বল কি তোমার ক্ষতি
জীবনের অথৈ নদী
পার হয় তোমাকে ধরে
দুর্বল মানুষ যদি...
অটিস্টিক মানুষেরা দুর্বল নয়, আমাদের সবার মাঝে বাস করেও ওরা যেন অন্য কোনো ভুবনে হারিয়ে যাওয়া মানুষ। ওরা ওদের সেই ভুবন থেকে সহজে বের হতে চায় না- বাইরের জগত অর্থাৎ আমাদের তথাকথিত সুস্থ মানুষদের জগতের সুখ-দুঃখ, আচার-আচরণ, নিয়ম-কানুন, সভ্যতা-অসভ্যতা নিয়ে ওদের কোনো মাথা ব্যথা নেই।
অটিজম নিয়ে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় যাব না- অটিজম কী, কেন হয়, এর প্রতিকার কী, কত ধরনের চিকিৎসা আছে, এ নিয়ে যথেষ্ট পড়াশুনা, সেমিনার, বক্তৃতা, লেকচার, ইন্টারনেট ব্রাউজ করেছি। আমরা যারা অটিস্টিক শিশুদের বাবা-মা তারা বাধ্য হয়েই জেনেছি অটিজমের অ আ ক খ।
আমার আর আমার স্ত্রীর এখন শুধু একটাই লক্ষ্য- কীভাবে আমাদের মেয়ে আরাধিতার সেই ভুবন আর আমাদের এই ভুবনের মধ্যে একটা সেতু তৈরি করা যায়, যার মাধ্যমে বেশিরভাগ সময় ওকে আমাদের এই ভুবনে ধরে রাখতে পারবো। এর জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছি, অনুসরণ করছি বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, প্রতিদিন-প্রতিক্ষণ।
আরাধিতা তার এই ভুবনে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া আরম্ভ করেছে মাত্র ২০ মাস বয়সে। তার আগে সে আর ১০টা শিশুর মতই আচরণ করেছে- বাবা মাকে ডেকেছে, টা টা দিয়েছে, সবার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকেছে, কিন্তু তারপর প্রকৃতির কী অভিমান জানিনা বা কোন সে অজানা বৈজ্ঞানিক কারণে আমাদের আরাধিতা ডুবে গেল সেই রহস্যময় ভুবনে- বন্ধ করে দিল একে একে সব দরজা।
প্রথমে খুব কষ্ট পেয়েছি। কিন্তু দেখলাম সব কিছু সহজ হয়ে গেল যখন এই সত্যটাকে স্বতঃস্ফুর্তভাবে মেনে নিলাম আর দৃঢ় সংকল্প করলাম- আমাদের আরাধিতাকে হারিয়ে যেতে দেব না।
অটিস্টিক মানুষেরা কী সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যেতে পারে? পারে না- দয়া করে এই শব্দটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। ওরা স্বাভাবিক হবে কি হবে না সেটা নির্ভর করে আমাদের ওপর। কতটা শ্রম দিচ্ছেন সন্তানটির জন্য তার ওপর।
অতএব, ওর ভালো হবার চাবি আমাদের হাতে, ওদের হাতে নয়।
সদ্য যারা জানতে পেরেছেন তাদের সন্তান অটিস্টিক, সেই সব বাবা-মার জন্য কিছু কথা:
সত্যটাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে নিন। দেখবেন ৯৯% এগিয়ে গিয়েছে। বাকি ১% নিরলস শ্রম আর আগ্রহ।
অটিজম কেন হয় বৈজ্ঞানিকরা আজ পর্যন্ত কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পায়নি। তাই স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে দোষারোপ করা থেকে বিরত থাকুন।
সন্তানকে কোয়ালিটি সময় দিন। যতটুকু সময় দিন না কেন, তাকে লক্ষ্য করুন এবং তার সঙ্গে ইন্টারঅ্যাক্ট করুন।
অন্য স্বাভাবিক বাচ্চাদের সঙ্গে আপনাদের সন্তানের তুলনা করা থেকে বিরত থাকুন। অনবরত এই কাজটি করলে আপনি মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বেন।
আপনার অটিস্টিক সন্তানটিকে সব সময় সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে নিয়ে যাবেন- কখনোই ঘরে আবদ্ধ রাখবেন না ।
খুব অল্প সময়ে আশাব্যাঞ্জক ফল আশা করবেন না। খুব ধৈর্য্য ধরে ওদের সঙ্গে কাজ করে যান- ফলাফল আসবেই।
প্রতিদিন অটিজম নিয়ে কিছু পড়াশুনা করুন।
নিজেদের জন্য সময় রাখুন। মনে রাখবেন আপনার সন্তানের যত্ন নিতে হলে আপনার নিজের প্রতিও যত্নশীল হতে হবে।
আরাধিতাকে স্কুল ফর গিফ্ট চিলড্রেন নামের একটি বিশেষ স্কুলে দিয়েছি কয়েক বছর হলো। ও এখন অনেক নিয়ন্ত্রিত এবং মারুফা আপা, আরাধিতার সব শিক্ষক, থেরাপিস্ট, বলতে বাঁধা নেই, আমার স্ত্রী ও আমার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আরাধিতা প্রতিদিন উন্নতি করছে।
মানসিক প্রতিবন্ধী শব্দ দুটি আমার পছন্দ নয়। প্রতিবন্ধী শব্দটার আভিধানিক অর্থের ব্যাখ্যায় গেলে দেখা যাবে যে, আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে `প্রতিবন্ধী`। তাই শুধু ওদেরকে `প্রতিবন্ধী` সম্বোধন করাটা অর্থহীন।
ওদের প্রয়োজন শুধু এতটুকু- আমাদের হাত ধরেই জীবন নদী পার হবে ওরা।