ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

দুই পা হারিয়ে নদীর বুকে ২৬ বছর!

মুস্তাফিজুর রহমান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫৩ ঘণ্টা, জুন ২৭, ২০২৩
দুই পা হারিয়ে নদীর বুকে ২৬ বছর!

পাবনা: রোদ, বৃষ্টি, ঝড় সকল প্রতিকূলতাকে মাথায় নিয়ে দীর্ঘ ২ যুগেরও অধিক সময় ধরে নদীর বুকে একাকী জীবন যাপন করছেন পাবনা বেড়া উপজেলার কৌটুলা ইউনিয়নের মানিক নগর গ্রামের শারীরিক প্রতিবন্ধী মো. সিরাজুল ইসলাম মোল্লা।  

শারীরিক অক্ষমতা হার মেনেছে তার মনোবলের কাছে।

পরিবারের কাছে বোঝা না হয়ে থেকে নিজ গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা কাগেরশ্বর নদীতে প্লাস্টিকের বড় ড্রাম দিয়ে তৈরি করেন ভাসমান ঝুপড়ি ঘর। আর সেখানেই তিনি ২৬ বছর ধরে বসবাস করছেন। সব ছেড়ে নদীতে একাকী ভাসমান জীবন বেছে নিয়েছেন লোক চক্ষুর আড়ালে থাকা হতদরিদ্র সিরাজুল। মাছ ধরা আর নদীর দুই পারের মানুষদের পারাপার করে সামান্য অর্থ দিয়ে কোনো রকমে জীবন যাপন করে চলছেন তিনি।  

“আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও, রহিমদ্দির ছোট্র বাড়ি রসুলপুরে যাও, বাড়ি তো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছানি, একটু খানি বৃষ্টি হলে গড়িয়ে পরে পানি”। পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের লেখা ছোট বেলাতে পাঠ্য বইয়ে দেওয়া সেই কালজয়ী বিখ্যাত কবিতার কথা আমাদের সকলের জানা। সেই কবিতার গল্পের সঙ্গে অনেকটাই মিল পাওয়া যাবে বয়সের ভারে নূয়েপড়া সিরাজুলের জীবন যাপন দেখে। নদীর পারে ছোট ভাসমান ভেলার ওপরে তার দীর্ঘ দিনের বসবাস। আর বর্তমান ২০২৩ সালে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পরে বাস্তবিক সিরাজুল ইসলামকে দেখতে এখন অনেকেই পাবনা বেড়া উপজেলার কৌটুলা ইউনিয়নের মানিক নগর গ্রামে যাচ্ছেন। যুবক বয়সের নানা কর্মে জীবন ধারণ করলেও এখন তার একমাত্র পেশা নদীতে মাছ ধরা। বয়সের ভারে নুয়ে পরা বৃদ্ধ সিরাজুল ইসলাম মোল্লার আগেরম মত আর কর্মশক্তি এখন নেই বলল্লেই চলে। নিজের ছোট ডিঙি নৌকা নিয়ে সারাদিন মাছ ধরেন কাগেশ্বরী নদীতে।  

ভাসমান ভেলায় ২৬ বছর ধরে প্রায় ৭০ বছর বয়সী শারীরিক প্রতিবন্ধী সিরাজ মিয়ার জীবনের গল্পটা সমাজের অন্যদের চাইতে একটু ভিন্ন। সব থেকেও যেন কোনো কিছুই নেই তার। আছে শুধু বুক ভরা কষ্ট আর দীর্ঘশ্বাস। একমাত্র সম্বল একটি নৌকা আর নদীর বুকে ভাসমান প্লাস্টিকের ঝুপড়ি ঘরে কষ্টের জীবন যাপন। চার কন্যা আর তিন পুত্র সন্তানের জনক সিরাজ মিয়া। দুটি পা না থাকায় পরিবারের কাছে বোঝা না হয়ে বেছে নিয়েছেন একাকী ভাসমান জীবন।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সিরাজুল মোল্লা অনেক কষ্ট করে দিনাতিপাত করছেন। দীর্ঘদিন ধরে নদীতে ভেলার উপরে ঘর করে সেখানেই থাকেন তিনি। মাছ ধরে আর মানুষ পারাপার করে সামান্য কিছু অর্থ উপার্জন করে স্ত্রীকে নিয়ে কোনো রকমে তার বেঁচে থাকা তার।  

সিরাজুলের বড় ছেলে সেলিম মোল্লা ও ছেলের বউ বলেন, খুব কষ্ট হয় অনেক রাত ঘুমাতে পারিনি আমার বাবা কত কষ্ট করে নদীর ওপরে ঝুপড়ি ঘরে থাকেন। নদীতে যখন পানি বারে ঝড় উঠে তখন ছুটে যাই ঝুপড়ি ঘরের কাছে। অনেক সময় কোলে করে পারে নিয়ে আসেত হয় তাকে। দুটি পা কাটা প্রাকৃতিক কাজ সারতে অনেক কষ্ট হয় তার। আর সেই কারণেই সে নদী থেকে আসতে চায়না বাড়িতে। আমার মা তিন বেলা রান্না করে খাবার নিয়ে দিয়ে আসে।  

তারা আরও বলেন, বড় সংসার কষ্ট করে নিজেদের সংসার চালাতে হয় আমাদের। মাঠে কোনো চাষের জমি নেই আমাদের। একটু খানি ভিটাবাড়ি সেখানে তিন ভাই ঘর তুলে থাকি আমরা। বাবাকে নিয়ে আনতে চাই কিন্তুু সে নদীতেই থাকতে চায়। আমার মা-বেঁচে থাকলেও তারা আলাদা থাকেন। তাই সরকারের কাছে আবেদন নদীর পারে অথবা নদীতে একটি সুন্দর ভাসমান ঘর নির্মাণ করে দিলে শেষ বয়সে তারা এক সঙ্গে থাকতে পারতেন। আমার মা আমার বাবার সেবা করতেও পারতেন।

সিরাজুল ইসলামের স্ত্রী জয়নব বেগম বলেন, বছরের পর বছর ধরে নীরবে কাঁদিছি অল্লাহ আমার কি পরীক্ষা নিচ্ছে এত কষ্ট কীভাবে সহ্য করা যায় বলেন বেটা। আমার স্বামী থাকেও নাই। সামান্য একটু জায়গা সন্তানরা বসত করে। গরিব মানুষ আমরা, কোনো রকমে খেয়ে না খেয়ে বেঁছে আছি। যখন সুস্থ ছিল তখন সব ধরনের কাজই করেছেন তিনি। কি একটা রোগ হলো প্রথমে এক পা পরে আরেকটা কাটা লাগলো। এখন পঙ্গু দুই পা কাটা চলাফেরা করতে অনেক কষ্ট হয়। ওই মানুষটাক কীভাবে চলাচল করবি বলেন বেটা।

তিনি আরও বলেন, সরকার ঘর দিছিলো কিন্তু সেখান থেকে নদীতে আসা অনেক কষ্ট। বাথরুম করবে কীভাবে তাই কষ্টে অভিমানে নদীতেই সবার কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে ওই ঘর তুলে সেখানে থাকে। নৌকা লিয়ে মাছ ধরে, খাবার সময় পারে আসে ভাইত দেই খায়ে নামাজ পরে আবার চলে যায়। ওই ঝুপড়ি ঘরে কি মানুষ থাকার মতো, আপনারাতো দেখেছেন কত কষ্ট করে থাকে সেখানে। তাই সরকারের কাছে আবেদন নদীর পারে বা নদীতে ভাসমান একটি ঘর করে দিলি বাকী জীবন এক সঙ্গে দুইজন থাকপের পারতেম। আর কয়দিনই বাঁচবো বেটা।

সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, যুবক বয়সে যখন যে কাজ পেয়েছেন সেই কাজই করছি। ধানকাটা থেকে শুরু করে মাছ ধরা সব করেছি। বাপের সঙ্গে গ্রামে গ্রামে সিলভারের তৈরি মাল বিক্রি করতাম এক সময়। পরে বগুড়ায় চলে গেলেম। সেখানে পায়ের আঙ্গুলে আঘাত লেগে পচন ধরলো। কত ডাক্তার দেখালেম লাভ হলোনা, সবশেষে পায়া কাটা লাগলো। পরে বাড়িত চলে আসলেম পরের বছর ভালো পায়ে আবার খোঁচা লাগে পচন ধরলো পরে সে পাও কাটা লাগলো। টাকার অভাবে সঠিক চিকিৎসা না করতে পারায় কেটে ফেলতে হয় তার দুটি পা।  

তিনি আরও জানান, স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে না পারায় পরিবারের কাছে বোঝা হয়ে উঠেছিলাম। তখন সিদ্ধান্ত নিলাম ছোট বেলা থেকে মাছ ধরতে পারতাম। তাই নদীর পারে এই ভাসমান ঘর তুলে বসবাস শুরু করি। এলাকার সবাই আমাক খুব ভালোবাসে। নদীত মাছ ধরে যে পয়সা হয় তা দিয়ে বউটাকে নিয়ে কোনো রকমে খায়ে না খায়ে বেঁচে আছি। তাই আপনারা যখন আয়ছেন তখন আমার একটা আবদার আছে, এই নদীর পারে অথবা নদীত যদি একটি ভাসমান ঘর করে দিতে সরকার তা হলি বাকী জীবন বুড়া-বুড়ি এক সঙ্গে থাকপের পরতেম।

পাবনা বেড়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সবুর আলী বলেন, বর্তমান সরকার প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারাদেশে হতদরিদ্র মানুষদের জন্য বিনামূল্যে ঘর নির্মাণ করে দিচ্ছেন জায়গা দিচ্ছেন। প্রতিবন্ধী সিরাজুল ইসলামকে একটি ঘর দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই ঘর সে নেয়নি, তার কারণ ঘর থেকে তার মাছ ধরার স্থান নদী একটু দূরে হয়ে যায়। তাই আমরা নতুন করে সকলে মিলে একটি সিন্ধান্ত গ্রহণ করেছি। উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, মেম্বারদেরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাকে কীভাবে সহযোগিতা করা যায়। তবে সে যাতে বসবাস করতে পারে আবার নদীতে মাছ ধরতে পারে সেদিকটায় মাথায় নিয়ে একটি সুন্দর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আশা করছি খুব দ্রুতই সে তার পরিবার নিয়ে সেখানে ববসাস করতে পারবেন। আর যেহেতু শারীরিক প্রতিবন্ধী সেদিকটাও আমরা খেয়াল রাখছি।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৩ ঘণ্টা, জুন ২৭, ২০২৩
এসএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।