বর্ষায় রিমঝিম বৃষ্টির টাপুর-টুপুর শব্দে ঘরে বসে থাকতে কার না ভালো লাগে? সঙ্গে যদি হয় গরুর মাংস আর ভুনা খিচুরি তহলে তো আর কথাই নেই। কিন্তু যারা ভ্রমণ পিপাসু তাদের আবার অন্য হিসাব।
কাপ্তাই লেকের বুকে ছোট্ট একটি শহর রাঙামাটি। সর্বত্রই রয়েছে নানা বৈচিত্র্যের ভাণ্ডার। আর বর্ষায় আসে রাঙামাটির নতুন যৌবন। তখন ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে প্রকৃতির ময়ুরীখ্যাত রাঙামাটি যেন ময়ুরের এক পেখম। তাই আমরা কজন প্রকৃতিপ্রেমী প্রায় প্রতি বর্ষায়ই ঘুরতে যাই রাঙামাটির উদ্দেশ্যে।
ঢাকা থেকে বাস ছেড়ে সরাসরি থামে রাঙামাটি শহরে। ঢাকা থেকে রাত দশটায় বাস ছাড়লে খুব ভোরেই রাঙামাটি পৌঁছে যায়। যাওয়ার পথে রাঙামাটির কাছাকাছি গাড়ি পাহাড় বেয়ে ছুটে যেতে দেখা যাবে। কখনও ওপরে উঠছে আবার কখনও নামছে নিচে। তখন হয়তো আপনার মনে হবে মাসুদ রানার কোনও কল্পকাহিনীর মধ্যে আছেন। গল্পের খলনায়ককে ধরতে আপনি ছুটে যাচ্ছেন রাঙামাটির অজানা পাহাড়ে। আর সঙ্গে যদি থাকে বেশ কয়েকজন বন্ধু তাহলে তো মনে না হওয়ার কোনও কারণ নেই।
রাঙামাটি ভ্রমণ শুরু করা যেতে পারে শহরের একপ্রান্ত থেকে। প্রথমেই যেতে পারেন উপজাতীয় জাদুঘরে। সেখানে রয়েছে রাঙামাটিসহ পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত নানা আদিবাসিদের ব্যবহৃত বিভিন্ন সময়ের নানা সরঞ্জামাদী, পোশাক, জীবনাচরণ এবং বিভিন্ন ধরনের তথ্য।
তারপর নেমে যান প্রকৃতি দর্শনে। প্রায় ১৭২২ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের কাপ্তাই লেকের স্বচ্ছ পানি আর বাঁকে বাঁকে পাহাড়ের সৌন্দর্য সবাইকে মুগ্ধ করে। তবে এ হ্রদের প্রকৃতির খুব কাছাকাছি যেতে হলে আপনাকে ভাড়া করতে হবে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা। চিন্তা নেই, শহরের রিজার্ভ বাজার ঘাটে পাওয়া যায় কাপ্তাই লেকে ভ্রমণের নানা রকম ইঞ্জিন নৌকা। সারাদিন কাপ্তাই লেকে ভ্রমণের জন্য একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকার ভাড়া পড়বে ১৫০০-২৫০০ টাকা। এছাড়া রাঙামাটি শহর থেকে এখন প্রতিদিন শুভলং ছেড়ে যায় আধুনিক ভ্রমণতরী কেয়ারি কর্ণফুলী। প্রতিদিন সকালে ছেড়ে আবার বিকেলে ফিরে আসে। যাওয়া-আসার ভাড়া জনপ্রতি ২০০ টাকা। তবে কাপ্তাই লেকে ভ্রমণের জন্য নৌকাটি দেখে-শুনে নিন। বর্ষাকাল থাকায় ছাউনি আছে এমন বোট ভাড়া করুন। বোটে লাইফ জ্যাকেট আছে কিনা আগেই জেনে নিন।
বর্ষার মেঘলা আকাশ, টাপুর-টুপুর বৃষ্টি, জলে টৈটুম্বুর কাপ্তাই লেক। এর মধ্যেই কখনও আকাশের ঘনকালো মেঘ ফুঁড়ে সূর্যের হাসি। শ্যালো মেশিনের ভটভট শব্দ ভেদ করে দূর থেকে ভেসে আসে পাহাড়ি পাখির ডাক। উদ্দেশ্য যদি হয় শুভলং ঝর্ণা তবে পথে পাবেন পেদা টিং টিং। মানে পাহাড়ের চূঁড়ায় বাঁশ ও বেতে ঘেরা উপজাতীয় রেস্টুরেন্ট। সেখানে পাবেন নানান ধরনের সুস্বাদু খাবার। এছাড়া রয়েছে টুকটুক ইকো ভিলেজ। কাপ্তাই লেকের একেবারে মাঝে এই ইকো ভিলেজটির সুন্দর সুন্দর কটেজে রাত কাটানোরও ব্যবস্থা আছে। তবে যাওয়ার পথেই আপনাকে খাবারের অর্ডার দিয়ে যেতে হবে। এজন্য অবশ্য আপনার সঙ্গে থাকা নৌকার মাঝিই গাইডের ভূমিকা পালন করবে।
তারপর প্রকৃতির রূপে ঘেরা কিছুটা পথ পাড়ি দিয়ে চলে যাবেন শুভলং বাজার। এখানে আর্মি ক্যাম্পের পাশ থেকে সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ের ওপরে উঠে কাপ্তাই লেকের অপার সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। তবে বানর থেকে সাবধান। তাদের বিরক্ত করা যাবে না একদম। আর সেটা করলে ওরা কিন্তু চড়াও হতে পারে। শুভলংয়ে কিছুটা সময় কাটিয়ে ফিরতি পথের শুরুতেই হাতের ডানে শুভলং ঝর্ণা। শুভলং ঝর্ণা- বর্ষাতে এ যেনো আরও মায়াবী। ঝর্ণার অঝোর ধারা দেখে মন চাইবে অনন্তকাল শুধু তাকিয়ে থাকতে। এটা ভাবতে ভাবতে থেমে গেলে হবে না, চলে যান ঝর্ণার একদম নিচে। দেখবেন ঝর্ণার জলধারা আপনার সব ক্লান্তি ধুঁয়ে নেবে।
তারপর চলে আসেন পেদা টিং টিং-এ। প্রকৃতির পাশে বসে খেয়ে নিন মজার মজার সব খাবার। সেই সঙ্গে উপভোগ করুন আদিবাসী আনন্দ।
রাঙামাটির দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রাজ বনবিহার। এ অঞ্চলের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর তীর্থ স্থান এটি। এখানে আছে একটি প্রার্থনালয়, একটি প্যাগোডা, বনভান্তের (বৌদ্ধ ভিক্ষু) আবাসস্থল ও বনভান্তের ভোজনালয়। প্রতি শুক্রবার ছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে এখানে চলে প্রার্থনা। রাজ বনবিহারে দাঁড়িয়ে উপভোগ করতে পারেন কাপ্তাই লেকের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য।
রাজবনবিহারের পাশেই কাপ্তাই লেকের ছোট্ট একটি দ্বীপজুড়ে রয়েছে চাকমা রাজার রাজবাড়ি। নৌকায় পার হয়ে খুব সহজেই যাওয়া যায় এই রাজবাড়িতে। আঁকা-বাঁকা সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে গাছের ছায়ায় ইট বাঁধানো পথের মাথায় এ সুন্দর বাড়িটি। এখানে আরও রয়েছে চাকমা সার্কেলের প্রশাসনিক দফতর।
রাঙামাটি শহরের একেবারে শেষ প্রান্তে রিজার্ভ বাজার ছাড়িয়ে আরও প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে রয়েছে পর্যটন কমপেস্নক্স। এই কমপেস্নক্সের ভেতরেই রয়েছে রাঙামাটির ঝুলন্ত সেতুটি। সেতু পেরিয়ে সামনের পাহাড়ে উঠলে কাপ্তাই লেকের বড় অংশ দেখা যায়। এখান থেকে কাপ্তাই লেকে নৌ ভ্রমণও করা যায়। তবে এখানে সাম্পানে চড়ে ঝুলন্ত সেতুর আশপাশে ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগবে। ঘণ্টা ১০০ টাকায় এখানে পাওয়া যাবে পাঁচজনের চড়ার উপযোগী সাম্পান।
জেনে রাখুন:
বাংলাদেশের একমাত্র রিকশামুক্ত শহর রাঙামাটি। তাই এই শহরের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে হয় বেবিটেক্সিতে। এক স্টপেজ থেকে আরেক স্টপেজে পৌরসভা নির্ধারিত সর্বনিম্ন ভাড়া হলো ১০ টাকা। এছাড়া রিজার্ভ নিলে শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ভাড়া পরবে ৬০-১০০ টাকা।
রাঙামাটি শহর থেকে কিনতে পারেন আদিবাসীদের পোশাক, তাঁতের কাপড়, আদিবাসীদের তৈরি নানা রকম হস্তশিল্প সামগ্রী ইত্যাদি।
প্রতিদিন রাত দশটায় এবং রাঙামাটি থেকে সকাল সাড়ে দশটায় ছাড়ে। এছাড়া যে কোনো বাস, ট্রেন কিংবা বিমানে চট্টগ্রাম এসে সেখান থেকেও রাঙামাটি যেতে পারেন। চট্টগ্রাম শহরের সিনেমা প্যালেস এবং বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল থেকে সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রতি বিশ মিনিট পরপর রাঙামাটির উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় বিরতিহীন বাস। ভাড়া জনপ্রতি ১০০-১২০ টাকা।
শহরে রয়েছে বেশ কয়েকটি হোটেল। এখন সেখানে পর্যটকদের ভিড় কম থাকায় হোটেলগুলোও পাওয়া যাবে খুব সস্তায়। হোটেলগুলোর মধ্যে রয়েছে পর্যটন কমপ্লেক্সের ভেতরে পর্যটন মোটেল (এসি দু’বেড ১৭২৫ টাকা ও নন-এসি দু’বেড ভাড়া ৮০৫ টাকা); শহরের কাঁঠাল তলীতে হোটেল সুফিয়া (এসি এক বেড ৯০০ টাকা, এসি দু’বেড ১২৫০ টাকা ও নন-এসি দু’বেড ৮০০ টাকা); রিজার্ভ বাজারে হোটেল গ্রিন ক্যাসেল (এসি ১১৫০-১৬০০ টাকা, নন-এসি ৭৫০-১৫০০ টাকা); কলেজগেট এলাকায় মোটেল জজ (এসি ৯০০-১১০০ টাকা, নন-এসি ৩৫০-৭০০টাকা); নতুন বাস স্টেশনে হোটেল আল-মোবা (এসি ১২০০ টাকা, নন-এসি ৩০০-৫০০ টাকা); পর্যটন রোডে হোটেল মাউন্টেন ভিউ (এসি ১২০০ টাকা ও নন-এসি ২০০-১২০০ টাকা।
ঢাকার থেকে কলাবাগান, ফকিরাপুল ও কমলাপুর থেকে সরাসরি রাঙামাটির উদ্দেশে ছেড়ে যায় ডলফিন পরিবহন, এস আলম, সৌদিয়া পরিবহন, শ্যামলী পরিবহন, ইউনিক সার্ভিস, হানিফ পরিবহন ইত্যাদি। ভাড়া জনপ্রতি ৪০০-৪৫০ টাকা।
এই বর্ষায় দুদিনের সময় বের করে ঘুরে আসুন রাঙামাটি।