ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

রাজধানীর ‘বিরক্তি’ পোস্টার নিয়ে পাইলট প্রকল্প কাজ করবে তো?

মিরাজ মাহবুব ইফতি, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৬ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০২৩
রাজধানীর ‘বিরক্তি’ পোস্টার নিয়ে পাইলট প্রকল্প কাজ করবে তো?

ঢাকা: রাজধানীবাসীর পোস্টার ‘বিরক্তি’ শেষ হচ্ছে না। যেখানেই চোখ পড়ে পোস্টার, ব্যানার।

রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক, বিজ্ঞাপন- নানা ধরনের কাগুজে প্রচারণা দীর্ঘদিন ধরে বড় বিরক্তির কারণ। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো সৌন্দর্য-নান্দনিকতার। যে কারণে নির্দিষ্ট স্থানে পোস্টার সাঁটাতে উদ্যোগ নেয় ঢাকা নর্থ সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। সংস্থার পক্ষ থেকে বসানো হয় বোর্ড। কিন্তু সেগুলোও সঠিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না। নগরবাসী ও পরিকল্পনাবিদরা মনে করছেন, সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে এ অব্যবস্থাপনা চলে আসছে বহুদিন ধরে।

গত কয়েকদিন ধরে পুরো উত্তর সিটি করপোরেশন সরজমিনে ঘুরে দেখে বাংলানিউজ। উত্তরা থেকে শুরু করে মিরপুর, বনানী, গুলশান কড়াইল, সমগ্র বাড্ডা এলাকা, রামপুরা, তেজগাঁও, মগবাজার, কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুর- কোনো এলাকা বাদ নেই যেখানে পোস্টার নেই। পোস্টারের পাশাপাশি মোড়ে মোড়ে ঝুলছে ব্যানার। বিশেষ করে স্কুল, হাসপাতাল ও অধিক জনসমাগম হয় এমন স্থান, বাসা-বাড়ির দেয়াল সয়লাব হয়ে গেছে পোস্টারে। যার অধিকাংশই রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের। বড় নেতা, ছোট নেতা এমনকি পাতি নেতারাও নিজেদের পোস্টার-ব্যানার ঝুলিয়ে নিজেদের প্রচারণা করছেন।

নেতাদের পোস্টারের পর ডিএনসিসিতে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রচারণা মূলক পোস্টার-ব্যানারের। নানা অফার, চমকপ্রদ আলাপ নিয়ে এসব ব্যানার-পোস্টার সাঁটানো হয় রাজধানীর বুকে। শুধু যে ডিএনসিসি, তা নয়, ঢাকা সাউথ সিটি করপোরেশনেও (ডিএসসিসি) পোস্টার বিরক্তি বিদ্যমান।

দীর্ঘদিন ধরে এ সংকট চলে আসায় ভোগান্তি নিরসনে উদ্যোগ নেয় ডিএনসিসি। সংস্থার পক্ষ থেকে কিছু কিছু এলাকায় পোস্টার-ব্যানার অপসারণে অভিযান চালাতে দেখা যায়। এ ছাড়া সব ওয়ার্ডে পোস্টার লাগাতে নির্দিষ্ট স্থান নির্ধারণে জন্য কাউন্সিলরদেরও চিঠি পাঠায় কর্তৃপক্ষ।

রাজধানীর কাওরান বাজার, আগারগাঁও তালতলা বাসস্ট্যান্ড ও মিরপুর-১০ নম্বর এলাকার দেয়ালে পাইলটিং প্রকল্প হিসেবে ‘পোস্টার লাগানোর নির্ধারিত স্থান’ লেখা সম্বলিত পনেরটি বোর্ডও বসায় ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না। চলমান প্রকল্পে আরও বোর্ড বসানো হবে বলেও জানায় এ সংস্থা। কিন্তু প্রশ্ন হলো- আদৌ কাজ করবে তো এ পাইলট প্রকল্প?

এলাকাগুলোর স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কে বা কারা কোন পোস্টার লাগান, তারা জানেন না। এমনকি কোন কোন স্থানে পোস্টার লাগানোর বোর্ড বসানো হয়েছে তাও জানেন না।

কেউ কেউ আবার বলছেন, প্রধান সড়কের পাশে বসানো দৃশ্যমান তিনটি বোর্ডও ঢাকা পড়ে যায় হকার ব্যবসায়ীদের দোকানের আড়ালে। সর্বত্রই কেবল রাজনৈতিক পোস্টার লাগানো। প্রচার প্রচারণার অভাব ও আশপাশের দেয়ালে এলোমেলোভাবে সাঁটানো পোস্টারের কারণে চোখে পড়ে না বোর্ডগুলো। এছাড়া হকারদের দখলদারিত্বে ফুটপাত দিয়ে জনসাধারণ চলাচল না করায় কিছু বোর্ড কোনো কাজেই আসছে না।

নগরবিদরা মনে করছেন, পোস্টার লাগাতে অর্থ ব্যয় করে নির্দিষ্ট বোর্ড বসানো কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নয়। রাজধানীতে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন মার্কেট ও পোস্টার লাগানোর অনুমতি পাওয়া যায় এমন সব দেয়ালে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার মাধ্যমে ব্যবহার করা হলে সিটি করপোরেশনের কাজ যেমন সহজ হবে; তেমনই সরকারি অর্থের ব্যয়ও রোধ হবে।

ভুক্তভোগীরা বলেন, পোস্টার লাগাতে নিয়ম করা উচিৎ। এলাকায় এলাকায় বিভিন্ন বাসা-বাড়ির দেয়ালে ঘর ভাড়া, শিক্ষক চাই, সাটার-চুলা মেরামত, ইলেট্রিক মিস্ত্রি, স্কুল-কলেজ-কোচিংয়ের বিজ্ঞাপন, রাজনৈতিক লোকদের বিজ্ঞাপনে ভরা। রাস্তায় গেলে দুই পাশের দেয়ালগুলোয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পোস্টার, মাথার ওপর ব্যানার ঝোলে। এ বিষয়গুলো দীর্ঘদিনের। এ নিয়ে কোনো নীতিমালা আছে বলে মনে হয় না।

তারা বলেন, পোস্টার-ব্যানারের জন্য নির্ধারিত স্থান করা উচিৎ। যাদের নিজেদের বা কোনো পণ্যের প্রচার চালাতে হবে, সেখানে গিয়ে পোস্টার সাঁটিয়ে দিয়ে আসবে। পোস্টার লাগাতেও সঠিক নিয়ম করা উচিৎ। কোথাও একটার বেশি পোস্টার লাগানো যাবে না, সেটিও পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

পাইলট প্রকল্প নিয়ে তাদের ভাষ্য, জনগণের ভ্যাট-ট্যাক্সের টাকায় সিটি করপোরেশন পোস্টার লাগানোর পাইলট প্রকল্প চালাতে পারে না। এটাও এক ধরনের অপচয়। এটি যদি বাস্তবায়নই না হলে পাইলট প্রকল্পের গুরুত্ব কী? পোস্টার লাগাতে সিটি করপোরেশনের যথাযথ ব্যবস্থা নিতেও তারা দাবি করেন।

কেউ কেউ আবার বোর্ডে পোস্টার লাগানোর ব্যবস্থা নিয়ে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তারপরও তাদের উদ্বেগ, সিদ্ধান্তের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন নিয়ে। তারা মনে করেন, শাস্তির বিধান রাখলে প্রকল্প কাজে আসবে। নয়ত মুখ থুবড়ে পড়বে।

ডিএনসিসিবাসীদের দাবি, পোস্টার বোর্ড এর আশপাশের বেশ কিছু অংশ উন্মুক্ত রাখতে হবে। তা ছাড়া এর কোনো মূল্য নেই। বোর্ডের সামনে গাড়ি রাখা, হকার বসা- এতে ভালোর চেয়ে খারাপই হচ্ছে। এসবের কারণে বোর্ডেরও ক্ষতি হতে পারে, সেদিকটা খেয়াল রাখতে হবে। সিটি করপোরেশনর পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের দিয়ে প্রতিনিয়ত স্থানগুলো পরিষ্কার করাতে হবে। জনগণ ও সিটি করপোরেশনের মধ্যে সমন্বয় করে এসব বোর্ড সুরক্ষিত রাখতে হবে।

এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষক ও ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে যত্রতত্র পোস্টার লাগানোর সমস্যা কতখানি দূর হবে, সেটি যাচাই করা কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নয়। এতে শুধু সরকারি অর্থের ব্যয় বাড়বে। এ ছাড়া এসব বোর্ড বসাতে সিটি করপোরেশনের সময়ও ব্যয় করতে হবে। বরং শহরের যেসব দেয়াল ব্যবহার করা সম্ভব- একটি নীতিমালার মাধ্যমে সেগুলো ব্যবহারের উদ্যোগ নিলে পোস্টার বিরক্তি নিরসন করা সহজ হবে।

নির্দিষ্ট স্থানের বাইরে যত্রতত্র পোস্টার লাগানো বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, যেখানে সেখানে ব্যানার-পোস্টার লাগানো বন্ধে শাস্তি বা জরিমানার বিধান করতে হবে। অন্যথায় অর্থ খরচ করে বোর্ড বসিয়েও কোনো লাভ হবে না।

ডিএনসিসির প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মাকসুদ হাসেম বলেন, আমরা ওয়ার্ড কাউন্সিলদের নির্ধারণ করে দেওয়া স্থানগুলোর উপযোগিতা যাচাই করে পোস্টার লাগাতে বোর্ড বসানোর সম্মতি দিয়েছিলাম। এখন সেগুলো দেখভালের দায়িত্ব তাদের। এ পদ্ধতি পাইলট প্রকল্প হিসেবেই এখন পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ চলছে। বোর্ডগুলো পরীক্ষামূলকভাবে বসানো হচ্ছে। ফলে কোন কোন স্থানে বোর্ডগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখছে বা রাখছে না-বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। পূর্ণাঙ্গ ফল পেলে আগামীতে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হবে।

এর আগে, যত্রতত্র পোস্টার লাগিয়ে শহরের সৌন্দর্য নষ্ট করলে ২১ ফেব্রুয়ারির পর কড়াকড়ি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। কিন্তু তার আল্টিমেটামের সময় শেষ হলেও বন্ধ হয়নি অযাচিত পোস্টার-ব্যানার লাগানো। এ ব্যাপারে মেয়রের কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। নগরবাসীরা বলছেন মেয়র শুধু আলটিমেটাম দিয়ে চুপ করে থাকলেই হবে না। অমান্যাকারীদের ধরে শাস্তি দিতে হবে। তা না হলে যে পদ্ধতি কর্তৃপক্ষ চালু করতে চাচ্ছে, তা চলবে না।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৩০ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০২৩
এমএমআই/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।