বৃষ্টির ছাটঁ এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে তমালের কম্পিউটার। আমি জানালা খুলে বহুদূরের আকাশ দেখার চেষ্টা করছি।
তমাল আমার স্কুল জীবনের বন্ধু। তারপর কলেজ ইউনিভার্সিটি আর এখন এক অফিসে দুজন কাজ করি। আবেগহীন একজন মানুষ। বৃষ্টি তার দুচোখের বিষ। শ্রাবণ মাস এলেই তমালের মেজাজটা অতিমাত্রায় বিগড়ে যায়। যখন তখন নোটিশ ছাড়া বৃষ্টি,কর্দমাক্ত রাস্তা, ট্রাফিক জ্যাম আর আমার বৃষ্টি বিলাস দেখে।
তমাল আর আমি দুজনেই প্রোগ্রামার। কম্পিউটারের ভাষায় কোড লেখা, রান করা, ভুল সংশোধন করা, আবার রান করা এক একঘেয়ে জীবনের সাথে আমরা সারাদিন বাধাঁ থাকি। তবু আকাশ যখন সিদুরেঁ মেঘে ঢেকে যেতে থাকে, কখনো পাহাড় কখনো রবীন্দ্রনাথ কখনো জীবনানন্দের মত চেহারা নিয়ে মেঘগুলি ধাধাঁয় ফেলে, তারপর বৃষ্টি হয়ে ঝমঝম শব্দে ভেঙ্গে পড়ে এই নগরীতে, আমি তখন তমালের কম্পিউটারের পাশে রুমের একমাত্র জানালাটি খুলে দেই। হাত বাড়িয়ে জলের ছোয়াঁয় নিজেকে শুদ্ধ করি। তমাল অবশ্য এসব কাব্যিক ব্যাপার বুঝেনা। আপন মনে কাজ করে আর মাঝে মাঝে বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকায়। একই রুমে আমরা কাজ করি।
কিছুদিন পরে আমার বিয়ে সুইডেন প্রবাসী এক ইঞ্জিনিয়ারের সাথে । সুইডেন সনি এরিকসনে সে আমার বড় ভাইয়ের সাথে কাজ করে। শুনেছি সুইডেনের আবহাওয়া খুব খারাপ । সারাদিন মেঘলা আকাশ আর ঠান্ডা থাকে। বরফের রাজত্বে অপ্রয়োজনে কেউ ঘর থেকে বের হয়না। এসব ভেবে সারাদিন একটু মনমরা হয়ে থাকি। তমাল এসব অনুভূতি বুঝেনা। সে ঠিকই আমার কাছ থেকে কাজ আদায় করে নেয় ।
সেদিন সকাল থেকেই বৃষ্টি পড়ছে। আমি বারান্দায় বসে বসে বৃষ্টি দেখছি। বৃষ্টির ছাটঁ আমাকে খানিকটা ভিজিয়ে দিচ্ছে, মা এসে ঘরে যাবার তাড়া দিয়ে গেছে কয়েকবার। কেন জানি আমার কিছুই ভাল লাগছেনা। অফিস থেকে চিরতরে বিদায় নিয়ে এসেছি কিছুদিন আগে। আর মাত্র কদিন পরেই আমাকে মন্ত্র পড়ে অপরিচিত একজনের হাত ধরে চলে যেতে হবে এমন এক দেশে যেখানে আমাদের মত বৃষ্টি নেই। বৃষ্টিতে ভেজার কেউ নেই। আর আমার বৃষ্টি বিলাস দেখে বিরক্ত হবার কেউ নেই। এই বৃষ্টি , ভবিষ্যতের শিকড়হীন জীবন, সামনের অনন্ত সময় সব কিছু আজ অর্থহীন লাগছে।
দুদিন ধরে তমালকে পাচ্ছিনা। অনেক বার ফোন করেও বন্ধ পাচ্ছি মোবাইল। অফিসে ফোন করে জানলাম সে দুদিন ধরে অফিসে আসছেনা।
হঠাৎ আমার চার বছরের ভাগনী আমার কাছে আসে। কোলে বসে স্বভাবসূলক অনেক অবান্তর কথার সাথে প্রশ্ন করে “খালামণি, তুমি কি তমাল আংকেলের সাথে রাগ করেছো ? তাহলে সে আমাদের বাসায় আসছেনা কেন? রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে কেন? আম্মু বলেছে বৃষ্টিতে ভিজলে অসুখ হয়। সত্যি খালামণি হয় ? ” সে হাত দিয়ে দূরে কদম গাছের নিচে দাঁড়ানো তমাল কে দেখিয়ে দিল।
চমকে উঠলাম টুনটুনের কথা শুনে। তাই তো তমালই দাঁড়িয়ে ভিজছে। আমি আনমনা ছিলাম তাই খেয়াল করিনি এতক্ষন।
দৌড়ে গেলাম ছাতা ছাড়াই। তমাল কেমন যেন বিচলিত।
আমার দিকে তাকিয়ে বলে ফেলল “ মেঘনা, আমি তোকে ছাড়া একা হয়ে গেছিরে !তুই চলে আসার পর কেমন যেন সব কিছু খালি খালি লাগছে । আমি আর কখনো তোর উপর বিরক্ত হবনা । তুই যত ইচ্ছে বৃষ্টিতে ভিজিস । আমি তোকে কিছু বলবনা। এমন কি আমার কম্পিউটার ভিজিয়ে ফেললেও না। তবু তুই চলে যাসনে ! “
বৃষ্টির জল তমালের চোখের পানি মুছে দিচ্ছে। শ্রাবন মাসের দুপুরে ভিজছে আমার বৃষ্টি বিলাসী মন। ভিজছে বৃষ্টি বিরাগী তমাল। ভিজছে একজন মেঘলা মানুষ।