ্ঞান দিতে লাগলো। সময়ের টানে শিমু আর আমাকে রেখে সবাই চলে গেলো। আমি শিমুর দিকে তাকালাম। একি সেই বন্ধুর ছোট্ট বোন শিমু নাকি অন্য কেউ। বললাম, এতো সুন্দর তুমি, আগে জানতাম না। শিমু আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে বললো, তুমি এতো কিছু জেনেও এ বিয়েতে রাজি হলে? তুমি জানতে চাইবে না আসলে কি ঘটেছিল গতরাতে? শিমু আমাকে আগে থেকেই তুমি করে বলে। আজও দেখলাম তুমি করেই বলছে। আমি শিমুর মাথার ওড়নাটা একটু সরিয়ে বললাম, আমি জানি, কেকে এসেছিলো তোমার ঘরে। শিমু চমকে গেলো যেন। বললো, কেমন করে জানো? আমিও শিমুর কথার কোন উত্তর না দিয়ে বললাম, তুমি কি জানো যে তোমার সবচেয়ে ঘনিষ্ট বান্ধবী সালমা এখন সদর হাসপাতালে। শিমুর তাৎক্ষণিক উত্তর না তাতো জানি না। আমি শিমুকে পুড়ো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললাম। আজ সকালে মাতব্বররা আমাদের বাড়ি থেকে চলে আসার পর সালমার ভাই আমাদের বাড়িতে গিয়েছিল।
সঙ্গে সঙ্গে আমি সালমার ভাইয়ের সঙ্গে সদর হাসপাতালে যাই। গিয়ে দেখি সালমার সে যে কি অবস্থা। মুখের পুড়ো বাম পাশটা একেবারে ঝলসে গেছে। কেকে তোমার এখান থেকে ধাওয়া খেয়ে যেয়ে সালমার উপর আক্রমন চালায়। সালমার সঙ্গে পেরে উঠতে না পেরে এক পর্যায়ে মুখে এসিড মেরে চলে যায়। সালমাই আমাকে সব বলেছে। আমরা থানায় ইনফর্ম করেছি। কিন্তু আমি জানতে চাচ্ছি তুমি সবার কাছে আমার নাম বললে কেন? শিমু ওর বুকের ভেতর থেকে একটা শুকিয়ে যাওয়া গোলাপ কলি বের করে বললো, দেখো তো চিনতে পারছো কিনা? আমি গোলাপ কলিটি হাতে নিয়ে বললাম, না তো। শিমু আমার আরও একটু ঘনিষ্ট হয়ে বললো, গত ঈদে তুমি আমাকে উইশ করেছিলে। আমি প্রায় সারাক্ষণই এটি বুকের মধ্যে যতœ করে আগলে রেখেছি। তোমাকেও রাখতে চাই বলে। এমন সময় বাইরে জাহিদ ভাইয়ের কন্ঠ শোনা গেল। আমি শিমুর পাশ থেকে উঠে দরজা খুললাম। দেখি এসআই জাহিদ ভাই কামরুল হাসান কবির ওরফে কেকে কে ধরে নিয়ে এসেছে। এলাকার লোকজনের সমাগম বাড়তে লাগলো। হৈচৈ এর শব্দ শুনে শিমুও আমার পাশে চলে এসেছে। আমি ওর হাতটি শক্ত করে ধরলাম।