মানুষের মুখমণ্ডলকে(face) বলা হয় মনের আয়না। যুগে যুগে এ ধারণাই প্রচলিত হয়ে আসছে।
তবে সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে ভিন্ন কথা। তাদের মতে- মানুষের মনের অভিব্যক্তি মুখের বা চোখের দিকে তাকিয়ে বোঝা সম্ভব নয়। এমনকি জানাও সম্ভব নয়- তিনি আসলে চোর নাকি সাধু। রেগে আছেন নাকি দুশ্চিন্তায় আছেন।
এ বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করে আসছে ইন্টারডিসিপ্লিনারি অ্যাফেকটিভ সাইন্স ল্যাবরেটরি। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক লিসা ফিডম্যান ব্যারেট তাদের সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণার প্রতিবেদনে জানান, মানুষের মুখ মণ্ডলের অভিব্যক্তি সর্বজনীন নয়।
নিউইয়র্ক টাইমসে সম্প্রতি এ সম্পর্কিত একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ‘আপনি কি কারো চেহারার দিকে তাকিয়েই তার মানসিক অবস্থা বলে দিতে পারেন?’
এ প্রবন্ধে ব্যারেট বলেন, মানুষের হয়তবা এমনটাই মনে হয়। মানুষ তার প্রাত্যহিক জীবনে অন্যের মুখের দিকে চেয়েই বুঝে নেয় তার মনের অবস্থা কি। শত শত বিজ্ঞানীর গবেষণা এই বিষয়টিকে স্বীকৃতি দেয়। তারা মনে করেন, মানুষের মুখমণ্ডল একটা আলোক সংকেতের মতো যা তার আবেগ, অনুভূতি, ভয়ভীতি, বেদনা, আনন্দ, রাগ অথবা বিষ্ময়ের মতো বিষয়গুলো পরিষ্কারভাবে ফুটিয়ে তোলে।
এই বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে সম্প্রতি অ্যাপলসহ বিভিন্ন কম্পিউটার কোম্পানি ও বিভিন্ন দেশের সরকারি নিরাপত্তা সংস্থা বিভিন্ন কম্পিউটার প্রোগ্রাম তৈরি করছে যা একজন ব্যক্তির মনোভাব বুঝতে সহায়তা করবে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। একই ধারণা কাজে লাগানো হয় বিভিন্ন মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য। যেমন, অটিজমের মতো রোগে রোগীর মুখমণ্ডলের অভিব্যক্তি কাজে লাগিয়ে চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।
‘আবেগ বোঝা’ সম্পর্কিত শীর্ষস্থানীয় গবেষণা কর্মটি পল একমান নামে একজন গবেষক ১৯৬০ সালে সম্পাদন করেন। গবেষক উত্তরদাতাকে বিভিন্ন অভিব্যক্তিযুক্ত মুখমণ্ডলের ছবি দেখান এবং সরবরাহকৃত কিছু বাক্যের সঙ্গে সেটিকে মেলাতে বলেন। এক্ষেত্রে আশ্চর্য বিষয় ছিলো প্রত্যেক উত্তরদাতাই প্রায় সঠিক ছবি বাঁছাই করতে পেরেছেন। পরবর্তীতে এ বিষয়ে শতশত গবেষক শুধুমাত্র তার এ পদ্ধতির পুনরাবৃত্তি করেছেন।
কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যারেটরা যখন গবেষণা শুরু করলেন, তখন লক্ষ্য করলেন গবেষণার আগের ওই পদ্ধতিটা ছিলো ভুল। তাদের সন্দেহ হলো, আগেই দেওয়া একসেট বাক্য উত্তরদাতাকে সঠিক উত্তর সম্পর্কে আভাস দেয়। এতে বলা যায় গবেষণার ফলাফলই পরিবর্তন হয়ে গেছে।
‘মানুষের মুখ মণ্ডলের অভিব্যপ্তি সর্বজনীন নয়’- এই হাইপোথিসিসকে যাঁচাই করার জন্য তারা কিছু প্রাথমিক গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেন, যা পরে জার্নাল ইমোশনে প্রকাশিত হয়েছে। এক্ষেত্রে নমুনা উত্তরদাতাদের আগেই কোনো আভাস দেওয়া হয়নি বরং মানুষের মুখমণ্ডলের অভিব্যপ্তি সম্পর্কে তাদের আলোচনা করতে বলা হয়। দেখা যায়, উত্তরদাতা অভিব্যপ্তি সনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
এ বিষয়ে আরো গবেষণা করে দেখা যায়, উত্তরদাতা যেন পূর্ব থেকে বিষয়টি সম্পর্কে না জানেন। এক্ষেত্রে দেখা গেলো উত্তরদাতারা মুখমণ্ডলের অভিব্যক্তি সনাক্ত করতে প্রায় চুড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। তাদের এ অবস্থাকে তুলনা করা যায় সিমান্টিক ডিমেনসিয়া আক্রান্ত মানসিক রোগীর সঙ্গে। তারা শুধুমাত্র হ্যাঁ এবং না পার্থক্য করতে পেরেছে, অন্য কোনো অভিব্যক্তি সনাক্ত করতে পারেননি।
এ পর্যায়ে তাদের গবেষণা আরো বিস্তৃত করলেন, যাতে গবেষণা কোনো একটি অঞ্চলের জন্য নির্দিষ্ট না হয়। এ জন্য তারা আফ্রিকার দেশ নামিবিয়ার বিচ্ছিন্ন উপজাতি হিম্বাদের সঙ্গে কাজ শুরু করলেন। উপজাতি অধিবাসীদের ছয় জন অভিনেতার ৩৬টি ছবি সরবরাহ করা হয়। এগুলোতে প্রত্যেক অভিনেতার খুশি, ভীতি, চোখ রাঙ্গানো, বিরক্তিভাব, বিস্মিত হওয়াসহ ছয় ধরনের অভিব্যক্তি ছিলো। যখন উপজাতি উত্তরদাতাদের এসব অনুভূতি আলাদাভাবে সনাক্ত করতে বলা হলো, তারা সব হাসিমুখগুলো একভাগে, বেশিরভাগ বিস্মিত হওয়া ছবিগুলো দ্বিতীয়ভাগে এবং বাকি সবগুলো তৃতীয়ভাগে রাখে।
অনুভূতিগুলো সনাক্ত করতে বলা হলে তারা ‘খুশি’ অথবা ‘ভয়ভীতি’ এসব না উল্লেখ করে ‘হাসি’ এবং ‘তাকানো’র মতো শব্দ ব্যবহার করেন। যদি মুখমণ্ডলের অভিব্যপ্তি সর্বজনীন হতো, এসব উপজাতি ব্যক্তিরাও ছয় ধরনের অভিব্যপ্তি ছয় ভাগে ভাগ করতে পারতেন। কিন্তু তারা পারেন নাই।
এসব গবেষণার ফলাফল থেকে বোঝা যায় মানুষের চেহারার দিকে তাকিয়ে সব সময় তার আবেগ বোঝা সম্ভব নয়। চার্লস ডারউইনের তত্ত্ব - ‘মুখের নড়াচড়া আবেগ প্রকাশের জন্য ব্যবহার প্রসূত’ এ ধারণার বিরুদ্ধেও এ গবেষণা একটি চ্যালেঞ্জ।
এখন প্রশ্ন হলো, যদি এসব মুখমণ্ডলের ছবি ভেতরের অভিব্যক্তি উপস্থাপন না করতে পারে তবে অন্য মুখমণ্ডলের ভাষা পড়ার ব্যবস্থা করা যাবে কীভাবে? এর উত্তর হলো- মানুষ পরোক্ষভাবে আবেগ বুঝতে পারে। শুধু চেহারা নয় এর জন্য বিভিন্ন ধরনের বিষয় সম্পৃক্ত, যেমন- শরীরের অবস্থান, হাতের ইশারা, কণ্ঠ, সামজিক অবস্থা ইত্যাদি।
এ বিষয়ে মনোবিজ্ঞানী হিলেল অ্যাভাইজার একটি গবেষণা চালান। বিভিন্ন আবেগ প্রকাশকারী চেহারা, সেই সঙ্গে একই ব্যক্তির শরীরের বাকি অংশের বিভিন্ন ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। তিনি লক্ষ করেন, শুধুমাত্র মুখের ছবি দেখে যে ধরনের আবেগ সনাক্ত করা হয়, মুখ ও শরীর একসঙ্গে থাকলে সেটি অন্য আবেগ হিসেবে সনাক্ত হয়।
উদাহরণস্বরুপ, যখন শুধুমাত্র চোখ-রাঙ্গানো কোনো মুখ কেউ লক্ষ করে তখন মনে করে এটা ‘রাগে’র প্রতিচ্ছবি। কিন্তু এই মুখের সঙ্গে যদি শরীরের বাকি অংশের এমন ছবি জুড়ে দেওয়া হয় যাতে দেখা যায় ওই ব্যক্তির হাতে কোনো ময়লা যুক্ত বস্তু রয়েছে, তখন এ বিষয়টি ‘বিরক্তি’ হিসেবে সনাক্ত হয়।
আপনি হয়তো মনে করছেন- কারো মুখের দিকে তাকিয়ে তো তার মনের খবর আপনি বলে দিতে পারেন। তবে এখন থেকে যাচাই করে নিন আসলেই আপনি মনের খবর বলতে পারেন কিনা?
বন্ধুরা আরও নানা বিষয়ে জানতে ও আপনার মতামত জানাতে https://www.facebook.com/bnlifestyle লাইফস্টাইল বিভাগে লেখা পাঠাতে পারেন [email protected]