দেশে প্রতিদিন ২২০ জন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবন্ধী হন। একটি বছর হিসেবে এ সংখ্যা ৮০ হাজার।
শনিবার (২১ অক্টোবর) সড়ক আইন ও বিধি অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত সব নাগরিককে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবিতে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। সেখানে নিজ বক্তব্যে এ তথ্য জানান মোজাম্মেল।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার থাকলেও সড়ক নিরাপত্তায় দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম নেই। আমাদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ও ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে রোড সেফটি ইউনিট গঠিত হয়। কিন্তু টেলিভিশন মিডিয়ায় তাদের কথা বলা ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কোনো গবেষণা কার্যক্রম নেই।
তিনি আরও বলেন, সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে নানা ইউনিট ও প্রতি বছর ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ থাকলেও সড়ক দুর্ঘটনার মহামারি থেকে দেশ ও দেশের মানুষকে রক্ষায় কোনো বাজেট নেই। এই মন্ত্রণালয়ে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কোনো গবেষক-গবেষণা নেই, কোনো বাজেট বরাদ্দ নেই। ফলে প্রতি বছর সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বাড়ছেই।
মোজাম্মেল হক চৌধুরী তথ্য দেন, আমাদের তথ্য অনুযায়ী প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৮ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, সড়কে প্রতিদিন ৬৪ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। এই তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ২৩ হাজার ৩৬০ জন মানুষের প্রাণহানি হচ্ছে। প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মানুষ আহত হচ্ছে। প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৮০ হাজার মানুষ প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে ১২ হাজারের বেশি ১৭ বছরের কম বয়সী শিশু। এ হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ২২০ জন মানুষ প্রতিবন্ধী হচ্ছে কেবল সড়ক দুর্ঘটনায়।
অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সারা বিশ্বে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩ লাখ মানুষ মারা যায়। বাংলাদেশে মারা যায় ২৪ হাজার ৯৫৪ জন। সংস্থাটির তথ্যমতে, হতাহতদের ৬৭ শতাংশই ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী। এক্ষেত্রে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী ব্যক্তিরাই সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছে। সংস্থাটি দাবি করছে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত জিডিপির ক্ষতি ৫.৩ শতাংশ।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ২০১৭ সালে প্রকাশিত এক গবেষণার প্রতিবেদন তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় একজন কর্মক্ষম ব্যক্তি প্রাণ হারানোর কারণে ২৪ লাখ ৬২ হাজার ১০৬ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়। সেই হিসেবে জাতীয় অর্থনীতিতে প্রতি বছর এক হাজার ৯৭০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে শুধু মাত্র সড়কে মৃত্যুর কারণে। তবে এর সঙ্গে দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তির পরিবারের অন্যান্যদের অর্থনৈতিক চাপ, কর্মক্ষেত্রের ক্ষতিসহ অন্যান্য বিষয় আমলে নেওয়া হয়নি। সেই হিসেবে প্রত্যেক নিহত ব্যক্তির পরিবার এই পরিমাণ অর্থ রাষ্ট্র থেকে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার রাখে।
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের পরিবারকে ১০ লাখ ও আহতকে ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানিয়ে তিনি আরও বলেন, সড়ক পরিবহন আইন- ২০১৮ এর বিধিমালা অনুযায়ী নিহতের পরিবারকে ৫ লাখ ও আহত অঙ্গহানি বা পঙ্গু ব্যক্তিকে ৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু এই আইন কার্যকরের ৫ বছরের মাথায় গত তিন দিন আগে নামে মাত্র ১৬২ জনকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে।
বিআরটিএ’র পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪ হাজার ১৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৭২৭ জন নিহত ও ৫ হাজার ৭৮১ জন আহত হয়েছে। সেই হিসেবে নিহত ব্যক্তির পরিবার ১৮৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকা এবং আহত ব্যক্তিরা ১৭৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার দাবিদার। অথচ গত বৃহস্পতিবার সরকারের পক্ষ থেকে ১৬২ জনকে ৭ কোটি ৮ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে।
জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস উপলক্ষে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর-রুনী মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনটির আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের পরিবারকে ১০ লাখ ও আহতকে ৫ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়াসহ ৭ দফা দাবি জানান সংগঠনের নেতারা।
দাবিগুলো হলো- সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের আর্থিক সহায়তা থেকে নিহতের পরিবারকে ১০ লাখ ও আহতকে ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া; সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের এই তহবিলে আবেদনের বিষয়ে জানাতে থানা, হাসপাতাল ও বিভিন্ন বাস টার্মিনালে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা ব্যবস্থা করা; গুরুত্বপূর্ণ সড়ক দুর্ঘটনায় মামলার ক্ষেত্রে স্পটে তাৎক্ষণিক আর্থিক সহায়তার চেক বিতরণের উদ্যোগ নেওয়া; সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের আর্থিক সহায়তা প্রাপ্তির আবেদন জমাদানের সময়সীমা দুর্ঘটনার তারিখ থেকে এক মাসের পরিবর্তে ন্যূনতম ১ বছরের মধ্যে আবেদন করার সুযোগ রাখা; তহবিলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা, মালিক শ্রমিক সংগঠনের প্রভাবমুক্ত রাখার উদ্যোগ নেওয়া; সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের আর্থিক সহায়তা তহবিলে বাস মালিক সমিতি, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের পাশাপাশি বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা; সিসি ক্যামেরা পদ্ধতিতে ই-ট্রাফিকিং প্রসিকিউশন সিস্টেম চালু করা। চালক ও মালিকের ব্যাংক হিসাব থেকে অটো জরিমানা আদায়ের পদ্ধতি চালু করা।
অনুষ্ঠানে সংগঠনের সহ-সভাপতি তাওহিদুল হক লিটন, যুগ্ম মহাসচিব এম.মনিরুল হক, প্রচার সম্পাদক মাহমুদুল হাসান রাসেল, কেন্দ্রীয় নেতা মো. মহসিনসহ সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের বেশ কয়েকজনের পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৯১০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০২৩
এমজে