ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চাইলেন নারী ফুটবলার মঙ্গলী

মাহবুবুর রহমান মুন্না, ব্যুরো এডিটর  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯১২ ঘণ্টা, আগস্ট ৩, ২০২৩
প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চাইলেন নারী ফুটবলার মঙ্গলী খুলনার  সুপার কুইন ফুটবল একাডেমির ফুটবলার মঙ্গলী বাগচি

শর্টস পরে খেলায় প্রতিবেশীদের হাতে মারধরের শিকার হন খুলনা জেলা অর্নূধ্ব-১৭ দলের খেলোয়াড় সাদিয়া আক্তার তিন্নি। বটিয়াঘাটার তেঁতুলতলা গ্রামের  ‘সুপার কুইন ফুটবল একাডেমি’তে অনুশীলন করেন তিনি।

এ ঘটনায় বিচার চাইতে গিয়ে আহত হন সাদিয়াসহ তার একাডেমির আরও চার নারী ফুটবলার।

রড দিয়ে সাদিয়ার সঙ্গী মঙ্গলী বাগচির মাথায় আঘাত করেন প্রতিবেশী নূর আলম। এ ঘটনায় করা মামলায় ৬ জনকে আসামি করা হলেও গ্রেপ্তার রয়েছেন কেবল নূর আলম। তার মেয়ে নূপুর খাতুনসহ বাকিরা জামিনে আছেন।

এ মূহূর্তে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ফুটবলার মঙ্গলী বাগচি অভিযোগ করে বলেন, এভাবে মারধরের পরও ক্ষান্ত হচ্ছেন না আসামিরা। মামলা তুলে না নিলে অ্যাসিড নিক্ষেপ করে মুখ ঝলসে দেবে বলে হুমকি দিয়েছেন জামিনে বাইরে থাকা সালাউদ্দিন নামের এক আসামি।  

বৃহস্পতিবার (৩ আগস্ট) বিকেলে খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ৩১৩ নং কক্ষের বেডে বসে কথা হয় প্রতিবাদী এই ফুটবলারের সঙ্গে।

কী ঘটেছিল সেদিন জানতে চাইলে ভুক্তভোগী ফুটবলার মঙ্গলী বাগচি বাংলানিউজকে বলেন, সাদিয়া নাসরিনের পাশের বাড়ির বাসিন্দা নূপুর আক্তার। মোবাইল ফোনে সাদিয়ার ছবি তুলে নূপুর তাকে শাসায়, এত বড় মেয়ে হাফপ্যান্ট পরে ফুটবল খেলিস, লজ্জা-শরম নাই? এ ধরনের মন্তব্য করেন, নূপুরের বাবা নূর আলম খাঁ, মা রঞ্জি বেগম ও তার ভাই সালাউদ্দিনও। এ মন্তব্যে আমরা প্রতিবাদ করলে আমাদের ওপর হামলা করে তারা। কিল, চড়, ঘুষি মারে ও লোহার রড দিয়ে আঘাত করেন তারা। এতে আমার মাথা ফেটে যায়। এ সময় আহত হন সাদিয়া, হাজেরা ও জুঁই।  

মঙ্গলী আরও বলেন, এ ঘটনার কয়েকদিন পরও সালাউদ্দিন আমাদের হুমকি দেয় তোদের অ্যাসিড মারব, মুখ নষ্ট করে দেব, তোদের খেলাধুলা বন্ধ করে দেব। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে এর সুষ্ঠু একটি বিচার চাই।

মঙ্গলী বলেন, ঘটনার পর আমরা মামলা করেছি। মামলা তুলে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। মামলা না তুলে নিলে অ্যাসিড মেরে মুখ ঝলসে দেওয়ারও ভয় দেখাচ্ছেন আসামিরা। এতে আমরা আতঙ্কিত, নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।

হাফপ্যান্ট ও জার্সি পরে ফুটবল খেলার কারণে মারধরের শিকার হওয়া হাজেরা খাতুন, জুঁই মণ্ডল ও সাদিয়ার চোখে-মুখে এখনও আতঙ্কের ছাপ।

 

যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত

এলাকাবাসী জানান, খুলনার বটিয়াঘাটার তেঁতুলতলা গ্রামের সাদিয়া নাসরিন জেলা অনূর্ধ্ব-১৭ দলের ফুটবল খেলোয়াড়। বটিয়াঘাটা কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী সাদিয়া ও অন্য কিশোরীরা স্থানীয় ‘তেুঁতলতলা সুপার কুইন ফুটবল একাডেমি’তে অনুশীলন করে।

গত ২৭ জুলাই বৃহস্পতিবার একাডেমিতে অনুশীলনের সময় নূপুর খাতুন নামে প্রতিবেশী এক মেয়ে তার ছবি তোলেন। পরে বাড়িতে গিয়ে তার বাবা-মাকে সেই ছবি দেখিয়ে আজেবাজে মন্তব্য করে আসেন। সাদিয়া ২৯ জুলাই (শনিবার) বিষয়টি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে নূপুর অকথ্য ভাষায় তাকে গালিগালাজ করেন। প্রতিবাদ করলে তাকে এলোপাতাড়িভাবে কিল, চড়, ঘুষি মেরে মুখ ও বুকের বিভিন্ন স্থানে জখম করা হয়।

এরপর নিজের বাড়িতে ফিরে গিয়ে সাদিয়া তার মাকে সব ঘটনা জানান। সন্ধ্যার পর সাদিয়ার মা, নানি ও বন্ধু মঙ্গলী নূপুরের বাসায় গিয়ে সাদিয়াকে মারধরের বিষয়ে জানতে চান। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে নূপুর, তার বাবা নূর আলম খাঁ, ভাই সালাউদ্দিন ও নূপুরের মা রঞ্জি বেগম তাদের ওপর হামলা করেন। এতে মঙ্গলী, হাজেরা ও জুঁই আহত হন। নুপুরের বাবা লোহার রড দিয়ে মঙ্গলীর মাথায় আঘাত করেন।

ওই রাতে লোহার রড দিয়ে আঘাত করার পর মঙ্গলী জ্ঞান হারায় এবং এরপর বাড়ির লোকজন মঙ্গলীকে বাড়ির ভেতর নিয়ে চেয়ারে বসিয়ে প্রায় ২ ঘণ্টা বেঁধে রাখেন।

ঘটনার পর মামলা

ঘটনার পর পরে রোববার (৩১ জুলাই) দুপুরে সাদিয়া নাসরিন বাদি হয়ে বটিয়াঘাটা থানায় ৬ জনকে আসামি করে মামলা করে।

আসামিরা হলেন- তেঁতুলতলা স্কুল মাঠ এলাকার আলাউদ্দিন (১৬), সালাউদ্দিন (২২), নুর আলম (৪৮), রঞ্জি বেগম (৪০), মনোয়ারা বেগম (৫৫) ও নূপুর খাতুন (২২)।

মঙ্গলবার (১ আগস্ট) আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নেন সালাউদ্দিন, রঞ্জি বেগম  ও নুপুর খাতুন।

প্রতিবাদের ঝড়

এ ঘটনার পর গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে নিন্দা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে), মহিলা পরিষদ, নাগরিক উদ্যোগসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন।  

বৃহস্পতিবার (৩ আগস্ট) দুপুরে খুলনা প্রেসক্লাবের সামনে দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অধিকার আন্দোলন (বিডিইআরএম) খুলনা জেলা শাখা মানববন্ধন করেছে।

এ বিষয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘নাগরিক উদ্যোগ খুলনা’র বিভাগীয় সমন্বয়কারী মো. রহিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমানে এই বিশ্বায়নের যুগে নারীরা যেখানে প্রতিটি সেক্টর এ অবদান রাখছে। যে দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, তিনি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নারীর ক্ষমতায়ন করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে চলেছেন, নারীরা আজ স্বপ্ন দেখে, মাথা উঁচু করে বাঁচার। আর এখানে ফুটবলাররা আজ লাঞ্ছিত, অপমাণিত। ধিক্কার জানাই সমাজকে, যে সমাজ একজন নারীকে তার সম্মান দিতে জানে না। এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি, দোষীদের অতি সত্বর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কামনা করছি প্রধানমন্ত্রীর কাছে।

খুলনা জেলা প্রশাসক ও পলিশ সুপার যা বললেন

খুলনা জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন বাংলানিউজকে বলেন, নারী খেলোয়ারদের ওপর হামলার ঘটনাটি অধিক গুরুত্ব নিয়ে দেখা হচ্ছে। এ বিষয়ে মামলা হয়েছে। আসামিও গ্রেপ্তার রয়েছে। আইনি প্রক্রিয়াও চলমান আছে। এ বিষয়ে আমাদের অবস্থান খুব পরিষ্কার -  যার ভালো লাগবে সে খেলবে। তাকে কেউ বাধা দিতে পারবে না। যে মেয়েটা খেলতে চায় তার পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। এদের মধ্য থেকে ভালো খেলোয়াড় বেরিয়ে আসবে। এতে দেশ-বিদেশে আমাদের সুনাম ছড়িয়ে পড়বে।

খুলনা জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাঈদুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, একজন নারী কর্তৃক একজন নারী ফুটবলারের ছবি তোলাকে কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত। এই ঘটনার নারী ফুটবলরা আহত হয়। এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। পুলিশ একজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তিনজন আদালতে হাজির হয়ে জামিনে আছেন। আমরা মামলা তদন্ত করছি। আশা করছি অল্পদিনের মধ্যে পুলিশ প্রতিবেদন দিতে সক্ষম হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৯০৩ ঘণ্টা, আগস্ট ৩, ২০২৩
এমআরএম/এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।