বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার মেয়ে রাজিয়া পারভীন মলি, পাঁচ বোনের মধ্যে তিনিই সবার ছোট। নিজের ভেতরে সবসময়ই ইচ্ছা ছিল কিছু একটা করার।
মলি তার বোনের কাছেই প্রথম কুরুশের কাজ শেখেন এবং সিদ্ধান্ত নেন কুরুশের কাটা দিয়েই নিজের স্বপ্নের জাল বুনবেন। সেই লক্ষ্যে ১২ জন অদক্ষ কর্মী এবং মাত্র ১৪ হাজার টাকা নিয়ে শুরু করেন তার উদ্যোগ। তার সেই অদক্ষ দলকে দক্ষ করার দায়িত্ব নেন মলির মেজ বোন।
মলির উদ্যোগের নাম আলো হ্যান্ডিক্র্যাফট। ভাইয়ের সাহায্য নিয়ে ১৪ হাজার টাকার সুতা কিনে এবং আলো হ্যান্ডিক্র্যাফট নামে একটি অনলাইন পেজ খুলে তিনি শুরু করেন নিজের স্বপ্নের পথে চলা। প্রথম দুই মাস কোনোই সাড়া না পেয়ে কিছুটা হতাশ হলেও হাল ছাড়েননি তিনি। আর এই হাল না ছেড়ে দেওয়ার পুরস্কার হিসেবে পেয়ে যান দু’টি ব্যাগের অর্ডার।
এদিকে গ্রামের যে ১২ জন অদক্ষ কর্মীকে কাজ শিখিয়ে দক্ষ করে তোলা হচ্ছিল তারাই আশাহত করল মলিকে। কারণ তারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করেনি। শেষ পর্যন্ত সময় কম থাকায় উপায় না পেয়ে মলি এবং তার বোন রাত দিন কষ্ট করে ব্যাগ দু’টির কাজ শেষ করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ডেলিভারি দেন ক্রেতার কাছে। তারপর ধীর গতিতে হলেও এগোতে থাকে মলির উদ্যোগ।
নিজে কিছু করার ইচ্ছার পাশাপাশি মলির স্বপ্নের একটি বড় অংশ জুড়ে ছিল গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত নারীদের জন্য কিছু একটা করার তীব্র ইচ্ছা। তাই মলি এবং তার বোন প্রত্যন্ত গ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে সেখানকার সুবিধাবঞ্চিত নারীদের শেখাতে লাগলেন কুরুশের কাজ। যদিও মলি সেসময় পর্যন্তও তেমন বড় কোনো অর্ডার পাননি।
টাকা খরচ করে অনেক মেলায় অংশগ্রহণ করেছেন মলি। উদ্দেশ্য একটাই সুবিধাবঞ্চিত নারীদের কাজ এনে দেয়ার মাধ্যমে নিজের স্বপ্ন পূরণ করা। কিন্তু বিধিবাম, মেলায় অংশগ্রহণ করেও মলি তেমন কোনো ফল পাননি। হতাশা ঘিরে ধরতে শুরু করলেও মলি নতুন উদ্যোমে কাজ শুরু করেন। আর তার এই উদ্যোম এবং তার এই দৃঢ়তা তাকে সপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। মলির পণ্যের প্রচার হতে থাকে ধীরে ধীরে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও মলির কুরুশের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। আর সেই সূত্র ধরেই মলির পণ্য বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।
বর্তমানে মলির অধীনে কাজ করছে ১হাজার ২০০ জন্য স্থায়ী কর্মী। তাদের তত্ত্বাবধানের জন্য রয়েছে ১৫ জন সুপারভাইজার। এছাড়াও বিভিন্ন উপলক্ষ সামনে রেখে অনেক বেশি কাজের অর্ডার আসে বলে বেশ কিছু অস্থায়ী কর্মীও রয়েছে মলির। তার কর্মীদের মধ্যে বেশিরভাগই গৃহিণী এবং ছুটিতে অলস সময় কাটাচ্ছে এমন শিক্ষার্থী। মলি কাজ শুরু করার আগে এবং পরে দুই সময়েই দেখেছেন গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠী সংসার চালাতে গিয়ে সুদের ওপরে টাকা ধার নিয়ে ঋণে জর্জরিত হয়ে ভয়াবহভাবে দিনানিপাত করছে। তাই কুরুশের পণ্যের অর্ডার পাওয়ার পর থেকেই বোনকে নিয়ে গ্রামে গ্রামে গিয়ে কুরুশের কাজ শিখিয়েছেন অসংখ্য নারীকে যেন তারা জীবনে আলোর মুখ দেখতে পারে।
আলো হ্যান্ডিক্রাফট, উদ্যোগের এই নামটিই মলির স্বপ্নের প্রতিফলন। এই নামকরণের মূল লক্ষ্যই ছিল অভাব এবং বেকারত্বের অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিস্থিতি থেকে অন্তত কিছু মানুষকে আলোর মুখ দেখানো।
২০১৬ সাল থেকে চলছে মলির ছুটে চলা। এছাড়াও ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে ওমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই) তে জয়েনের মাধ্যমে মলির উদ্যোগের গতি আরও বেড়ে যায়। ব্যাগ, কুশন, বেডকভার, শাড়ি, ফতুয়া, পাঞ্জাবি, সালোয়ার-কামিজসহ শিশুদের পোশাক তৈরি করা হয় কুরুশের কাজ দিয়ে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০২০
এসআইএস