বিশ্ব দরবারে স্বতন্ত্র মহিমায় সমুজ্জল অভিজাত তাঁতবস্ত্র এ জামদানি। এ শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে এ দেশের সংস্কৃতি ও কৃষ্টি।
জামদানি নিয়ে উচ্চারিত হয়েছে চিরঞ্জীব পংক্তিমালা। যেখানে বন্ধুকে হাট থেকে তার প্রিয়তমা রমনী ঢাকাই জামদানি শাড়ি এনে দিতে বলছে।
তবুও ঈদকে সামনে রেখে জামদানি পল্লীতে চলছে কর্মব্যস্ততা। নাওয়া-খাওয়া ভুলে জামদানি শিল্পীরা এখন কাপড় বুনে যাচ্ছে। এবারের ঈদে তাদের চাহিদা অনেক। এবারের ঈদে প্রায় ৩০ কোটি টাকার জামদানি দেশের বিভিন্ন বিপনী বিতান ও বিদেশ যাবে বলে জামদানি তাঁতিরা জানান।
ফুলতেরছি, ছিটার তেরছি, ছিটার জাল, সুই জাল, হাটু ভাঙ্গা, তেরছি, ডালম তেরছি, পার্টিরজাল, পান তেরছি, গোলাপ ফুল, জুই ফুল, পোনা ফুল, শাপলা ফুল, গুটি ফুল, মদন পাইরসহ প্রায় শতাধীক নামের জামদানি রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ছিটার জাল, সুই জাল ও পার্টিও জাল জামদানির মূল্য সবচেয়ে বেশি। এসব জামদানি শাড়ির দাম পড়ে ৩০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত। আর শাড়ি বুনতে সময় লাগে প্রায় ৩ থেকে ৬ মাস।
জামদানির ঐতিহ্য
শখ বুঝি এমনই। নতুবা আজ থেকে ২০০বছর আগে জেমস টেলর কেন রাজধানী ছেড়ে ছুটে আসবেন প্রাচীন নগরী রূপগঞ্জে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় সাদা কাপড়ের ওপর ফুলের ডিজাইন করা ৫০ হাজার টাকার মূল্যের জামদানি ভারত, নেপাল, এলাকার নবাব ও বাদশাহরা ব্যবহার করতেন। কেন্ট স্টেট ইউনিভার্সিটি মিউজিয়ামে রক্ষিত মোঘল স্টাইলের আংরাখায় সূক্ষ্ন জামদানি জমিনে ২২ ক্যারট সোনার জরির কাজ। আনুমানিক ১৮৭৫-১৯০০ সালে তৈরি।
জামদানি তাঁত ও তাঁতী পরিবারের সংখ্যা
জামদানি শিল্পীদের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। ১৯৭৫ সালে এখানে প্রায় ১লাখ ৩০ হাজার জামদানি তাঁতী ছিল। অথচ বর্তমানে মাত্র দেড় হাজার পরিবার এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত।
জামদানি শিল্পীদের কথা
বাদশাই আমলে পরতেন রাজা-বাদশাহরা কিংবা জমিদার পরিবারের নারীরা। আর এখন পরেন ধনী ও অভিজাত রমনীরা। জামদানির গরীব গরবিনী এ রমনীরা অনেকেই জানেন না তাদের পরিধেয় সেই শাড়িটির ভাঁজে-ভাঁজে রয়েছে কত দুঃখ, বেদনা আর বঞ্চনার ইতিহাস। ইংরেজ আমলে আঙ্গুল কেটে দেয়া থেকে শুরু হাল আমলে লুন্ঠনের পরও ঢাকাই এ জামদানি শিল্প বহু কষ্টে টিকে আছে। এক একটা শাড়ির পেছনে লুকিয়ে রয়েছে এক একজন তাঁতীর জীবন্ত ইতিহাস।
প্রতিটি সুতার ফাঁকে-ফাঁকে রয়েছে তাদের ঘাম, কষ্ট, বেদনার কাহিনী। এই অসহায়-অশিক্ষিত দরিদ্র তাঁতীদের জীবনের কথা লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায়। যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে শাড়িগুলো তৈরি করেন তাদের মা-বোন-বউদের ভাগ্যে এক চিলতে সস্তা শাড়িও জোটে না। তারা দিনের পর দিন স্বপ্ন দেখে এই তাঁত শিল্প একদিন সমৃদ্ধ হবে। তাদের নিত্যদিনের অভাব অনটন দূর হবে। সুখী জীবনের প্রত্যাশার প্রহর আর শেষ হয়না তাদের। স্বপ্ন আর বাস্তবের মাঝে বিরাট ফাঁরাক, এদের স্বপ্ন যেন স্বপ্নই থেকে যাবে। স্বপ্ন মরার যন্ত্রনায় তাঁতীরা আজ দিশেহারা। কথা হয় জামদানি তাঁতি নুরুল আমিন,রুবেল বিশ্বাস ও আতিকুর রহমানের সঙ্গে। তারা বলেন, ভাই বংশের ঐতিয্য টিকিয়ে রাখতে এ পেশায় রয়েছি। প্রতি মাসে অল্প মুল্যেও ৩/৪টি শাড়ি বুনতে পারি। আর এ শাড়ি বিক্রির টাকা দিয়েই চলে আমার সংসার।
জামদানি রপ্তানি:
বাংলাদেশ থেকে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলংকা, সৌদি আরব, ব্রিটেনসহ বিভিন্ন দেশে জামদানি শাড়ি রপ্তানি হচ্ছে এ রপ্তানির সঙ্গে জড়িত জামদানি শাড়ির ব্যবসায়ীরা। তাঁতীদের কাছ থেকে তাঁরা শাড়ি কিনে এনে রফতানি করে থাকে। প্রতিবছর প্রায় আড়াইশ কোটি টাকার জামদানি শাড়ি রপ্তানি করা হয়। বাংলাদেশ ছাড়াও ইসলামাবাদ, করাচি, লাহোর ও ইউরোপে বসে প্রতিবছর জামদানি মেলা।
জামদানির আড়ং
জামদানি শাড়ি বিক্রিকে ঘিরে শীতলক্ষ্যার পাশে ডেমরায় ও নোয়াপাড়া জামদানি পল্লীতে গড়ে ওঠেছে জামদানির আড়ং। প্রতি বৃহস্পতিবার প্রথম এবং শেষ রাতে জামদানির হাট বসে।
দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন আসেন জামদানি শাড়ি কিনতে। প্রায় দুই শতাধিক পাইকার বিভিন্ন প্রকার জামদানি ক্রয় করে দেশ-বিদেশে বিক্রি করে আসছে। দুটি হাটে প্রতি মাসে প্রায় ২০ কোটি টাকার জামদানি শাড়ি বেচা-কেনা হয়। ঈদকে সামনে রেখে এ মাসে প্রায় ৩০ কোটি টাকার জামদানি বেচা-কেনা হবে বলে আশা করছেন ব্যবসায়ীরা।
স্বর্ণতুল্য সুতার কারুকাজ সমৃদ্ধ মানসম্পন্ন রপ্তানিযোগ্য জামদানি শাড়ি তৈরির বিপুল সম্ভার নোয়াপাড়ার জামদানি পল্লীকে করে তুলবে অতুলনীয়।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার লাগোয়া রূপগঞ্জের জামদানি পল্লীই হবে একমাত্র প্রতিষ্ঠান যা দেশ-বিদেশের ক্রেতাদের শুভাগমনে হয়ে ওঠবে মুখরিত। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সরকারিভাবে উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ শিল্পকে স্বমহিমায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আরো বিকশিত করতে হবে উৎকর্ষতা, মান ও বৈচিত্র্যে।