তুমি রোজ বিকেলে আমার বাগানে ফুল নিতে আসতে... গানটির কথা মনে হলে মনের ভেতর কি যেনো দোল খেয়ে যায়। আমি অবশ্য কারো বাগানে ফুল নিতে যেতাম না, তবুও এ গানটি কানে এলেই ভেসে ওঠে অনেক স্মৃতি, অনেক ভালো লাগা।
অন্তু আমার ছেলেবেলার বন্ধু। আমরা একই পাড়ায় থাকতাম। একসঙ্গে খেলতাম। সে সময় ভালোবাসা বিষয়টা ঠিক বুঝতাম না। তবে কারো মুখে ভালোবাসার গল্প শুনলে খুব লজ্জা পেতাম। এতোটুকু বুঝতাম, এটা লজ্জার পাওয়ার মতো কিছু।
অন্তু প্রায় বিকেলে আমাদের বারান্দার কাছে এসে আমাকে ডাকাডাকি করতো। আমি কখনো ঘুমাতাম, আবার কখনো বা পড়ার টেবিলে মুখ গুঁজে পড়তাম। আমার ছটফটে স্বভাবের কারণে পড়তে বসলেই পাশের ঘর থেকে বড় আপুর ধমকের সুর ভেসে আসত - ‘খবরদার পড়ার টেবিল থেকে উঠবি না। ’
কে শোনে কার কথা। আমি গুটি গুটি পায়ে দড়জার কাছে গিয়ে দিতাম ভোঁ-দৌড়।
-কিরে তোর পড়ালেখা নেই?
-আছে তো, কিন্তু বেশিক্ষণ পড়তে যে ভালো লাগে না।
-ফেল করবি তো।
-তুই আছিস না, আমাকে দেখাবি। তাহলেই তো পাস হয়ে যাবে।
-অ্যাহ.. কি সুন্দর কথা ‘আমাকে দেখাবি’। ম্যাডাম বুঝি আমাকে তোর পাশে বসাবে?
-তাওতো কথা। আচ্ছা ঠিক আছে কাল থেকে মন দিয়ে পড়বো।
মন দিয়ে পড়ালেখা হয় না অন্তুর। পরদিন আবার ঠিক বিকেল বেলা বারান্দায় সামনে এসে ডাকাডাকি। একদিন বিকেলে ৪/৫টা ফুল নিয়ে বারান্দার সামনে এসে হাজির হলো অন্তু। ওই দিন আমিও কি কাজে যেন বারান্দায় এসেছিলাম। অন্তু আমায় দেখতে পেয়ে ফুলগুলো লুকিয়ে ফেললো।
-কিরে অন্তু তোর হাতে কি?
-ফুল
-ফুল কিসের জন্য, তোর কি আজ জন্মদিন?
-না, তোর জন্য এনেছি। আজ ১৪ তারিখ তো তাই।
-কেন ১৪ তারিখে ফুল আনতে হবে কেন! আজতো আমার জন্মদিন না।
-আরে বোকা তুই কিছুই জানিস না, আজ তো ভ্যালেন্টাইনস ডে।
-এটা আবার কি?
-জানি না, তুই অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করিস, এই নে ধর। আমার অন্য কাজ আছে। আমি চললাম।
ওই দিন হাতে ফুল নিয়ে ভ্যালেন্টাইনস ডে কি জানতে গিয়ে চড় খেয়েছিলাম আপুর হাতে। পরে যখন বুঝতে পেরেছিলাম তখন অন্তুর কথা মনে করে খুব হাসি পেয়েছিল। চড় খেয়ে অন্তুর সাথে দেখা করিনি ৩ দিন। অন্তুও আর বারান্দার সামনে এসে ডাকাডাকি করেনি। হয়তো আমার সামনে আসতে লজ্জা করেছিল তাই। দেখা না পেয়ে অন্তুকে খুঁজে ছিলাম স্কুলে। অন্তুর বন্ধু পিয়াস জানালো অন্তু তিনদিন ধরে স্কুলে আসে না।
খুব চিন্তা হলো। স্কুল শেষ করে ওর বাসায় গিয়ে দেখি বাসায়ও কেউ নেই। দারোয়ান জানালো অন্তুরা গতকাল ঢাকা চলে গেছে। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। এরপর থেকে প্রতিদিন বিকেলে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে থাকতাম অন্তুর জন্য। কিন্তু অন্তু আর এলো না।
দেখতে দেখতে ৬টি বছর কেটে গেলো। আস্তে আস্তে ভুলে গেলাম অন্তুকে। এরই মধ্যে বিয়ে হলো বড় আপুর। বর ঢাকায় থাকে। একটা প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরি করে। আমার এইচএসসি পরীক্ষাও শেষ হয়ে গেলো। রেজাল্ট এখনো বের হয়নি। হাতে তাই অফুরন্ত সময়।
একদিন বিকেলে কেন যেন বারান্দায় গিয়েছিলাম। দেখি একটি ছেলে বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বেশভূষা দেখে মনে হলো শহর থেকে এসেছে। বেশ দেখতে ছেলেটি। কার সাথে যেন মিল খুঁজে পাচ্ছিলাম, ঠিক মনে করতে পারছিলাম না। ছেলেটি আমাকে দেখে বারান্দার ঠিক কাছে এসে দাঁড়ালো। আমি ভেতরে চলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই নাম ধরে ডাক দিলো সে। খুব চমকে গেলাম। ঠিক অন্তুর মতো কণ্ঠ না! হ্যাঁ অন্তুই তো। হঠাৎ করে মনের ভেতরে একটা আনন্দের ঢেউ খেলে গেলো। ঘুরে তাকাতেই অন্তু জিজ্ঞেস করলো- ‘কেমন আছো?’, আমি উত্তর দিতে গিয়ে আটকে গেলাম। আপনি, তুমি, তুই- কি বলবো ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না।
-চিনতে পারোনি পিয়ু? আমি অন্তু।
-তুমি বেশ বদলে গেছো চিনবো কীভাবে?
-পরীক্ষা কেমন হলো? তোমার অবশ্য ভালোই হবে, সারা দিন টেবিলে মুখ গুঁজে যেভাবে পরে থাকো!
-হুম, ভালো হয়েছে। তোমার খবর কি? হুট করে চলে গেলে, কিছু জানালে না।
-হুট করেই যে সিদ্ধান্ত হলো। তাছাড়া তোমার সাথে দেখা করতে.. না থাক।
-কদিনের জন্য এলে?
-এইতো ৩/৪দিন। আমার সঙ্গে দুইটা বন্ধু এসেছে ঢাকা থেকে। তা না হলে আরও কিছুদিন থাকতাম। তুমি কোথায় ভর্তি হবে কিছু ঠিক করেছো?
-এখনো ঠিক করিনি। বড় আপু বলেছে তার কাছে চলে যেতে। ওখানে ভর্তি কোচিং করাবে।
-ভালো বুদ্ধি। তোমার অবশ্য কোচিং না করলেও হবে। এমনিতেই চান্স পেয়ে যাবে।
-বেশি হয়ে গেলো না?
-এখন যেতে হবে। বন্ধুরা হয়তো খোঁজ করবে। দেখা হবে।
দেখা হয়েছিল অন্তু চলে যাবার কিছুক্ষণ আগে। বিদায় নিতে এসেছিল। আমার কাছ থেকে বড় আপুর বাসার ঠিকানা নিয়ে গেল আর ওর বাসার ঠিকানা দিয়ে গেল।
আমি ঢাকায় গেলাম দিন পনের পর। কোচিং ভর্তি হলাম। বিভিন্ন কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পরীক্ষাও দিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না পাওয়ায় ভর্তি হলাম একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে। ক্লাস শুরু হয়ে গেল। একদিন ক্লাস শেষে ক্যাম্পাসে বসে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছিলাম। কোথা থেকে যেন দৌড়ে এলো অন্তু। হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলো- ‘পিয়ু তুমি এখানে ভর্তি হয়েছো?
-হ্যাঁ। তুমি কোথা থেকে এলে, তুমিও কি?
-না না, আমি এখানে ভর্তি হইনি। এখানে এসেছি এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে।
-ভর্তি হয়েছো কোথায়?
-ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে।
-দারুণ!
এরপর থেকে প্রায়ই দেখা হতো অন্তুর সাথে। দুজনে একসঙ্গে ঘুরতাম। আড্ডা দিতাম। আস্তে আস্তে বন্ধুত্বটা অন্যদিকে মোড় নিতে শুরু করলো। বুঝতে পারছিলাম কিন্তু নিজেকে ফেরাতে পারছিলাম না। কেন যেন অন্তুর সবকিছুই ভালো লাগতে শুরু করলো। এক সময় দেখা সাক্ষাতের পরিমাণ বেড়ে গেল। আর এ খবর চলে গেল আমার বড় আপুর কানে। ব্যাস, আপু কড়া করে শাসন করে দিল। আর অন্তুকেও সাবধান করে দিলো।
কিন্তু ততোদিনে মন দেওয়া-নেওয়ার পর্ব শেষ। দুই পরিবার থেকেই চাপ আসতে লাগলো। পরিস্থিতি যখন খুব গরম তখন ডেসপারেট হয়ে দু’জনে ঠিক করলাম বিয়ে করে ফেলবো। তাহলে কেউ কিছু করতে পারবে না। যেই কথা সেই কাজ। ঠিক করলাম ভ্যালেন্টাইনস ডে’তেই বিয়ে করবো। বন্ধু-বান্ধবীদের নিয়ে সব আয়োজন করে ফেললাম। নির্ধারিত দিনে বিন্ধুদের নিয়ে নির্ধারিত কাজী অফিসে গিয়ে হাজির হলাম। কাজীর সঙ্গে কথা বলছিল অন্তু। আর আমি ওড়না মাথায় দিয়ে মাথা নিচু করে বসে ছিলাম।
হঠাৎ কানে খুব ব্যথা অনুভব করতে লাগলাম। মুখ তুলে দেখি বড় আপু আমার কান ধরে আছে, পাশেই দুলাভাই দাঁড়ানো। আমি ভয়ে যবুথবু হয়ে গেলাম। কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমাকে টেনে বাসায় নিয়ে গেলো। এরপর দুই পরিবারে বাকবিতণ্ডা, শালিস-নালিশ, কি বিচ্ছিরি অবস্থা। বড় আপু যখন আমাকে কোনো ভাবেই মানাতে পারছিলেন না তখন গ্রামে পাঠিয়ে দিলেন। তখন আমি তৃতীয় বর্ষে উঠেছি। আমার পড়াশোনার বারটা বাজতে লাগলো। এদিকে অন্তুও বাবা-মার সাথে রাগ করে লন্ডন চলে গেল।
লন্ডন গিয়ে নিয়মিত যোগাযোগ করতে লাগলো আমার সঙ্গে। আমাকে আশ্বাস দিলো বছর দু’য়েক থেকেই চলে আসবে দেশে। এরপর আমার বাবা-মায়ের কাছে ওর বাবা-মাকে পাঠাবেন। যেভাবেই হোক তাদের রাজি করিয়ে আমাকে বিয়ে করবে।
আমি অন্তুর কথা মতো দিন গুনতে লাগলাম। বাবাকে ম্যানেজ করে আবার এলাম ঢাকায়। অনার্স শেষ করলাম। অন্তুও ঢাকায় এলো।
কথামতো বাবা-মাকে পাঠালো আমাদের বাসায়। সব কিছুই ঠিক হয়ে যেতো, কিন্তু বাঁধ সাধলেন আমার বোন আর দুলাভাই। দুলভাইয়ের কোনো বন্ধুর ভাইয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করলেন।
সবকিছু আবার ওলটপালট হয়ে যেতে লাগলো। আমরা আবার সিদ্ধান্ত নিলাম পালিয়ে যাবো। শেষ পর্যন্ত আরেকটি ১৪ ফেব্রুয়ারিতে আমরা দু’জন পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করলাম এবং এক সপ্তাহের জন্য কাউকে কিছু না বলে চলে গেলাম কক্সবাজার।
মোবাইল নম্বর চেঞ্জ করায় কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিল না। ঢাকায় এসে শুনলাম আপু-দুলাভাইয়ের সঙ্গে দেখা করেছিল অন্তুর বাবা-মা। আরও এক সপ্তাহ অন্তুর বন্ধুর বাসায় পালিয়ে থাকার পর অন্তু নিজ থেকে ওর আর আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করলো। এভাবেই আস্তে আস্তে সবাই মেনে নিলো আমাদের। আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি আমাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী। দেখতে দেখতে কীভাবে একটি বছর কেটে গেল টেরও পেলাম না। আজ বিকেলে দু’জন টিএসসি ঘুরবো, বই মেলায় যাবো, আরও অনেক কিছু করব। আজ আর কেউ আমাদের আটকাবে না। আজ আর কোনো ভয় নেই।