সময়ের স্রোতে পাল তুলে স্বাদে গুণেমানে সমৃদ্ধ সেই মন্ডা কদর আজও ধরে রেখেছে। দেশজুড়ে এমন মানুষ হয়ত কমই আছেন যে মুক্তাগাছার মন্ডার স্বাদ চেখে দেখেননি।
মন্ডার স্বাপ্নিক গোপাল পালের এ মন্ডা দেশের সীমানা পেরিয়ে ভোজন রসিকদের হাত ধরে এখন যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে। কিংবদন্তি এ মন্ডার সঙ্গে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা ইতিহাসের নীরব স্বাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে।
ময়মনসিংহ জেলা শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার পশ্চিমে মুক্তাগাছা পৌরসভা শহরে গোপাল চন্দ্র পালের মন্ডার দোকান। এ মন্ডার ইতিহাস দু’শ বছরের পুরনো। ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখে গোপাল পাল মন্ডা তৈরি করেছিলেন। সেই সময়ের জমিদারদের খুবই পছন্দের মিষ্টান্ন ছিল এ মন্ডা। তাদের হাত ধরে ক্রমশ উপমহাদেশের সবখানে ছড়িয়ে পড়ে এ মন্ডার সু-খ্যাতি। বিখ্যাত মহামানব ও মনিষীরা মুক্তাগাছার মন্ডা খেয়েছেন।
মুক্তাগাছার মন্ডা আসলে এক প্রকার সন্দেশ। দুধের ছানা ও চিনি দিয়ে এটি তৈরি করা হয়। মন্ডার ‘পাকের’ বৈশিষ্ট্য যারা তৈরি করেন কেবল সেই কারিগররাই জানেন। ২’শ বছর আগে মন্ডার স্বাপ্নিক রাম গোপাল পাল ওরফে গোপাল পাল মন্ডা প্রস্তুত করেন জমিদার পরিবারকে তুষ্ট করার জন্য। সেই সময়ের মুক্তাগাছার জমিদার সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীকে মন্ডা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। মহারাজা এ মিষ্টান্ন খেয়ে প্রশংসা করেন।
এ মন্ডা খেয়ে রাজা-জমিদাররা নানাভাবে গোপাল পালকে প্রশংসিত ও পুরস্কৃত করেন। গোপাল পালের দোকানের বর্তমান মালিক ৫ম বংশধর রমেন্দ্র পাল। তিনি জানান, এর পেছনে রয়েছে অলৌকিক ঘটনা। মন্ডার স্বাপ্নিক গোপাল পাল খুবই ঈশ্বর ভক্ত ছিলেন। পর পর কয়েক রাতে স্বপ্নে এক সন্যাসী তাকে মন্ডা তৈরির পদ্ধতি শেখান। সেই সন্যাসী তাকে বলেন, ‘কাল থেকে তুই মন্ডা বানানো শুরু কর’।
সন্নাসীর নির্দেশে মন্ডা তৈরি শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে দেখলেন স্বপ্নে দেখা সেই সন্নাসী স্ব-শরীরে উপস্থিত হয়ে মন্ডা তৈরি উনুনে হাত বুলাচ্ছেন। তখন সন্নাসীকে ভক্তি করার সঙ্গে সঙ্গে গোপালের মাথায় হাত রেখে বলেন, তোর হাতের মন্ডা মিঠাই একদিন জগৎ বিখ্যাত হবে। এ আশীর্বাদ করে সন্নাসী অদৃশ্য হয়ে যায়
জানা গেছে, ১৭৯৯ সালে জন্ম গ্রহণ করেন গোপাল চন্দ্র পাল। মারা গেছেন ১৯০৭ সালে। পৃথিবীর আলো-বাতাসে ছিলেন ১০৮ বছর। নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর পালিয়ে তিনি মুর্শিদাবাদ থেকে রাজশাহী আসেন। এরপর চলে আসেন মুক্তাগাছার তারাটি গ্রামে। গোপাল পালের মৃত্যুর পর তার পুত্র রাধানাথ পাল, রাধানাথের পুত্র কেদার নাথ পাল, কেদার নাথের পুত্র দ্বারিকনাথ পাল এবং বর্তমানে দ্বারিকনাথের পুত্র রমেন্দ্র নাথ পাল এন্ড ব্রাদার্স মন্ডা তৈরি করে বিক্রি করছেন।
আরও জানা গেছে, মুক্তাগাছার জমিদার জীবেন্দ্র কিশোর আচার্য চৌধুরী রচিত ‘আমি’ বইটিতে মন্ডার উচ্ছসিত প্রশংসা করেন। তিনি কেদারনাথ পালকে প্রশংসা পত্রও দিয়েছিলেন। চির ঐতিহ্যের ধারক মুক্তাগাছার মন্ডার স্বাদ নিয়েছেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত সেতার বাদক ও সুর সম্রাট ওস্তাদ আলা উদ্দিন খাঁ, বিখ্যাত চিকিৎসক ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় (পরে পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী), নেতাজী সুবাষ চন্দ্র বসু।
মুক্তাগাছার জমিদার সূর্যকান্ত মহারাজ পুত্র শশিকান্ত আচার্য চৌধুরীরও প্রিয় মিষ্টান্ন ছিল এ মন্ডা। মহারাজ রাশিয়ার নেতা স্টালিনের কাছে এ মন্ডা পাঠিয়েছিলেন। স্টালিন মন্ডা খেয়ে মহারাজার কাছে প্রশংসাপত্র পাঠান। পাকিস্তান আমলে মন্ডা ভক্ত মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী একবার মন্ডা নিয়ে চীনে গিয়েছিলেন। আপ্যায়িত করেছিলেন চীনের নেতা মাও সেতুংকে।
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর থাকাকালীন মন্ডা খেয়ে প্রশংসা করেন। পরে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হন তিনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তাগাছার এক সভায় এসে মন্ডা খেয়ে প্রশংসা করেছিলেন। স্বাধীনতার পর তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশে এলে মুক্তাগাছার মন্ডা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়েছিল তাকে। ব্রিটেনের রানী এলিজাবেথ একবার ঢাকায় এসেছিলেন। তাকে মন্ডা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়েছিল। তিনিও মন্ডা মিষ্টির প্রশংসা করেছিলেন।
মুক্তাগাছা ছাড়া দেশের কোথাও শোরুম নেই। প্রতি কেজি মন্ডা ৩৩০ টাকা কেজি বিক্রি করা হয়। তবুও ময়মনসিংহ শহরে এক শ্রেণীর অসাধু মিষ্টি দোকানের মালিক মুক্তাগাছার মন্ডার নাম দিয়ে দেদারছে মন্ডা বিক্রি করে ক্রেতাসাধারণকে প্রতারিত করছে।
মুক্তাগাছার ঐতিহ্যবাহী মন্ডার প্রতিষ্ঠাতা গোপাল পাল আজ নেই। তিনি রেখে গেছেন স্মৃতিচিহ্নের কীর্তি। মুক্তাগাছার মন্ডার স্বাদ যে একবার নিয়েছেন সেই এখনও গোপাল পালের কথা স্মরণ করেন।