ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

নাজিরপুরে শতবর্ষের চিতই পিঠা উৎসব

এইচ এম লাহেল মাহমুদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২৪
নাজিরপুরে শতবর্ষের চিতই পিঠা উৎসব

পিরোজপুর: পিরোজপুরের নাজিরপুরে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল শতবর্ষের চিতই পিঠা উৎসব। প্রতিবছর এ উৎসব শুরু হয় সন্ধ্যায় আর শেষ হয় পরের দিন সকাল ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে।

প্রচণ্ড শীত উপেক্ষা করে হাজারো মানুষের ভিড় দেখা যায় এ উৎসবকে ঘিরে।

অন্যান্য বছরের ন্যায় এবারও শুক্রবার (৯ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় এ উৎসব শুরু হয়ে শেষ হয়েছে শনিবার (১০ ফেব্রুয়ারি) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে।  

জানা গেছে, পিঠা উৎসবটি উপজেলার সদর ইউনিয়নের কুমারখালী বাজার সংলগ্ন দেবলাল চক্রবর্তীর বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়। আর ওই উৎসবে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ অংশগ্রহণ করেন। উৎসবটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আয়োজনে  হলেও স্থানীয় বিভিন্ন ধর্মের নারী-পুরুষরা অনুষ্ঠান উপভোগ করতে সেখানে আসেন। আর সেখানে থাকা কালী মন্দিরকে কেন্দ্র করে ওই উৎসবের আয়োজন করা হয়।

মন্দির কমিটির সভাপতি অমৃত লাল দাস জানান, প্রায় শত বছরের বেশি সময় ধরে এ চিতই পিঠা উৎসব হয়ে আসছে। প্রতি বছরের মাঘের অমাবস্যা তিথিতে কালিমন্দিরে এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মন্দিরের ভক্তসহ বিভিন্ন লোকজন এখানে আসেন। তবে তাদের মনোবাসনা (মানত) পূর্ণ করতে বা পূর্ণ হলেই এখানে এসে এ চিতই উৎসবে যোগ দেন তারা। আর এদের অধিকাংশই যেসব নারীদের সন্তান হয় না (বন্ধ্যা) তারাই মানত করতে আসেন। আর সন্তান লাভের পর এখানে চিতই উৎসব করেন।  তিনি আরও বলেন, আমাদের বাব-দাদার কাছ থেকে শুনেছি এখানে প্রথম এক মা তার সন্তান লাভের জন্য মানত করতে আসেন এখানে। পরে তার মনোবাসনা পূর্ণ হলে তিনি কালী মা (কালী মন্দির) চিতই ভেঁজে খাওয়ান। সে থেকেই এ উৎসবের শুরু। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজারো ভক্ত যোগ দেন এ উৎসবে।  

মন্দিরের দায়িত্বে থাকা পুরোহিত দেবলাল চক্রবর্তী জানান, প্রায় শত বছরের অধিক সময় আগে তার পূর্ব পুরুষ হরষিত আনন্দ চক্রবর্তী ওই উৎসবের আয়োজন করেন। উৎসবে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ভক্তরা যোগ দেন। তারা তাদের মনোবাসনা পূর্ণ করতে এখানে মানত করেন। আর মনোবাসনা পূর্ণ হলে এ চিতই উৎসবে যোগ দেন ভক্তরা।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, প্রচণ্ড শীত উপেক্ষা করে সেখানে হাজারো মানুষের উপস্থিতি। উপস্থিত অনেক দম্পত্তির কোলে রয়েছেন ছোট শিশু সন্তান। সেখানের একটি মাঠে সারি করে পরস্পর ১০৮টি মাটির চুলা তৈরি করা হয়েছে। সেই চুলার ওপর সাজানো রয়েছে চিতই পিঠা তৈরির মাটির সাজ। পাশেই বাজানো হচ্ছে ঢোল-তবলা। ওই মন্দিরের দায়িত্বে থাকা পুরোহিত দেবলাল চুলাগুলোর প্রতিটিতে পর্যায়ক্রমে লোহার একটি পাত দিয়ে আঘাত, চুলায় থাকা সাজে ফুল ও পরে চুলায় আগুন দিয়ে অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেন। এসময় হিন্দু নারীরা উলু ধ্বনির মাধ্যমে অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করন। ১০৮টি চুলায় পর্যায়ক্রমে পিঠা তৈরিতে অংশ নেন বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বিভিন্ন বয়সের নারীরা।  

উদ্‌যাপন কমিটির সদস্যরা পিঠা তৈরি উপকরণ চালের গুড়ার গোলা সরবরাহ করছেন। এ ছাড়া কালি মন্দিরের সামনের থাকা একটি বড় বটগাছের উঁচুতেও তৈরি হচ্ছে চিতই পিঠা।

বাগেরহাট জেলার চিতলমারী উপজেলার রানাপাড়া গ্রামের উৎথান ঘড়ামী জানান, তিনি তার দাম্পত্য জীবনের ১০ বছরে তাদের কোনো সন্তান জন্ম না হওয়ায় তারা এখানে মানত করায় তারা একটি ছেলে সন্তান লাভ করেন। আর তাই সেই ছেলে সন্তান নিয়েই এখানে আসেন।

একই উপজেলার খলিসাখালী গ্রামের ও উপজেলা সদরের সরকারি বঙ্গমাতা কলেজের প্রভাষক নিত্যানন্দ রায় জানান, তার স্ত্রীও একই কলেজের প্রভাষক। তাদের দাম্পত্য জীবনের পাঁচ বছরেও কোনো সন্তান না হওয়ায় তারা এখানে মানত করেন। আর সেই মানতে ফলে তারা একটি কন্যা সন্তান লাভ করেন।

একই কথা বলেন, গোপালগঞ্জ জেলার কোটালিপাড়া উপজেলার বিউটি গাইন, যশোরের অভয়নগর উপজেলার চেঙ্গুটিয়া গ্রামের সুপ্রিয়া শিকদার।

নাজিরপুর উপজেলা পরিষদের নারী ভাইস চেয়ারম্যান শাহারিয়ার ফেরদাউস রুনা জানান, প্রতি বছর এখানে এ পিঠা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীসহ বিভিন্ন ধর্মের নারী পুরুষ আসেন। এ অনুষ্ঠান উপভোগ করতে হাজারও দর্শনার্থী দুই তিন দিন আগে থেকে আসতে থাকেন।  

নাজিরপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. শাহ আলম হাওলাদার জানান, অনুষ্ঠানটি শত বছরের বেশি সময় ধরে সুন্দরভাবে চলে আসছে বলে শুনেছি। সেখানের অনুষ্ঠানের নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশ পাঠানো হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২৪
এসএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।