ঢাকা: কদিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ইডেন ছাত্রী মাহবুবা রহমান আঁখির সন্তানের মৃত্যু ও তার শারীরিক অবস্থা নিয়ে একটি পোস্ট ভাইরাল হয়। ‘চিকিৎসকের অবহেলায় আমার ফ্রেন্ড মৃত্যু পথযাত্রী’ শিরোনামে পোস্টটিতে এখন পর্যন্ত কমেন্ট এসেছে সাড়ে চারশ।
বিষয়টি নিয়ে লোকমুখে সমালোচনা শুরু হয়, পরবর্তীতে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ নিয়ে সংবাদও প্রকাশ হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যারা বিষয়টি নিয়ে সরব, তারা প্রত্যেকেই সেন্ট্রাল হসপিটালের গাইনি ও প্রসূতি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সংযুক্তা সাহাকে নিয়ে সমালোচনা করছেন। এখন প্রশ্ন হলো- রোগীদের সঙ্গে ডা. সংযুক্তার সংযুক্তি কতখানি?
তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হলো- আঁখির বর্তমান অবস্থা বা তার সন্তানের মৃত্যুতে ডা. সংযুক্তা সাহার সংযুক্তি কতখানি?
আঁখির ঘটনাটি নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট হয় গত রোববার (১১ জুন)। পোস্টকারীর মূল লেখার সারসংক্ষেপ- প্রসব ব্যথা নিয়ে সেন্ট্রাল হসপিটালে গেলে সেখানে কোনো চেক আপ ছাড়াই আঁখির শরীরে কাটাছেঁড়া করা হয়। ডা. সংযুক্তা সাহার অধীনে আঁখির চিকিৎসার কথা থাকলেও ঘটনার সময় তিনি হাসপাতালে ছিলেন না। বরং হাসপাতাল থেকে বলা হয়, তিনি অপারেশন থিয়েটারে আছেন। আঁখির শারীরিক অবস্থা ভালো ছিল। হাসপাতালের চিকিৎসকরা তাকে সন্তান প্রসবের জন্য প্রেশার দিতে বলেন।
পোস্টকারী তার লেখায় ডা. মিলি নামে একজনের কথা উল্লেখ করেন। তিনিই আঁখিকে প্রসবের জন্য প্রেসার দিতে বলেন। অনেকক্ষণ চেষ্টা করে না হওয়ায় মিলি বার অন্যান্যরা আঁখির প্রসবের রাস্তার কিছু অংশ কেটে ফেলেন। এতে করে আঁখির মূত্রনালি ও মলদ্বার কেটে যায়। প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ শুরু হলে আঁখি জ্ঞান হারান। এ অবস্থায় চিকিৎসকরা আঁখির সিজার করেন। তার সন্তানের প্রসব করিয়ে কাটা জায়গাগুলো সেলাই করে দেন। এদিকে সদ্যজাতের হার্টবিট কমে গেলে তাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। আঁখির স্বজনরা পরে তাকে ও তার সন্তানকে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানেই আঁখির সদ্যজাত সন্তানের মৃত্যু হয়। এ তথ্য জানিয়েছে সেন্ট্রাল হাসপাতাল।
দীর্ঘ এ লেখার তিনি আরও উল্লেখ করেন, আঁখির স্বামী ইয়াকুব আলী সুমন ডাক্তার সংযুক্তার খোঁজ করছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি জানতে পারেন, চিকিৎসক বিদেশে। তার প্রশ্ন, ডাক্তার যদি বিদেশেই থাকেন, অপারেশন করলো কে?
আঁখির পরিবার জানিয়েছে, প্রায় তিন মাস ধরে তিনি সেন্ট্রাল হসপিটালের গাইনি ও প্রসূতি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সংযুক্তা সাহার অধীনে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। তার শারীরিক অবস্থাও স্বাভাবিক ছিল। সংযুক্তার পরামর্শ অনুযায়ী তিনি স্বাভাবিক পদ্ধতিতে (নরমাল ডেলিভারি) সন্তান প্রসবের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। চিকিৎসক তাকে সেভাবেই আশ্বস্ত করেছিলেন। আঁখির প্রসব ব্যথা ওঠায় গত ৯ জুন রাত ১২টা ৫০ মিনিটে ডা. সংযুক্তার অধীনে সেন্ট্রাল হসপিটালে তাকে ভর্তি করা হয়।
পরবর্তীতে গণমাধ্যম যখন সুমনের সঙ্গে কথা বলে তিনি জানান, আঁখিকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার পর নরমাল ডেলিভারির জন্য চেষ্টা চালানো হয়। তিনি তখন সংযুক্তা সাহা হাসপাতালে আছেন কিনা জানতে চান। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, সংযুক্তা আছেন এবং তিনি অপারেশন থিয়েটারে (ওটি) তার চেষ্টা চালাচ্ছেন। পরে সুমন জানতে পারেন, ডা. সংযুক্তা সাহা হাসপাতালে ছিলেনই না। বরং যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা রোগীর কোনোরকম চেক-আপ ছাড়াই ডেলিভারির কাজ শুরু করে দেন। আঁখির ভাই শামীমও এসব তথ্যই গণমাধ্যমকে দিয়েছেন।
আঁখির স্বামী বাংলানিউজকে বলেন, আমি তার ফাঁসি চাই। কারণ, তার অধীনেই আমার স্ত্রী ট্রিটমেন্ট নিয়েছেন। ঘটনার দিন রাত সাড়ে ১১টার দিকে তার লেবার পেইন ওঠে। সঙ্গে সঙ্গেই আমরা ডা. সংযুক্তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিই। তখন তিনি সেন্ট্রাল হসপিটালে তার চেম্বারে ছিলেন। কিন্তু আমাদের যেতে একটু দেরি হয়, হাসপাতালে পৌঁছাই রাত সাড়ে ১২টার দিকে। কিন্তু ততক্ষণে সংযুক্তা হাসপাতাল ছেড়ে চলে যান।
সুমন বলেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও আমাকে বলেনি যে সংযুক্তা চলে গেছেন। তারাই আমার স্ত্রীকে নিয়ে যায়। বলেছে, ম্যাডাম আছেন। তারা এ কাজটি করেছে, কারণ তারা ভেবেছিল আমরা বা রোগী ফেরত চলে যাবে। তারা আঁখিকে লেবার ওয়ার্ডে নিয়ে তাকে প্রেসারাইজড করে। ওকে কাটাছেঁড়া করে। তারা প্রত্যেকেই সংযুক্তা সাহার নির্দেশে এ কাজটি করেছে বলে আমাদের জানিয়েছে।
তার প্রশ্ন, সংযুক্তা সাহা যদি তাদের নির্দেশ না দিয়ে থাকে তাহলে তারা কেন এ কাজটি করলো? তা ছাড়া সংযুক্তার অধীনেই আমি রোগী ভর্তি করিয়েছি। তার নামেই আমি বিল পরিশোধ করেছি। কাগজপত্রেও তার নাম লেখা। সে আমার রোগী দেখতে না পারলে তার নাম থাকবে কেন? তার কাছে যদি আমি না যেতাম, তাহলে এ দুর্ঘটনা হতো না।
সেন্ট্রাল হাসপাতালের এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। ১১ জন আসামির মধ্যে দুজন গ্রেপ্তার হয়েছেন। সুমনের বক্তব্য অনুসারে, সংযুক্তা সাহার নামও আছে মামলায়। কিন্তু তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। তিনি আরও বলেন, পুরো হাসপাতাল এ ঘটনা জড়িত। আমি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।
আঁখির ভাই শামীম বাংলানিউজকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমার কাছ থেকে অনেকেই জেনেছেন। আমাদের মানসিক অবস্থায় এখন সেই পর্যায়ে নেই। তারপরও বলবো, মামলা তো হয়েছে। সংযুক্তার নাম যে সেখানে নেই তা কিন্তু না। আছে, কিন্তু একটু ক্রাইটেরিয়ার মধ্যে রাখা হয়েছে। তিনি জিজ্ঞাসাবাদে আছেন। আপাতত এভাবেই চলবে। আলাদা করে তার বিরুদ্ধে কিছু এখনই আমরা করতে পারব না।
সেন্ট্রাল হসপিটালের চিকিৎসা কার্যক্রমের বিষয়ে অধ্যাপক ডা. সংযুক্তা সাহাকে জড়িয়ে অভিযোগ এখানেই শেষ নয়। আগে পরে অনেকেই প্রকাশ্যে বা পরোক্ষভাবে অভিযোগ তুলেছিলেন। কিন্তু ঘটা করে সংযুক্তা সাহাকে নিয়ে সমালোচনা শুরু হয় আঁখির ব্যাপারে পোস্ট নিয়ে। সেখান বেশ কয়েকজনের মন্তব্য, সংযুক্তা সাহা চিকিৎসক হিসেবে ভালো নন।
ওই পোস্টের কিছু কমেন্ট এই প্রতিবেদনে যোগ করা হলো ছবির মাধ্যমে। সংগত কারণে মন্তব্যকারীদের নামগুলো মুছে দেওয়া হলো।
আঁখির সন্তানের মৃত্যু-তার বর্তমান পরিস্থিতি, মামলার ঘটনা ও পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য জানার চেষ্টা করে বাংলানিউজ। হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে জানানো হয়, তাদের বিজনেস ডেভেলপমেন্ট কর্মকর্তা রাসেল এ ব্যাপারে বলতে পারবেন। তার সঙ্গে হাসপাতাল থেকে যোগাযোগ করানোর চেষ্টাও করা হয়। কিন্তু কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে রেখে হাসপাতাল থেকে জানানো হয়, রাসেল বা সংশ্লিষ্ট কেউ হাসপাতালে নেই। বিষয়টি নিয়ে এখন কেউ কথা বলতে পারবেন না।
সামগ্রিক বিষয়ে জানতে ডা. সংযুক্তা সাহাকে ফোন করে বাংলানিউজ। কিন্তু বেশ কয়েবার তার ফোন ব্যস্ত পাওয়া যায়। পরবর্তীতে আবার চেষ্টা করা হলে তার সহকারী ফোন রিসিভ করেন। তিনি বলেন, ম্যাডামের চেম্বার থেকে বলছি। তিনি ডিউটিতে আছেন। উপরে গেছেন। এখন কথা বলা যাবে না।
কে বলছেন জানতে চাইলে তিনি ফোনের লাইন কেটে দেন। পরবর্তীতে আবার ফোন করেও সংযুক্তাকে পায়নি বাংলানিউজ।
এ ঘটনাটি নিয়ে যে মামলা হয়েছে তাতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের ভুল চিকিৎসা ও কর্তৃপক্ষের প্রতারণায় সন্তান হারান ইয়াকুব আলী সুমন। তার স্ত্রী মাহবুবা রহমান আঁখিও রয়েছেন মৃত্যুঝুঁকিতে।
মামলায় আঁখির পরিবার ‘অবহেলাজনিত মৃত্যু’র অভিযোগে পাঁচজনের নাম ও ৫/৬ জনকে অজ্ঞাত উল্লেখ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বুধবার (১৪ জুন) রাতে সেন্ট্রাল হসপিটালের চিকিৎসক ডা. শাহজাদী ও ডা. মুন্নাকে গ্রেপ্তার করে ধানমন্ডি থানা পুলিশ। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পারভেজ ইসলাম। এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, ডা. শাহজাদী ও ডা. মুন্না মামলার প্রথম ও দ্বিতীয় আসামি।
বৃহস্পতিবার (১৫ জুন) ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তোলা হয় তাদের। বিচারকের সামনে তারা নিজেদের দোষ স্বীকার করে জবানবন্দী দিয়েছেন। সিএমএম আদালতে ধানমন্ডি থানার সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা মাহফুজুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করে জানান, গ্রেপ্তারের পর ডা. শাহজাদী ও ডা. মুন্না স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে সম্মত হন। পরে তাদের জবানবন্দী রেকর্ডের আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আফনান সুমী আসামি শাহজাদীর ও মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ফারাহ দিবা ছন্দা আসামি মুন্নার জবানবন্দি রেকর্ড করেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪০ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০২৩
এমজে