ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

লাইফস্টাইল

চলো আকাশ ছুঁয়ে আসি

হেজলুল ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৪ ঘণ্টা, মার্চ ৩, ২০১২
চলো আকাশ ছুঁয়ে আসি

বাস্তবে যদি পৃথিবীর সর্বোচ্চ উচ্চতায় যাওয়ার সুযোগ থাকে তবে তা কে না নিতে চায়? সেরকম একটি কাজ দূর্গম হিমালয় পর্বতমালার ভেতর পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু সড়ক পথে সাইক্লিং করা।

শুরুটা ছিল হঠাৎ করেই, একদিন ইন্টারনেটে দূর্গম হিমালয় পর্বতমালার ভেতর পৃথিবীর সব চেয়ে উঁচু সড়ক পথে সাইক্লিং করার একটি অদ্ভুত তথ্য নজরে আসে।

এই সড়কটি ভারতের মানালি থেকে ভারত নিয়ত্রিত কাশ্মিমের লাদাক অঞ্চল, অত:পর লাদাক থেকে খারদুং লা। সংক্ষেপে আফগানিস্তান ও তিব্বতের দক্ষিণ-পশ্চিমে হিমালয়ের মাঝে। এখানে সাইক্লিং করার সুযোগটি আসালেই উত্তেজনাপূর্ণ।

Md_Hazlul_Islam

পরবর্তী দিন, ব্যক্তিগত খরচে, আমার এই সাইক্লিং করার সিদ্ধান্তটির ঘোষণাটি, অফিস সহকর্মী ও বন্ধুমহলে অত্যন্ত হাসির একটি কারণ হয়ে দাড়ায়। এক অর্থে তারা ভুল কিছুই করেনি, এটা কোন ছেলে খেলা নয়। ৬০০কি:মি: পথের সাথে ৩০০কি:মি: সমান উঁচু পাহাড়ি পথে সাইক্লিং করার জন্য শারিরীক ভাবে যথেষ্ট সামর্থ থাকতে হবে অবশ্যই। শুধু তাই নয়, বৈরি আবহাওয়ার সাথে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৭০০০ ফিটেরও অধিক উচ্চতায় অক্সিজেনও কম থাকে স্বাভাবিক শ্বাস-প্রস্বাসের জন্য।

অত:পর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ন যে বিষয়টি শেখার ছিল তা হল, মানসিক ভাবে এ কাজের প্রস্তুতি নেয়া, যেখানে হিমালয় এক জনবসতিহীন স্থান, আর রয়েছে খাবার ও খাবার পানির অপ্রতুলতা।

Md_Hazlul_Islam

সব কঠিন কাজের প্রথম যে কাজটি করতে হয় তা হল একটি দামি ও উন্নতমানের পাহাড়ে চালনোর উপযোগী সাইকেল যোগাড় করা ও পর্যাপ্ত অর্থ। এখন আমার আছে একটি ভাল সাইকেল ও একটি স্বপ্ন, উঁচু নিচু হিমালয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু সড়ক  পথে সাইক্লিং করা।

মানসিক এবং আর্থিক প্রস্তুতির পর আমি পথের একটি প্রাথমিক পরিকল্পনা করে নেই। তা ছিল এমন:

দিন ০১: মানালি থেকে মাড়ি

দিন ০২: মাড়ি থেকে শিশু

দিন ০৩: শিশু থেকে পাতসিও

দিন ০৪: পাতসিও থেকে সারচু

দিন ০৫: সরচু থেকে পাং

দিন ০৬: পাং থেকে লাতো

দিন ০৭: লাতো থেকে লেহ্

দিন ০৮: লেহ থেকে খারদুং লা।

 

 

Md_Hazlul_Islam

অফিস সহকর্মী ও বন্ধুমহল থেকে শুনতে হয় আমি পাগল এবং একাজটি সম্পূর্ণ করা আমার পক্ষে অসম্ভব। আবার কেউ কেউ বলে এটি আত্মহত্যা ছাড়া কিছুই নয়। একটি মজার প্রশ্ন ছিল যেখানে বিমানে যাওয়া সম্ভব সেখানে কেন সাইকেল? সত্যি, যদি তা আমার জানা থাকত, কেন.... শুধু জানা ছিল পরবর্তী ১০টি দিন খুবই কষ্টকর যাবে, যা সাধারন জীবনযাত্রা থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম।

যেহেতু দীর্ঘদিন সন্ধান চালোনোর পর দ্বিতীয় একজন সামর্থবান সাইকিলিস্ট পাওয়া যায়নি, অগত্যা একাই যাত্রা শুরুর করতে হয় পৃথিবীর সেই অজানা পথে।   আনুসঙ্গিক পোশাক, মেরামত করার যন্ত্রপাতি ও সাইকেল নিয়ে ২০১১ সালের আগষ্ট মাসের ২০ তারিখ যাত্রা করি প্রথমে বিমানে করে দিল্লি। পরবর্তীতে দিল্লি থেকে বাসে করে ১২ ঘন্টার যাত্রা শেষে মানালি। মানালি, যেখান থেকে যাত্রা শুরু এই উত্তেজনাপূর্ণ অভিযান।

 

Md_Hazlul_Islam

দিন ০১: মানালি থেকে মাড়ি

প্রথম দিন হিসেবে দিনটি ছিল যথেষ্ট উত্তেজনাপূর্ণ, দেশ থেকে বহু দূরে একা আমি হিমালয় এর মত জনশূণ্য পাহাড়ে সাইক্লিং করছি। একটি স্বপ্ন পূরণের আশায় এগিয়ে যাই সামনের দিকে।

পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী, সকালবেলা মানালি পৌঁছানো মাত্র চলতে শুরু করি বহুল প্রতিক্ষিত মানালি-লাদাক সড়ক পথে। জায়গাটি হিমালয়ে হওয়াতে শুরু থেকেই উচ্চতার দিকে সাইক্লিং শুরু করতে হয়। যতই উঁচুতে যাচ্ছি ততই ঠান্ডা বাড়ছিল।

Md_Hazlul_Islam

শুরুতেই যে পাহাড়টিতে  সাইক্লিং শুরু করি তার নাম হল রোথাং। ধীরে ধীরে পলচান নামক জায়গা পার হয়ে রোথাং এর সোলান উপত্যকার মাঝদিয়ে গুলাবা নামক স্থানে পৌঁছি যা মানালি থেকে ২৫কি:মি দূরে। এখানে হালকা খাবার খেয়ে আবার যাত্রা শুরু হয় মাড়ির দিকে।   রোথাং নামের সবুজ পাহাড়টি পযর্টকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। রোথাং এর গায়ে আছড়ে পরা মেঘ ভেদ করে, ঠান্ডা আবহাওয়ার ভেতর দিয়ে চলে যাই মাড়ি।

Md_Hazlul_Islam

এ জায়গায় কোন বসতি চোখে পড়বে না কিছু তাবু ছাড়া। তাবুগুলো মূলত পর্যটকদের থাকার জন্য ব্যাবহৃত হয়। মাড়ি পৌঁছাতে প্রায় সন্ধে হয়ে যায়, তাই সিদ্ধান্ত নেই এখানেই আমার প্রথম দিনের যাত্রাবিরতি এবং রাতের খাবার জলদি শেষ করেই ঢুকে যাই নিজের তাবুতে। যেহেতু পাহাড়ে খুব দ্রুত রাত নামে এবং প্রথম দিনে যথেষ্ট পরিশ্রমের পর, নির্জন পাহাড়ে তাবুই ছিল আমার সোনার প্রাসাদ রাত কাটানোর জন্য। এভাবেই তাবুতেই রাত কাটতে হবে প্রতি রাতে, যার আর কোন বিকল্প নেই পরবর্তী দিনগুলোতে।

 

Md_Hazlul_Islam

দিন ০২: মাড়ি থেকে শিশু

দ্বিতীয় দিনটি শুরু হয় ৭0সে: তাপমাত্রার ঠান্ডায় সাইক্লিং করে। একটি তাবুর দোকানে নুডলস দিয়ে সকালের নাস্তা শেষে চা পান করে শরীর গরম করে আবার শুরু হয় সাইক্লিং রোথাং এর চুড়ার দিকে। প্রথমে বেশ খানিকটা পথ ভালই ছিল কিন্তু কিছুক্ষণ পরই শুরু হয় ভাংগা পথ। মাটি ও পাথরের টুকরার ওপর দিয়ে যেতে হয় প্রায় ১৮কি:মি: ওপরের দিকে। সম্পূর্ণ যাত্রার মধ্যে এটিই ছিল সবচেয়ে খারাপ পথ কারণ বৃষ্টির জন্য ভূমি ধ্বসের কারণে কোথাও কোথাও রাস্তার বিন্দুমাত্র চিহ্নও ছিল না। অবশেষে ১৩১০০ ফিট উচ্চতায় রোথাং পাহাড়ের চুড়ায় উঠতে পারি। ১৬ কি:মি: পথ পাড়ি দিয়ে মাত্র ২২০০ফিট উচ্চতা অতিক্রম করতে সক্ষম হই। যায়গাটি ভ্রমন পিয়াসীদের জন্য একটি অনন্য স্থান। চুড়ায় পৌঁছানোর পর আবার শুরু হয় নিচের দিকে নামা। রাস্তার এতটাই বাজে অবস্থা যে বলে বোঝাবার মত নয়। একটু পিছলে  গেলেই হাজার ফিট নিচে পড়ে যাবার আশংকা। ধীরে ধীরে নামতে নামতে হয় খোকসার নামক স্থানে। এখানে একটি বাধ্যতামূলক বিরতি নিতে হয় কারন প্রথম বারের মত একটি পুলিশ ফাঁড়ি দেখতে পাই। এখানে সবাইকে পাসপোর্ট বা পরিচয় পত্র লিপিবদ্ধ করতে হয়।

Md_Hazlul_Islam

বলে রাখা ভাল, অভিযানের এই পথটি সাধারন পর্যটকদের জন্য গত ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল। এ পথটি মূলত ইন্ডিয়ান সামরিক বাহিনীর প্রযোজনে ব্যবহৃত হয়। যার জন্য মাঝে মাঝে পুলিশ বা সামরিক বাহিনির চেক পোষ্টে লিপিবদ্ধ করে সামনে যেতে হয় এখনও।

একজন পুলিশ অফিসার প্রথম বাংলাদেশী সাইকেল পর্যটক বলে আমাকে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রন জানায়। তার সাথে দুপুরের খাবার শেষে আবার বেড়িয়ে পড়ি পাহাড়ি পথে। এখান থেকে রাস্তাটি যথেষ্ট ভাল বিধায় কোন রকম ঝামেলা ছাড়াই বয়ে চলা বাঘা নাদীর পাশ দিয়ে চলে যাই শিশু।

Md_Hazlul_Islam

শিশুতে এক পাহাড়ির বাড়ির সামনে একটু ভাল যায়গা দেখে তার অনুমতি নিয়ে আমার তাবু ফেলি। যখন আমি আমার তাবু ফেলতে ব্যস্ত, তখন হঠাৎ সেই পাহাড়ি তার বাড়ির ভেতর থাকার আমন্ত্রন জানায়। শুধু এখানেই শেষ নয়, সে তার বাড়িতে গরম পানি, দুধ এমনকি গরম বিছানারও ব্যবস্থা করে। রাতের খাবারও তাদের সঙ্গে শেষ করে, কিছুক্ষণ আমার ভ্রমণ কাহিনী নিয়ে তাদের সঙ্গে গল্প করি। গল্প শেষে তাদের কাছ থেকে অগ্রিম বিদায় নিয়ে বিছানায় চলে যাই যেহেতু খুব ভোরে তাদের ঘুম ভাঙ্গার আগেই আমি বেড়িয়ে পড়ব লাদাকের পথে।

Md_Hazlul_Islam



দিন ০৩: শিশু থেকে পাতসিও:

যাত্রার তৃতীয় দিনে খুব ভোরবেলা ৫টা বাজতেই বেরিয়ে যাই সাইকেল নিয়ে।   জিনজিনবার পর্যন্ত রাস্তা কিছুটা উঁচু হলেও গনডালা পর্যন্ত রাস্তা ছিল খুবই উঁচু। এখান থেকে হিমালয়ের এক অদ্ভূত সৌন্দর্য চোখে পড়ে। সূর্যের আলো যখন দূর পাহাড়ের চূড়ায় পড়ে, তখন মনে হয় যেন কেউ পাহাড়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে কিংবা স্বর্ণ দিয়ে পাহাড়কে মুড়িয়ে রেখেছে, আর খুবই নিচে দিয়ে বয়ে চলা সেই বাঘা নদী, সে এক অপূর্ব দৃশ্য।

Md_Hazlul_Islam

এভাবে চলতে চলতে পৌঁছে যাই তানডি, যেখানে দেখা মেলে বিপরীত দিক থেকে আসা আরো দুই সাইকেল আরোহীর সঙ্গে। তাদের একজন জার্মান ও অপর জন স্পেনিশ। তাদের মতে এ পথে একা যাওয়া ঠিক নয়। কিন্তু কি আর করা? তাদের অভিনন্দন জানিয়ে বিদায় নিয়ে চলতে থাকি কেলং এর পথে। পথে বরফ গলা পানির ঝরনা থেকে পানির তেষ্টা মেটাই। এই ঝরনা গুলোই ছিল আমার জীবন রক্ষার একমাত্র পানির উৎস।

Md_Hazlul_Islam

কেলং থেকে ইসতিংরি পর্যন্ত কিছুটা নিচু পথ হলেও ইসতিংরি থেকে জিপসা ছিল ৮০০ফিট উঁচু পাথুরে পথ, মাঝে ৪০০ ফিটের কিছুটা ঢালু পথও ছিল। এই পথটি ছিল কিছুটা বিপদজনক কারন একটু অন্যমনষ্ক বা নিয়ন্ত্রন হারালে মুহূর্তের মাঝেই পড়ে যেতে হবে ১০০০ফিটেরও বেশি নিচু খাদে। এভাবেই উঁচু পথ ধরে পৌছে যাই বারালাছা লা পাহাড়ের পাদদেশে এবং সেখান থেকে মাত্র ১০ কি:মি: দূরে দারচা পুলিশ ফাঁড়িতে।

Md_Hazlul_Islam

দারচা পুলিশ ফাড়িতে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে আবারও শুরু করি বারালাছা লা পাহাড়ে ওঠা। প্রায় ১০ কি:মি: ওঠার পরই সন্ধে হয়ে আসতে শুরু করে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই রাত। পাহাড়ে খুব অল্প সময়েই রাত হয়ে যায় কারন সূর্য পাহাড়ের আড়াল হলেই অন্ধকার। সুতরাং পাতসিও নামক এই স্থানেই তাবু ফেলতে হয় এই দিনের জন্য। অপ্রত্যাশিত ভাবে কিছুটা দূরে আরো দুটি তাবু নজরে আসে, কিন্তু  রাত  হওয়াতে জানা সম্ভব হয়নি কারা ছিল সেই তাবুতে। সঙ্গে থাকা শুকনো রুটি আর ঝরনার পানি খেয়ে ঢুকে পড়ি স্লিপিং ব্যাগ এর ভিতর সে দিনের জন্য।

চলবে...

Md_Hazlul_Islam

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।