ঢাকা, শনিবার, ১৭ ফাল্গুন ১৪৩১, ০১ মার্চ ২০২৫, ০০ রমজান ১৪৪৬

জাতীয়

অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ না করেই খাল খননের অভিযোগ

সুমন কুমার রায়, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ৫, ২০২৩
অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ না করেই খাল খননের অভিযোগ

টাঙ্গাইল: টাঙ্গাইলের করটিয়ার ঐতিহ্যবাহী কাপড়ের হাট সংলগ্ন সুন্দরী খালটি জবর দখলের প্রতিযোগিতা চলছে। স্থানীয় শতাধিক ব্যক্তি শত বছরের ঐতিহ্য ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ সুন্দরী খাল জবর দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করে ব্যবসায়ীদের কাছে ভাড়া দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

 

এদিকে খালটি খনন করা হলেও এর ওপর ১০৩টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ না করেই হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে মোটা অংকের টাকা। আবার খালের ওপর নির্মিত অবৈধ স্থাপনাগুলোকে দেওয়া হয়েছে শপ লাইসেন্স।

তবে গত চার/পাঁচ মাস আগে খালটি পুনঃ উদ্ধারে একটি খনন প্রকল্প হাতে নিলেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধির হস্তক্ষেপে সেটি ভেস্তে যায়। খালের ওপর ১০৩টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ না করেই দায়সারাভাবে খনন কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে দুই কিলোমিটার খাল খনন না করেই প্রভাবশালীদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিধি ও করটিয়া হাট কমিটির নেতৃবৃন্দ।

জানা গেছে, টাঙ্গাইল সদর উপজেলার করটিয়ার সুন্দরী খালটি এক সময় স্থানীয় জমিদার ও পরিবারবর্গের নৌপথে যাতায়াতের একমাত্র পথ ছিল। সে সময় এ খাল দিয়ে পানসি নৌকাসহ বড় বড় জাহাজও চলাচল করত। খালটিতে তৎকালীন জমিদারদের স্ত্রী-কন্যাসহ দাস-দাসীরা গোসল করতেন। পরে নানা দিক বিবেচনায় অপার সৌন্দর্যের কারণে জমিদাররা খালটি ‘সুন্দরী খাল’ নামে অভিহিত করেন। কালের বিবর্তনে খালটির স্রোতধারা হারিয়ে গেছে। অবৈধ দখলদারদের কালো থাবায় খালটি প্রায় মৃত। যেটুকু রয়েছে- তা ময়লার ভাগাড়। স্থানীয় প্রভাবশালী শতাধিক ব্যক্তি সরকারি মালিকানাধীন সুন্দরী খালটি দখল করে নিয়েছেন। খালের দুই তীরে গড়ে উঠেছে স্থাপনা। তবে খালের হাটের অংশে স্থাপনা নির্মাণ করে রীতিমতো ভাড়া দিয়ে ফায়দা লুটছেন প্রভাবশালীরা। কেউ কেউ বাড়িঘরও নির্মাণ করেছেন। অবশিষ্ট অংশে ময়লা-আবর্জনা ও দূষিত বর্জ্য ফেলায় এলাকার পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে। আবার অনেকে খালে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষও করছেন।

স্থানীয়রা জানায়, একসময় দেশ-বিদেশের লাখো ক্রেতার সমাগম ঘটত করটিয়া শাড়ির হাটে। সরকারি সা’দত কলেজের ২৭ হাজারসহ স্থানীয় পাঁচটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থী প্রতিদিন ওই খালের পাশ দিয়ে চলাচল করে থাকে। বর্জে্যর দুর্গন্ধে পথচারীদের বিড়ম্বনা পোহাতে হচ্ছে। বর্জ্য ফেলার পাশাপাশি দখলের প্রতিযোগিতায় নেমেছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। ২০১৬ সালে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে সুন্দরী খালের কিছু অংশ দখলমুক্ত করা হলেও আবার দখলে নেমেছে ওই চক্রটি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খালের একটি অংশ বীরকুশিয়া গ্রামের সাইফুল ইসলাম ওরফে সাইরন ২০ ফুট বাই সাত ফুট, করটিয়া এলাকার নুরু মিয়া ২০ ফুট বাই চার ফুট, বাবর মিয়া ২০ ফুট বাই ১০ ফুট, রুহুল আমীন, জাফর আলী ২০ ফুট বাই আট ফুট মাটি ভরাট করে দখল করে রাস্তা নির্মাণ করেছেন। এছাড়া আরও বেশ কয়েকজন একই স্থানে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করছেন।

অপরদিকে হাটের অংশে খালের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে বহুতল ভবন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ঐতিহ্যবাহী করটিয়া হাট কমিটি কর্তৃপক্ষ শাহজাহান আনছারীর নেতৃত্বে খালের ওপর অবৈধ স্থাপনাগুলো অবৈধভাবে শপ লাইসেন্স নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। এর মধ্যে চেয়ারম্যানের স্বজন ও অনুসারীরাই বেশি। মো. আরজু মিয়া নামে একজন গড়ে তুলেছেন তিন তলা ভবন। এর মধ্যে খালের অংশ দখল করেছেন ৩৫ ফুট বাই ৩০ ফুট। বেবি আক্তার গড়ে তুলেছেন দ্বিতীয় তলা ভবন। এর মধ্যে খালের অংশ ৬০ ফুট বাই ২০ ফুট। যা বর্তমানে ৩৩৯/১৯ নম্বর ল্যান্ড সার্ভে চলমান।

একই এলাকার মো. সুজন তালুকদার ৬০ ফুট বাই ৪০ ফুট, শামিম গং ৩৫ ফুট বাই ৩০ ফুট, গনি আনছারী গং ৩৫ ফুট বাই ৩০ ফুট (সরকারের সঙ্গে মামলা চলমান), লিটন আনছারী খালের ১৫ ফুট বাই ৬০ ফুট এবং মজিবর রহমান আনছারী টিনসেড দোকান করে ৩৪ ফুট বাই ২০ ফুট দখল করে রেখেছেন।

অভিযোগ উঠেছে, খাল খননের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শাহজাহান আনছারী ও তার অনুসারীরা। ফলে খাল খননের সময় খালের দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ পরিমাপ না করেই খাল খনন করা হয়। এছাড়া খালের ওপর ১০৩টি অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে উচ্ছেদ আতঙ্ক দেখিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হয় মোটা অংকের টাকা। পরবর্তীতে এসব অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ না করেই দায়সারাভাবে খাল খনন করা হয়। এমনকি বীরকুশিয়া এলাকায় দুই কিলোমিটার খাল খননই করা হয়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে করটিয়া বাজার কমিটির এক সদস্য জানান, সুন্দরী খালটি খননের কাজ করেছেন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নিজেই। আর এটি দেখাশোনা করেছেন তার সহকারী অপু ও মনির। খালটি খনন করলেও কোনো অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়নি। বরং অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। কীভাবে খালের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ পরিমাপ এবং অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ না করে যেভাবে খাল খনন করা হয়েছে এটি অনিয়ম ছাড়া আর কিছুই না। এর দায়ভার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিতে হবে। কারণ সরকারি দলের চেয়ারম্যান খাল খননের দায়িত্বে থাকায় সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তাই এর কোনো খোঁজ খবর রাখেননি। বরং তারা এসব অবৈধ স্থাপনা শপ লাইসেন্স দিয়ে মোটা অংকের সুবিধা নিয়েছেন।

এ বিষয়ে টাঙ্গাইল সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শাহজাহান আনছারী জানান, খালটি খনন নিয়ম মোতাবেক করা হয়েছে। খালের ওপর কোনো অবৈধ স্থাপনা নেই। যদি থাকে তাহলে সেগুলো উচ্ছেদের দায়িত্ব প্রশাসনের।

টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডে নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাজ্জাদ হোসেন জানান, ইতোমধ্যে খালের ওপর গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য জেলা প্রশাসক বরাবর একটি লিখিত আবেদন করা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয়রা এ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে সার্বিক সহযোগিতা করবেন বলেও তিনি আশাবাদী।

টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক মো. কায়ছারুল ইসলাম জানান, করটিয়া সুন্দরী খালের ওপর যে সমস্ত অবৈধ স্থাপনা রয়েছে সে বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে শিগগিরই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৬২৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৫, ২০২৩
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।