ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

লাইফস্টাইল

ভালোবাসার কতরূপ!

মনোয়ার রুবেল, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১২
ভালোবাসার কতরূপ!

‘কাউকে বই ধার দিও না। বই ধার নিলে কেউ তার আর ফেরত দেয় না।

আমার লাইব্রেরিতে কেবল সেই বইগুলোই আছে যেগুলো লোকে আমাকে ধার দিয়েছিল’ - আনাতোল ফাঁ।
 
একসময় আমার পাঠ্য বইয়ের কভারে একটি করে বাণী লিখে রাখতাম। কেউ যখন প্রথম আমার বই উল্টাতো একটি চমৎকার বাণী পেতো। সে সময় আনাতোল ফাঁর উক্তিটি আমার অসম্ভব ভালো লেগেছিল। বই ধার সংক্রান্ত এই বাণীতে আমি আমার পাথেয় খুঁজে পেয়েছিলাম। বই ধার করার মহান ব্রত নিলাম। অতঃপর ‘নো’ ফেরত। বন্ধুগণ আমার চাইতেও সচেতন ছিল। তারা বই ধার দেওয়ার ব্যাপারে যতটা না সক্রিয় ছিল ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে তার চাইতে বেশি ক্রিয়াশীল ছিল। ফলে বই ধার নিয়ে সুবিধা করতে পারছিলাম না। একবার বই ধার নিয়ে তা অস্বীকার করায় তারা মেরে আমার হাড্ডি ভেঙেছিল। সুতরাং বই ধারের চিন্তা বাদ দিয়ে সরাসরি বই চুরিতে মনোনিবেশ করলাম। চুরি বিদ্যা মহাবিদ্যা। মহাবিদ্যাই মনোযোগ দিলাম। মাঝারী সাইজের একটি বই চুরি করলাম। দু চার লাইন পড়ে বুঝলাম। এটা অখাদ্য। পাথর চিবুলে রস বেরুবে। এই বইয়ে কিছু বেরুবে না। বইয়ের নাম ছিল- ‘সমকালের চোখে হুমায়ূন আহমেদ’।
 
কৃপণ হিসেবে সেই বয়সে ব্যাপক নাম ডাক আমার হয়েছিল। পাথর চেপে রস বের করি। এই বইতো নস্যি। বই চিপে রস উদ্ধার করতে গিয়ে পুরো রসের ভাণ্ডার হাতে পেলাম। হুমায়ূন আহমেদ নামক রসের কারিগর নিয়ে বিভিন্ন গুনীজনের লেখা নিয়েই এই সংকলন। অসাধারন এই মানুষটির সাথে আমার এভাবেই পরিচয়। অতঃপর হুমায়ূন সাহিত্যের প্রেমে পড়েছি। হাবুডুবু খেয়েছি। অথচ যৌবনে এসে তার বাল্যকাল বিষয়ক একটি বই পড়ে জানলাম এই লোকটি নাকি কখনোই প্রেমে পড়েনি। কাউকে ‘ভালোবাসি’ বলেননি।
 
হুমায়ূন আহমেদ তখন ক্লাস ফোরে পড়েন। সেই সময় ‘এক বৃন্তে দুই ফুল’ নামক একটি বই পড়ে জানতে পারেন প্রেম একটি স্বর্গীয়, মহত এবং উঁচুস্তরের ব্যাপার। তিনি তার সদ্যলব্ধ জ্ঞান সঙ্গে সঙ্গে কাজে লাগালেন। পাশের বাসার পরী নামের এক বালিকাকে ঢেকে কাঁঠাল গাছের নিচে নিয়ে গেলেন। ফিস ফিস করে বলল- পরী আমি তোমাকে ভালবাসি। পরী চোখ বড় বড় করে অনেকক্ষণ হুমায়ূন আহমেদের দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা ঝাকিয়ে বলল- তুই অসভ্য।

মেয়েরা পেটে কথা রাখতে পারে না। কাজেই পাঠক পাঠিকারা সহজেই শিশু হুমায়‍ূন আহমেদের অবস্থা অনুমান করতে পারেন। শৈশবের এই ঘটনার কারণেই পরবর্তী জীবনে কোন তরুণীকে- "আমি তোমাকে ভালবাসি" এই কথা তার বলা হয়নি। এর চেয়ে বড় ট্র্যাজেডি একজন যুবকের জীবনে কি হতে পারে।
 
এই ট্র্যাজেডি শুধু হুমায়ূন আহমেদের জীবনেই নয়, অনেকেরই ঘটেছে। একই ট্র্যাজেডিতে পড়ে আমারও আর কাউকে ভালোবাসি বলা হয়নি। আমি কাঁঠাল গাছের নিচে না গিয়ে মক্তবে বসে পবিত্র মনে ভালোবাসার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। বালিকার কানে সেটা না পৌঁছানোর আগে হুজুরের কানে পোঁছে গিয়েছিল। এমন অশ্লীল, কুরুচিকর, অশ্রাব্য শব্দ ব্যবহারের শাস্তি একটাই- বেত্রাঘাত। হুজুর তৎক্ষণাত পিটিয়ে শাস্তি কার্যকর করলেন। পিটুনিতে ক্ষুদ্রকায় প্রেমিকের কৃষ্ণকায় নিতম্ব ক্ষণিকেই লাল হলো। লজ্জায় আমিও লাল হলাম। ছোট বেলায় মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেওয়া লজ্জা এখনো কাজ করছে।
 
এরপর ভালোবাসার নাম মুখেও আনিনি। এই শব্দে অধর্ম হয় ভেবে।
 
‘ভালোবাসা’ শব্দটিকেও ভুলভাবে জ্ঞান করেছি। তাই শুধু রাগ নয়, কাউকে ভালোবাসাটুকুও দেখাতে পারিনি। নারী পুরুষের মধ্যেই শব্দটিকে সীমাবদ্ধ করে রেখেছি। কখনো কেউ জানায়নি, ভালোবাসার সম্পর্ক হতে পারে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে। ভালোবাসা হতে পারে পিতার জন্য পুত্রের। ভাইয়ের জন্য ভাইয়ের। বন্ধুর জন্য আরেক বন্ধুর। আমরা কদাচিৎ এসব সম্পর্কে ভালোবাসি বলে থাকি।
 
আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে ‘ভালবাসি’ শব্দটি অত্যন্ত নোংরা। এটা বলা যাবে না। বিশেষ একজন এবং ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ ছাড়া কাউকে চিৎকার করে বলতে পারিনি- আমি তোমায় ভালোবাসি। কিন্তু অনেককেই ভালোবাসি। ভাই, বোন, বাবা, বন্ধু কাউকেই বলা হয় না। মাকেও না। কখনোই উচ্চ শব্দে ‘ভালোবাসি’ শব্দটি উচ্চারণ করে সরাসরি বলা হয় না- মা আমি তোমাকে ভালোবাসি।

পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয়, আবেগীয় শব্দটিকে সংকীর্ণতায় আবদ্ধ করে রেখেছি আমরা। আজব আমাদের রক্ষণশীলতা!!

লেখক: কবি ও ব্লগার
[email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।